Alapon

মুসলিমরা কেন আমেরিকাতে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছিল??



"ষোড়শ শতাব্দীতে যদি কেউ মঙ্গল গ্রহে গিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখে, তাহলে পুরো পৃথিবী মুসলিমদের মনে হবে। মুসলিমরা যে গতিতে ছুটছে, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে হয়তো পুরো পৃথিবী ওদের করতলে হবে"।
উক্তিটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক Marshall Hodgson এর।

শুধু একটি বাক্যই ডিফাইন করে দেয় তৎকালীন সময়ে মুসলিমদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি সম্পর্কে। পুরো দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করছিল মুস
লিমরা। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা পর্যন্ত উসমানী সাম্রাজ্যের সীমানা, অন্যদিকে পুরো ভারত উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যে ক্ষমতার শীর্ষে, আফ্রিকার মালির সাম্রাজ্য তখন অবারিত সম্পদের আধার।
তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে, খাইরুদ্দীন বারবোসার মতো দুঃসাহসী নাবিক, শক্তিশালী নৌবাহিনী এবং অসাধারণ সেনাবাহিনী থাকা সত্ত্বেও মুসলিমরা কেন আমেরিকাতে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নি??
এক্ষেত্রে অনেকগুলো বিশ্লেষণ সামনে আসে। অনেক ঐতিহাসিক অনেকভাবে এর ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছেন। ইতিহাস পাঠ চিন্তার খোরাক তৈরী করে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভংগীতে ইতিহাসকে বিবেচনা করে থাকেন। উভয় পক্ষকে পাঠ না করলে সামগ্রিক চিত্র থেকে দূরে সরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

আমেরিকা আবিষ্কারঃ
প্রথমত একটি বিষয় পরিষ্কার যে, আমেরিকাতে কর্তৃত্ব স্থাপন না করলেও মুসলিমদের কর্তৃক আমেরিকাতে ইসলামের দাওয়াত কলোম্বাসের বহু পূর্বেই পৌছেছে বলে মতামত ব্যক্ত করেন অধিকাংশ ইতিহাস বিশেষজ্ঞরা।
কেননা ১৫ শ শতাব্দীর পূর্বে ইউরোপ কতটুকু অসভ্য জাতি ছিল তা সকলেরই জানা। জ্ঞানার্জন ও সভ্যতা শিক্ষার জন্য ইউরোপীয়ানরা স্পেন, ইস্তাম্বুল ও বাগদাদে আসা যাওয়া করতো। সেখান থেকেই জিওগ্রাফি সম্পর্কে ধারণা অর্জন করে ইউরোপীয়ানরা। তৎকালীন সময়ে ইউরোপে না ছিল বিজ্ঞান, না ছিল সোশিওলজি আর না ওরা জানতো ভূগোল বা মানচিত্রবিদ্যা। তৎকালীন সময়ে এসব জ্ঞানের একমাত্র সোর্স ছিল মুসলিমদের লেখা বইপত্র ও মানচিত্র।
কলোম্বাস আমেরিকাতে যাওয়ার সময় মুসলিমদের দেয়া মানচিত্র ব্যবহার করেন। দীর্ঘ এই যাত্রায় আশানুরূপ কিছু প্রত্যক্ষ না করার কারণে কলোম্বাসের সাথীরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে এবং স্পেনে ফিরে যাওয়ার দাবী জানায়। কলোম্বাসের তখন তার সাথীদের এই বলে আশ্বস্ত করেছিল যে- "দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ো না, আমি যদি পশ্চিমে যাই তাহলে অবশ্যই ভূমির সন্ধান পাব। এই তথ্য মুসলিমদের লিখিত বই থেকেই জানতে পেরেছি। পশ্চিমের ভূমিতে অবশ্যই আমরা পৌছাব। কারণ মুসলিমরা কখনো মিথ্যা বলতে পারে না।"

