Alapon

অপার্থিব


আড় চোখে বারবার তাকায় রিফাত । নাহ এই টিচারটার যা ভাবগতিক, তাতে মনে হচ্ছে খুব বোরিং হবে । কেমন হ্যাংলা পাতলা দেখতে ।
আন-স্মার্ট, খেত একটা !
কথাও বলছে কেমন যেন ধেমে ধেমে, আস্তে ধীরে ।
এ শিখাবে ম্যাথ ?
এবার মায়ের দিকে তাকায় সে । বিরক্তিটা এবার মায়ের দিকে মোড় নেয় ।
কি মোম !
এমন একটা টিচার তুমি আমার জন্য সিলেক্ট করলে । আর কোন টিউটর নাই ঢাকা শহরে ।
কথাগুলো মনে মনে আওড়ায় রিফাত মাহমুদ ।
রিফাত ম্যাপলিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে স্ট্যান্ডার্ড ফাইফে পড়ে । তার বাবা বাংলাদেশের লিডিং পজিশনে থাকা একটি কর্পোরেট ফার্মের সিইও । অর্থ বৈভবের মধ্যে বেড়ে ওঠা তার ।
ছাত্র হিসেবে সে অসাধারণ । তার বিগত বছরের পারফরমেন্স কেউ ঘাঁটলে এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য । ইদানীং তাকে নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়েছে তার মা বাবা ।
দুজনেই ব্যস্ত মানুষ । ছেলেকে সময় দেওয়ার ফুরসত নেই তাদের । এরিমধ্যে সে যে কখন ভার্চুয়াল জগতে নিজেকে সেঁধিয়ে ফেলেছে তা বেখবরই থেকে যায় । হঠাৎ করেই বখে যেতে শুরু করে ।
তার দুষ্টুমি সইতে না পেরে দুইজন টিউটর হাল ছেড়ে এক রকম পালিয়েছে ।
এখন তার সারাদিন কাটে গেমস খেলে, চ্যাটিং করে, কার্টুন সিরিয়ালে ডুব দিয়ে ।
নাওয়া খাওয়ার সময়টুকু বাদে সারাদিন পিসি স্মার্টফোনে মুখ গুঁজে থাকে । ফোনটা হাত থেকে কেড়ে নিলেই পাগলামি চিল্লাচিল্লি করে বাড়ি মাথায় তোলে ।
মা বাবার সাথেও রুক্ষ আচরণ করে ।
তার হাবভাব দেখে তার মা অনেক কষ্টে আনিসকে তার টিউটর হিসেবে রাজি করিয়েছে ।
আনিস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইবিএ'তে পড়ে । তার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছে তার মা । আনিসের সাহচর্যে কত ইঁছড়ে পাকা মানুষ হয়ে গেল !
প্রথমদিন অবশ্য পড়ালেখা তেমন হল না । শুধু পরিচয় পর্বটুকু শেষ হল ।
দ্বিতীয় দিন পড়তে বসে উশখুশ করতে থাকে রিফাত । স্যার ওয়াশরুমে যাব । একথা বলেই যে গেল, আধাঘণ্টা তার কোন পাত্তা নাই !
টিউটরদের ফাঁকি দেয়ার হাজারো ফন্দি তার মাথায় গিজগিজ করে । যা প্রয়োগ করে দুজন এনিমিকে ঘায়েল করে ভিক্টরি অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে ইতোমধ্যেই ।
বুয়া পানি খাব বলে গ্লাস হাতে দশ মিনিট, মা পেট ব্যথা করছে, চা খাব বলে পনের মিনিট, মা টিচারকে নাস্তা দাও, এই বুয়া দেখতো পড়ার টেবিলের নিচে এত ময়লা কোথা থেকে আসলো ...।
এরকম কত ছুতো যে তার মাথায় ঘুরে তার ইয়াত্তা নেই ।
এক সপ্তাহ এভাবেই কেটে গেল ।
একদিনের ঘটনা । যথারীতি আজও রিফাত বলল -- স্যার ওয়াশরুমে যাবো, যাই স্যার ?
বলে পড়ার টেবিল থেকে উঠে দাঁড়াল ।
না !
তুমি বস বস । রাগত স্বরে তাকে বসতে বলে আনিস ।
তুমি ওয়াশরুমে যেতে পারবে না । আসলে তোমার তো চাপ আসেনি তুমি যাচ্ছ সময় কাটাতে । আমি কিন্তু সব বুঝি ।
শোন রিফাত তুমি যদি ভাব যে আমাকে ফাঁকি দিচ্ছ তাহলে ভুল ভাবছ । আদতে তুমি নিজেকেই ফাঁকি দিচ্ছ । তুমি তোমার জীবনের মূল্যবান সময় হেলায় ফেলায় নষ্ট করছ ।
এর পরিণতি ভাল কিছু বয়ে আনবে না । মনে রেখো ।
একথা শুনে রিফাত কিছু না বলে থ মেরে বসে গেল ।
তার ম্যাথ টিউটর যেন তার দুষ্টুমির সব খবর জেনে ফেলেছে । অভিনয় ফন্দি ছল ছুতো সব অ্যাটক ভেস্তে যেতে শুরু করেছে ।
