Alapon

লিবারেজিমের অন্তর্গত রূপ এবং কিছু কথা...



বাংলাদেশে গাঁজা চাষ, উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ। গাঁজাখোরদের অপরাধী মনে করা হয়। প্রথম লাইন 'গাঁজা' শব্দ দিয়ে শুরু করতেও বারবার চিন্তা করতে হয়েছে, মনের মধ্যে সংকোচ কাজ করেছে। কিন্তু পৃথিবীর সব দেশে গাঁজা নিষিদ্ধ নয়। উদাহরণস্বরূপ কানাডার কথা বলা যায়। সুদর্শন কানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সরকার ২০১৮ সালের শেষ দিকে গাঁজা চাষ ও বিক্রি বৈধ করেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গাঁজার ফার্মটিও কানাডায় অবস্থিত। বর্তমান রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে যে ক'জন সমকামীদের বিকৃত মুভমেন্টের পক্ষাবলম্বন করছেন তাদের মধ্যে লিবারেল পার্টির নেতা জাস্টিন ট্রুডো অন্যতম।

আইমান সাদিক প্রতিষ্ঠিত রবি টেন মিনিট স্কুলের শিক্ষকদেরকেও দেখা যাচ্ছে সমকামীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে। তারা হোমোসেক্সুয়ালিটিকে গর্হিত কাজ হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। টেন মিনিট স্কুল চ্যানেল সাকিব -মিথিলাদের বহু বিতর্কিত কন্টেন্ট প্রচার করছে যা ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। বিকৃত এক বন্ধনহীন স্বাধীনতার সবক দেয়া হয় সেখানে।

টেন মিনিট স্কুলের বিতর্কিত কাজ গুলো এবং জাস্টিন ট্রুডোর লিবারেল পার্টি সমকামিতা , গাঁজা, মাদক, নগ্নতা ইত্যাদি বিষয়ে একমত হওয়ার পেছনে একটি অভিন্ন মতাদর্শ রয়েছে। সেই মতাদর্শই তাদের বহু বিষয়ে অভিন্ন অবস্থান গ্রহণের মানদন্ড হিসেবে কাজ করছে। আর তা হলো, লিবারেলিজম। যা পুরোপুরি ইসলামের বিপরীত একটি মতাদর্শ, বহু মুসলিমের ইমানহরনের জন্য দায়ী। ব্যক্তি, সমাজ, মানব জাতির জন্য ক্ষতিকর। তাই বর্তমান সময়ে লিবারেলিজম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা মুসলিমদের জন্য একান্ত জরুরি।

লিবারেলিজমের পরিচয়ে শিক্ষাবিদ জগলূল আসাদ লিখেন,

"লিবারেলিজম এর বাংলা সাধারণত করা হয় "উদারনীতিবাদ"। একে "স্বাধীনতাবাদ" বা "খাহেশাতবাদ" বললেও অত্যুক্তি হবে না। এর ইতিহাস অনেক দীর্ঘ, বিবর্তনও জটিল। সাধারণত জন লককে এর প্রবক্তা বলা হলেও ইউরোপীয় রেনেসাঁস, রিফর্মেশন আন্দোলন, আর এনলাইটেনমেন্ট দর্শন-এর সাথে লিবারেলিজম প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যোগ আছে।

পশ্চিমা চিন্তায় অভিজ্ঞতাবাদী দর্শন ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে যা পরিচিত সেটার ভেতর থেকে অর্থনৈতিক-সামাজিক- রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে লিবারেলিজম-এর জন্ম। একটা এন্টি- অথরিটারিয়ান পলিটিকাল ক্রীড হিসেবে এটাকে বিবেচনা করা হয়। লিবারেলিজম মানুষকে ভাবে স্বাধীন,যুক্তিশীল ও সার্বভৌম সত্তা হিসেবে, যে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে, নিজের পছন্দ অনুসারে " বাছাই" করতে পারে। "গুড লাইফ"-এর কোন সংজ্ঞা রাষ্ট্র চাপিয়ে দিবেনা জনগণের উপর, বরঞ্চ রাষ্ট্র একটা অধিকার-কাঠামো দিবে যেখানে "ব্যক্তিমানুষ" নিজের মূল্যবোধ, ধর্মবিশ্বাস, জীবনযাপনপ্রণালী বাছাই করে নিবে।"