তুরস্কের বিখ্যাত ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি গবেষক প্রফেসর ডঃ ফুয়াদ সেজগিন তার একটি প্রবন্ধ "Amerika’nın Keşfinde Müslümanlar" তে উল্লেখ করেন যে- "কলম্বাস যে ম্যাপ ইতালিয়ান মানচিত্র ব্যবহার করেছিলেন তা ছিল মুসলিম আরবদের কাছ থেকে ধারকৃত। কেননা অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা রেখার ব্যাপারে তৎকালীন সময়ে মুসলিম দুনিয়া ছিল শ্রেষ্ঠ। অন্যদিকে ইউরোপ তখন সবেমাত্র শুরু। এছাড়াও কলোম্বাস আমেরিকাতে পৌছার ৬০-৭০ বছর পূর্বেও যেসকল ম্যাপ পাওয়া যায় ইউরোপীয়ানদের তাদের সকলের ম্যাপেই আমেরিকাকে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেখানে ব্রাজিলের কোস্টলাইনের দ্রাঘিমা ও অক্ষাংশ যেরকম সূক্ষভাবে তুলে ধরা হয়েছে তার মুসলিমরা ব্যাতীত আর কারও দ্বারা নির্ধারণ করা সম্ভব ছিল না। এসকল জ্ঞান তৎকালীন সময়ের ইউরোপের পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিল না কেননা ইউরোপ তখনো পর্যন্ত আফ্রিকার Cape of the Good Hope-ই আবিষ্কার করতে পারে নি।"


দক্ষিণ আমেরিকার মানচিত্রের খন্ডাংশ (পেরুর Strait of Magellan)

তিনি সেখানে আরও উল্লেখ করেন- "১৪২৮ সালের দিকে এক পর্তুগীজ রাজা ডম পিটার ইতালির ভেনিসে পরিভ্রমণের পথে একটি মানচিত্র সংগ্রহ করেন যেখানে পেরুর Strait of Magellan এবং আফ্রিকার Cape of the Good Hope এর অবস্থান উল্লেখ করা আছে।"

প্রফেসর ফুয়াদ সেজগিন বিস্তারিত আলোচনায় যুক্তি তুলে ধরে বলেন- “তৎকালীন সময়ে প্রেক্ষিতে একটি বিষয় পরিষ্কার করে যে, মানচিত্র অঙ্কন করতে হলে সমুদ্র জ্ঞানে অতি পারদর্শী হতে হবে এবং অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা রেখার ব্যাপারে ব্যাপক জ্ঞান থাকতে হবে। এছাড়াও মানচিত্র অঙ্কনের জন্য উক্ত এলাকা ভ্রমণ ও চষে বেড়ানোই ছিল একমাত্র পন্থা। আর সেই মানচিত্র তৈরী করতে বছরের পর বছর সময় ব্যয় করতে হতো। অথচ ১৩ শ এবং ১৪ শতাব্দীতে জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইউরোপ তো গণনার মধ্যেই পড়ে না। ইউরোপীয়ানদের নিকট ১৫ শ শতাব্দীতে প্রাপ্ত দুনিয়ার মানচিত্র ও ১৪২০ সালের দিকে আফ্রিকা ও আমেরিকার অবস্থানের তথ্য এমনিতেই পৌছে যায় নি। এসকল তথ্য জ্ঞান মুসলিমদের মাধ্যমেই পৌঁছেছে যা ছিল কয়েক শতাব্দীর গবেষণার ফল।”