ডিসগাস্টিং !
প্রচন্ড রাগ হয় তার ।
এভাবে দেখতে দেখতে একমাস কেটে যায় ।
একটু একটু করে নতুন এই টিচারের সহবত ভাল লাগতে থাকে ।
নাহ, স্যার এতটা খারাপ না ।
বেশ মজার মজার গল্পও করেন । রিফাত নিজের অজান্তেই তার টিউটরকে অনুসরণ করা শুরু করে ।
ইদানীং সে হ্যালোর পরিবর্তে আসসালামু আলাইকুম, কুল, অস্থির, ওসাম ইত্যাদির পরিবর্তে মাশআল্লাহ , বিদায় মুহূর্তে আল্লাহ হাফেজ এই পরিভাষাগুলো ব্যবহার করছে ।
আনিসের সাথে এখন তার মধুর খুনসুটি ।
দুজনে যেন পিয়ারে দোস্ত । নিত্যদিন মজার মজার এক্সপ্রিমেন্ট চলে তাদের । স্কুলের সায়েন্স ফেস্টিভ্যালে রিফাতের প্রজেক্ট চ্যাম্পিয়ন হয়। ছোট ছোট মানবিক কাজেও উৎসাহী হয়ে উঠে রিফাত ।
অথচ পড়ালেখাও চলে সমান তালে ।
এই রোগা হ্যাংলা পাতলা মানুষটা তার হৃদয়ের বিশাল জায়গা দখল করে নেয় ।
টিচারের সাথে পাল্লা দিয়ে সেও ভাল ভাল কাজ করা শুরু করে । ক্লাস ফাঁকি দেয়া তো কবেই ছেড়েছে ।
যদিও এর সবগুলো কাজ সে করে তার টিচারকে খুশি করার জন্য । বাহবা শোনার জন্য ।
কোন ভাল কাজ করার কথা শুনে যখন টিচার তার মাথায় হাত বুলিয়ে জাজাকাল্লাহ বলেন ; তখন তার কি যে ভাল লাগে ।
দিন ভালই কাটছিল । হঠাৎ একটা সংবাদ শুনে অস্থির হয়ে যায় রিফাতের মন ।
আনিস কানাডার একটা স্বনামধন্য ভার্সিটিতে স্কোলারশিপ পেয়েছে । সামনে মাসেই সে পিএইচডি করতে কানাডার উদ্দেশে উড়াল দিবে । এ দৃশ্য কল্পনা করতেই তার চোখে অশ্রু উপচে পড়ে । সেদিন রাতে বালিশে চোখ চেপে অনেকক্ষণ কাঁদে রিফাত । স্নেহের অপার্থিব মমতায় এতদিন তাকে আগলে রেখেছিল আনিস । এখন এমন একজন বন্ধুর অনুপস্থিতি অনুভব করে কান্নার তোড় বাড়ে রিফাতের । সে কান্না অবশ্য কেউ শুনল না ।
কে এই কচি হৃদয়ের কাকুতি অনুভব করবে ?
আজই আনিসের সাথে তার শেষ বারের মত পড়তে বসা ।
শোন রিফাত তোমাকে কিছু কথা বলি । মনোযোগ দিয়ে শুনবে ।
তোমাকে আমি অনেক স্নেহ করি । দোয়া করি তুমি ভাল মানুষ হও, বড় মানুষ হও । যে কাজই তুমি কর না কেন, তা যেন হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য । এতে পার্থিব প্রত্যাশা থাকলে ভাল কাজগুলো আল্লাহ কবুল করেন না । এটা হয়ে যায় তখন প্রদর্শণেচ্ছা । যা করলে গুনাহ হয় । আশা করি তুমি তোমার বন্ধুদেরও ভাল কাজে ইনক্লুড করবে । সত্য সুন্দরের আহবান জানানো ফরজ । একে বলা ইনভাইটেশন । যার জন্য পৃথিবীতে নবী রাসূলদের আগমন । আমরা সব সময় একজন আহ্বানকারী ।
তুমি সে অনুযায়ী তোমার জীবন গড়বে । মুসলিমদের আলাদা লাইফ স্টাইল আছে । তা থাকতে কেন অামরা করুরটা ফলো করতে যাবো । তাদের মধ্যে অনেক আলাপ হয় ।
রিফাত কোন কোনটায় সায় দেয় আবার কখনো সখনো জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় ।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ।
প্রিয় স্যারকে বিদায় দিতে রিফাত তার আম্মুর সাথে এসেছে ।
এইতো স্যার লাগেজটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে ।
মায়ের সাথে তার স্যারের কুশল বিনিময় চলে ।
রিফাত কোন কথা বলে না ।
অল্প সময় পর আনিস রিফাতে দিকে তাকায় ।
তার দুচোখ পানিতে টলটল হয়ে আছে ।
আনিস যখন ডানহাত দিয়ে রিফাতের মাথাটা টেনে নিজের বুকে ঠেকায় তখনই হু হু হু করে ঝরতে থাকে শিশুতোষ ভালবাসার নিখাদ নোনাজল । যাতে কোন কৃত্রিমতা নেই ।
আছে একটি কচি মনের লাল নীল আবেগের অমিত টান...।

পঠিত : ৬৬৬ বার

মন্তব্য: ০