অর্থাৎ লিবারেজিমের ধারণায় ব্যক্তি চিন্তা,কর্ম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীন, সার্বভৌম। আল্লাহর মর্জি, ইচ্ছা ও বিধানের সামনে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পরিবর্তে জীবনের মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করা হয় নিজের খায়েসাত তথা প্রবৃত্তিকে। মানুষ আল্লাহার দাস না হয়ে হবে প্রবৃত্তির দাস। আর আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বারবার প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন।

লিবারেজিমের অন্যতম মূলনীতি হলো ' অপরের ক্ষতি না করে, তুমি যা ইচ্ছে করতে পারো ' তোমার ব্যক্তি জীবনে তুমি স্বাধীন। অর্থাৎ তুমি যা ইচ্ছে পরবে, তা ইচ্ছে খাবে, যা ইচ্ছে করবে। ইচ্ছে হলে নগ্ন হয়ে বীচে যাবে, কুকুর, বিড়াল, মদ,গাঁজা যা ইচ্ছে খাবে। লিবারেল ডকট্রিনে জিনা-ব্যভিচার-লিভটুগেদার সবই ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। শুধু এটুকু মনে রাখতে হবে অন্যের ক্ষতি করে বা অসম্মতিতে কিছু করা যাবে না। পরস্পরের সম্মতিতে সকল নিষিদ্ধ কাজও সিদ্ধ হয়ে যায় লিবারেল ডকট্রিনে। টেন মিনিট স্কুলের ভাষায় শুধু Consent ( সম্মতি ) থাকলেই হবে।

Consent শিরোনামের ভিডিওতে যেমন বলা হয়েছে, "কেউ আপনার বান্ধবী হলেই তাকে জড়িয়ে ধরা যাবে না, আগে জানতে হবে এতে তার consent (সম্মতি) আছে কিনা।" অর্থাৎ শুধু সম্মতি থাকলেই বিবাহ বহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ক বৈধ হয়ে যাবে। এই সম্মতি ও স্বাধীনতার দৃষ্টিকোণ থেকেই লিবারেলদের কাছে সমকামিতা, পরকিয়ার মতো জঘন্য সমাজবিধ্বংসী কাজগুলো বৈধ।

আবার অন্য ভিডিওতে দেখা যায়, বাবা-মাদের জ্ঞান দেয়া হচ্ছে, মেয়েকে রাতে বাইরে সময় কাটাতে বাঁধা দেয়া, ছেলে মেয়েদের আলাদা পোষাক দেয়া (নারী পুরুষের ভিন্ন পোষাক), মেয়েকে ছেলেদের সাথে লং টুরে না যেতে দেয়া, এগুলো উচিত নয়। অর্থাৎ এতে বাবা-মা সন্তানের ব্যক্তি স্বাধীনতাহরণ করছে, মেয়ে চাইলে টেন মিনিট স্কুলের ট্রেইনার মিথিলার মতো বহু পুরুষের সাথে অপকর্ম করার স্বাধীনতা দিতে হবে। টেন মিনিটের এ পাঠ গুলোতে মূলত খুব সচেতনভাবে লিবারেলিজমের দিকে আহ্বান করা হচ্ছে। যেমনটা পশ্চিমা লিবারেল সমাজে আমরা দেখি সন্তানের অনৈতিক কাজে বাবা-মা'র শাসনের কোন অধিকার নেই, বাধা দিতে গেলে উল্টো বাবা-মাকেই মামলা খেতে হয়।

লিবারেলিজমের আরেকটি মূলনীতি হলো tolerance (সহনশীলতা)। অপরের এই বিকৃত স্বাধীনতাচর্চার প্রতি সহনশীল হতে হবে, শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় টেন মিনিটের শামির মুন্তাজীর বা জাস্টিন ট্রুডো নিজেরা হয়তো সমকামী নন। কিন্তু সমকামী মুভমেন্টের পক্ষে। তাদের যুক্তিমতে তারা(সমকামীরা) সমকাম করছে পরস্পরের সম্মতিতে, তাই লিবারেল ধর্মে তা বৈধ। তাই তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ ও সমর্থন লিবারেল ধর্মের অনুসারীদের জন্য জরুরি। না হলে তারা সহনশীল হতে পারবেন না।