ইউরোপীয়ানরা স্পেন দখল করার পর থেকে মুসলিমদের রেখে যাওয়া জ্ঞান বিজ্ঞানকে নিজেদের কাজে লাগিয়েছিল এবং সে অনুযায়ীই আমেরিকার দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজধানী কর্ডোভার পতন হয় ১২৩৬ সালে। সমুদ্রবিদ্যা ও মানচিত্রবিদ্যার ক্ষেত্রে মুসলিমদের রেখে যাওয়া এসকল তথ্য ও জ্ঞান বুঝতে ইউরোপকে ব্যয় করতে হয়েছে ২০০ বছরের বেশি সময়। আর ন্যাচারাল সাইন্সের টার্মিনোলজিসমূহ বুঝতে ওদের লেগেছে ৪০০ বছরের বেশি সময়।
এসকল তথ্যের সোর্স কেন আমরা বর্তমানে খুজে পাই না। সেটার ব্যাখ্যাও ফুয়াদ সেজগিন অসাধারণভাবে দিয়েছেন তার অন্যান্য বইয়ে। সে বিষয়ে আলোচনা অন্য আরেকদিন।

মুসলিমরা কেন আমেরিকাতে কর্তৃত্ব স্থাপন করেনি??
উপরোক্ত আলোচনা থেকে একটি সিদ্ধান্তে পৌছানো যায় যে, মুসলিমরা আমেরিকার সন্ধান পেয়েছে বহু পূর্বেই। পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল মুসলিমরা। তাই আমেরিকার সন্ধান পাওয়া তেমন অসাধ্য কিছু ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন উঠে যে, সন্ধান যদি পেয়েই থাকে তবে সেখানে মুসলিম কোন রাষ্ট্র গড়ে উঠেনি কেন? এর বদলে ১৬ শ শতাব্দীতে ইউরোপীয়ানরা কেন সেদিকে নিজেদের কলোনী স্থাপন করেছে?? উত্তর পেতে তৎকালীন বিশ্বব্যবস্থা এবং বিশ্ব রাজনীতির দিকে চোখ বুলানো যায়।


উসমানী সাম্রাজ্যের সীমানা

মুসলিমরা ইতিমধ্যেই স্পেন থেকে বিতাড়িত। শক্তিশালী মুসলিম সাম্রাজ্য বলতে ছিল উসমানী এবং মুঘল। এছাড়াও মধ্য-আফ্রিকার মালি সাম্রাজ্য সহ আরও ছোটখাট সাম্রাজ্য ছিল। বিশ্ব রাজনীতিতে একচেটিয়া আধিপত্য উসমানীদের। নিজেদের বিশাল ভূমি নিয়ন্ত্রণেই ব্যস্ত ছিল উসমানীরা। সেই সাথে একের পর এক বিদ্রোহ ও ইউরোপে নিজেদের বিস্তারে মনোনিবেশ করেছিলেন উসমানী সুলতানরা।
অপরদিকে, স্পেনে ইউরোপীয়ানরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করলেও পর্তুগীজ ও ইউরোপীয়ানদের মধ্যে এক ধরণের দ্বন্দ্ব সর্বদাই ছিল। অন্যদিকে ইতালি, ফ্রান্স ও জার্মানী উসমানীদেরকে তোয়াজ করে চলতে বাধ্য ছিল নিজেদের দুর্বলতার কারণে। আর ১৬ শতাব্দীতে তো সুলতান সুলেমানের দাপটে ইউরোপে তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।
১৫ শ শতাব্দীতে ইস্তাম্বুলের পরাজয় ও ভূমধ্যসাগরে উসমানীদের নিকট পর্যুদস্ত ইউরোপের জন্য তৎকালীন সমুদ্র পথ( ভূ-মধ্যসাগর, লোহিত সাগর) ব্যবহার এক রকমের নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে।
তাই বাধ্য হয়ে মুসলিমদের তৈরীকৃত মানচিত্র অনুসরণ করে আফ্রিকা পার হয়ে ভারত উপমহাদেশে যাওয়ার রাস্তা তৈরী করে নেয়। একই সাথে আফ্রিকাতে কলোনী স্থাপন করতে থাকে। ইউরোপ তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই আমেরিকার পথ ধরে এবং সেখানে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু তারপরও ইউরোপের মূল লক্ষ্য ছিল সেসময়কার প্রাচুর্যময় ধনী রাষ্ট্র ভারত উপমহাদেশ।

ষোড়শ শতাব্দীতে সমুদ্রপথে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে দর্পের সাথে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল উসমানীরা। ইউরোপ তখন উসমানীদের তুলনায় ছিল নস্যি। কিন্তু সেসময়ে স্পেন, পর্তুগাল, ব্রিটেন যখন আমেরিকাতে নিজেদের কলোনী প্রতিষ্ঠা করছিল তখন পৃথিবীর সেরা শক্তি হিসেবে বিবেচিত উসমানীরা যাদেরকে পুরো মুসলিম দুনিয়া খলিফা হিসেবে মেনে নিয়েছিল তারা কেন আমেরিকাতে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেনি, এতো শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও রিসোর্স থাকা সত্ত্বেও??

প্রথমতঃ
ভূ-মধ্যসাগর, লোহিত সাগর এবং ভারত মহাসাগরে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে ব্যস্ত ছিল উসমানীরা। কারণ ব্যবসার রুট বলতে মূলত ছিল এই একটিই। স্পেনিয়ার্ড ও পর্তুগীজরা দক্ষ হয়ে উঠেছিল সমুদ্রবিদ্যায় যেহেতু তাদের আর কোন গত্যান্তর ছিল না ব্যবসার ক্ষেত্রে। উপমহাদেশে ব্যবসা বিস্তৃতির লক্ষ্যে ওদের আসতেই হতো। ইতিহাস সাক্ষী ইউরোপীয়ানরা কখনোই কোন মূল্যবোধের ধার ধারে নি, যার সাক্ষী সমগ্র আমেরিকা। একইভাবে পর্তুগীজ ও স্পেনিয়ার্ডদের কোন মূল্যবোধ ছিল না। যেখানেই যেত ধ্বংসযজ্ঞ চালাতো। সমুদ্রপথে দস্যুগীরি চরম পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল পর্তুগীজরা। ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছিল। অস্ত্রের জোরে আফ্রিকা তো ধ্বংস করছিলই সেই সাথে ভারত মহাসাগরেও এসে তান্ডব শুরু করেছিল। তাই অসভ্য পর্তুগীজদের জ্বালায় অতিষ্ঠ মুসলিম বণিকদের রক্ষার জন্য ও ট্যাক্স ফ্রি সমুদ্রপথ চালু রাখতে ভূমধ্যসাগর, লোহিত সাগর এবং বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে সার্বক্ষণিক শক্তি ব্যায়ে ব্যস্ত ছিল উসমানীরা। আন্তর্জাতিকভাবে মুঘলদের নৌশক্তি এতোটা শক্তিশালী ছিল না বিধায় তারাও উসমানীদের সাহায্যের উপর ভরসা করে থাকতো।

দ্বিতীয়তঃ
উসমানীদের ভৌগলিক অবস্থানই ছিল ব্যাকফুটে। ১৫ শ শতাব্দীর শুরুতে মরোক্কোর জিব্রাল্টার প্রণালী হাতছাড়া হয় মুসলিমদের কাছ থেকে। পর্তুগীজদের দখলে চলে যায় পুরো জিব্রাল্টার প্রণালী। ফলশ্রুতিতে পর্তুগীজ ও স্পেনিয়ার্ডদের জন্য জিব্রাল্টার প্রণালী দুর্ভেদ্যে এক দুর্গে পরিণত হয়। পুরো ইউরোপ উসমানীদের বিরুদ্ধে এক হয়ে যায় এই প্রণালী রক্ষার তাগিদে। এতে করে ভূমধ্যসাগরের মধ্যেই আটকা পড়ে উসমানীরা। অপরদিকে আফ্রিকার রুট ধরে আমেরিকায় যাওয়া অনেক ব্যয়বহুল ও ঝুকিপূর্ণ ছিল কেননা পুরো ইউরোপের সকল শক্তি তখন আফ্রিকার সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ করছিল। তাই বাধ্য হয়েই উসমানীদেরকে নিজেদের এলাকা রক্ষার দিকেই মনযোগী হতে হয়। উসমানী খেলাফত আমেরিকা সম্পর্কে সকল ধরণের আপডেট রাখছিল গোয়েন্দাদের মাধ্যমে। বিখ্যাত উসমানী সমুদ্রবীদ পিরি রেইস তৎকালীন উসমানী সুলতানকে আমেরিকার ব্যাপারে পরামর্শ দিলে সুলতান সেলিম আমেরিকার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠেন, কিন্তু ভূমধ্যসাগরে ইউরোপীয়ানদের উক্ত বাধার কারণে তার উৎসাহে ভাটা পড়ে।