বলার অপেক্ষা রাখে না এটি খুবই জঘন্য এক দৃষ্টিভঙ্গি। হারাম কাজ না করলেও হারাম কাজকে বৈধ বা রাইট ভাবতে শেখায়। আর কোন হারামকে হালাল (বৈধ,রাইট) মনে করা কুফরি এবং ইমানভঙ্গের কারণ। সহনশীলতার নামে ধ্বংস করে দেয় আল ওয়ালা আল বারহ ( আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব ও আল্লাহর জন্য সম্পর্কছেদ) এর চেতনা।

এছাড়া লিবারেলিজম সমাজে সেক্যুলারাইজেশ ঘটায়। যা রাষ্ট্রের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ধর্মকে নানা সেক্টর থেকে উচ্ছেদ ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে তিরোহিত করতে কাজ করে। সাথে সাথে লিবারেলিজম ভোগবাদকে উস্কে দিয়ে সুদভিত্তিক বৈষম্যমূলক পুঁজিবাদের বিকাশে সহায়তা করে। গড়ে তুলে অর্থনৈতিক বৈষম্য। চমস্কির মতে, আধুনিক কালে লিবারেলিজম হচ্ছে অনেকটাই রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ।

লিবারেলরা ধর্মের ততটুকুই মানে যতটুকু তাদের দিল স্বায় দেয়, প্রবৃত্তির অনুগামী হয়। পূরিপূর্ণভাবে ইসলামের সকল বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ করেনা। এভাবে লিবারেল দর্শন বহু মুসলিমদের মানহরণ করে চলেছে। হৃদয়ে ঈমানের স্থলে কুফর প্রবেশ করাচ্ছে। প্রবৃত্তি পূজা দিকে আহবান করছে।

লিবারেল দর্শনের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো স্রষ্টার বিধানের মতো প্রবৃত্তির চাহিদাকেই নির্ভুল, উপকারী ও সর্বোচ্চ সুখের দিশারী মনে করা। ব্যক্তিকে মানবসভ্যতার অংশ হিসেবে না দেখে ইনডিভিজুয়াল মনে করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভালো মন্দের হিসেব কষা। আপনারে লয়ে বিব্রত থাকতে উৎসাহিত করা। ব্যক্তির ভালো বা মন্দ কাজের কারণে যে সমাজে ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তা এখানে অনেকটাই এড়িয়ে যাওয়া হয়। তাই মানসিক, নৈতিক, শারীরিক বিকৃতিমূলক কাজ গুলো বৈধতা দেওয়া হয় আর তার ফলাফল ভোগ করতে হচ্ছে পুরো মানব সমাজকে। বৈধ হয়েছে মাদক, ভ্রুণহত্যা , সমকামিতার মতো কাজগুলো। মানবতার ইতিহাস কে করছে কলুষিত। আর বাস্তবায়িত হচ্ছে আল্লাহর দীনের বিরুদ্ধে ইবলিসের এজেন্ডা।

লিবারেলিজমের সকল ভ্রান্তি ও ক্ষতিকরদিক এ লেখায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। প্রয়োজনে ভবিষ্যতে বিস্তৃত আলাপ হতে পারে। আইমান সাদিকরা যে শিক্ষার আরালে একটি ক্ষতিকর মতাদর্শ প্রচার করছে তা আশাকরি চক্ষুষ্মান সকলের নিকট দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সর্বশেষ বলবো সমাকামিতা সাপোর্ট করে আমাদের লিবারেল হবার প্রয়োজন নেই, আমাদের জন্য মুসলিম পরিচয়ই যথেষ্ট এবং গর্বেরও। আমাদের লেখায় কষ্ট পেয়ে তেড়ে আসার আগে এটাও মাথায় রাখা উচিত, কোন ব্যক্তির প্রতি অন্ধ ভালোবাসা যেন আমাদের ইমান ধ্বংসের কারণ না হয়।

- মনির

পঠিত : ৩৮৩ বার

মন্তব্য: ০