তৃতীয়তঃ
জিব্রাল্টার প্রণালী ব্যবহার ব্যতীত ভিন্ন আরেকটি পথ ছিল আমেরিকাতে উসমানীদের বসতি স্থাপনের। সেটি হচ্ছে পশ্চিম আফ্রিকার মরক্কো থেকে যাত্রা শুরু করা। কিন্তু সমস্যা বাধে সেখানকার ছোট ছোট সালতানাতের সাথে। খায়রুদ্দিন বারবোসার দ্বারা উসমানীরা আলজেরিয়া দখল করে নেয়। একই সাথে মরোক্কা বাদে আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া, লিবিয়া সহ সমগ্র উত্তর আফ্রিকা উসমানীদের অধীনে চলে আসে। সমস্যা শুরু হয় মরোক্কোর উত্তরাংশে আধিপত্য বিস্তারকারী ওয়াতাসিদ সালতানাতের সাথে। মরক্কো তখন দুইটি সালতানাতের অধীনে। উত্তরাংশ নিয়ন্ত্রণ করছিল ওয়াতাসিদ সালতানাত এবং দক্ষিণাংশ ও পশ্চিম সাহারার অংশ নিয়ে সাদি সালতানাত। এই দুই সালতানাতই উসমানীদের মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।



ওয়াতাসিদ সালতানাত ১৪৭২ সালে মরক্কোর উত্তরাংশে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। মরক্কোর এই সালতানাত ১৪৮৫ সালে স্পেনের সাথে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যে- ওয়াতাসিদ সালতানাত স্পেনের সর্বশেষ মুসলিম সালতানাত গ্রানাডাকে কোন ধরণের সাহায্য করবে না, বিনিময়ে ভূমধ্যসাগরে মরক্কোর জাহাজসমূহের কোন ক্ষতি করবে না স্পেন। নিজেদের শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে ও সকল মুসলিম অঞ্চলের সাথে নিজেদের সম্পর্ক গুটিয়ে স্পেন ও পর্তুগালের সাথে সম্পর্কের পরিণতি ছিল স্পেন ও পর্তুগালের নিকট মরক্কোর গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হাতছাড়া হওয়া। এছাড়া মরক্কোর জিব্রাল্টার প্রণালীর পুরোটাই যে পর্তুগাল ও স্পেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। একপাশে স্পেন ও অপরপাশে পর্তুগাল। যার দরুণ উসমানীদের জন্য জিব্রাল্টার প্রণালী পাড়ি দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মরক্কোর দক্ষিণাংশ সাদি সালতানাতের অধীনে ছিল। ১৫২৪ সালে সাদি সালতানাতের আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হারাতে থাকে ওয়াতাসিদ সালতানাত। অবশেষে ১৫৪৯ সালে পুরো মরক্কো সাদি সালতানাতের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এর পূর্বে ১৫৪১ সালে পর্তুগীজদের দখলকৃত Agadir, Azamor, Azafi এবং Arzila হতে পর্তুগীজদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হয় সাদি সালতানাত। তারপরও জিব্রাল্টার প্রণালী ও কিছু অঞ্চলের পুরোপুরী নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম ছিল পর্তুগীজরা। ব্যাপারটি সম্ভব হয়েছিল ব্যবসায়িক চুক্তির কারণে ও সাদি সালতানাতের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে।
এদিকে সাদি সালতানাতের হাত বিপর্যস্ত ওয়াতাসিদ যুবরাজ উসমানীদের কাছে সাহায্যের আবেদন করেন। উসমানীরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এবং কিছু অংশ দখল করতেও সক্ষম হয় কিন্তু ১৫৫৪ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে উসমানী সেনাবাহিনীর সাহায্য নেয়া ওয়াতাসিদ যুবরাজ পরাজিত হন এবং ওয়াতাসিদ সালতানাত সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষ হয়ে যায়।

পশ্চিম আফ্রিকার সাদি সালতানাত উসমানী খিলাফতকে মেনে নিতে অস্বীকার করে। এক্ষেত্রে সাদী সালতানাতকে সহায়তা করে পর্তুগাল ও স্পেন। উসমানীদের বিরুদ্ধাচারণ করতে গিয়ে সাদি সালতানাত স্পেনকে সহায়তা করতে শুরু করে উসমানীদের বিরুদ্ধে। এমনকি আলজেরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ শহর ওরান উসমানীদের হাত থেকে দখল করে নেয় স্পেন। উসমানীরা পুনরায় ওরান শহরের কর্তৃত্ব ফিরে পেতে হামলা করলে স্পেনকে সর্বাত্মক সহযোগীতা করে সাদি সালতানাত।
একদিকে স্পেন ও অপরদিকে সাদি সালতানাত উভয়ের সম্মিলিতি প্রতিরোধের কারণে উত্তর আফ্রিকা থেকে উসমানীদের আর আটলান্টিকে প্রবেশ করা সম্ভব হয় নি।

তবে ১৬’শ শতাব্দীর দিকে আমেরিকা ছিল শুধুমাত্র নতুন আবিস্কৃত একটি ভূমি যার সম্পর্কে উসমানীরা না যতটুকু অন্ধকারে ছিল ঠিক ততটুকুই ছিল ইউরোপীয়ানরা। আমেরিকা তখনো এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না উসমানীদের কাছে স্রেফ এডভেঞ্চার ব্যাতীত। ইউরোপীয়ানদের কাছেও একই ছিল ব্যাপারটি। এছাড়া আমেরিকার মতো অজ্ঞাত অঞ্চলের চেয়ে ভারত মহাসাগরে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ছিল উসমানীদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কেননা তখনোও তা ছিল ব্যবসার মূল কেন্দ্রবিন্দু। অপরদিকে সাদী সালতানাত বিভিন্ন অঞ্চল থেকে স্পেনিয়ার্ড ও পর্তুগীজদের বিতাড়িত করলেও তারা কখনো আমেরিকার ব্যাপারে চিন্তা করেছিল কিনা সে সম্পর্কে তেমন ইতিহাস পাওয়া যায় নি। তবে উসমানীদের যে আগ্রহ ছিল তা পিরি রেইসের ইতিহাস থেকেই জানা যায়।

চতুর্থতঃ
১৭ শতাব্দীতে উসমানী সাম্রাজ্য দুর্বল হতে থাকে এবং চতুর্মুখী আক্রমণে নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকে ইউরোপ থেকে। একদিকে ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, অপরদিকে রাশিয়া বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ করার দরুন অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয় উসমানী খিলাফত। এর সাথে তো আভ্যন্তরীন বিদ্রোহ আছেই। ১৮শ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপ কয়েক গুণ এগিয়ে গেলে ততদিনে অনেক দেরী হয়ে যায় উসমানীদের জন্য। অন্যদিকে ভারত উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য তার শক্তি হারিয়ে বসে এবং ইউরোপীয়ানরা সমুদ্র পথে ব্যবসায় একক আধিপত্য বিস্তার করে। আর উনবিংশ শতাব্দীতে ঋণে জর্জরিত উসমানীদের জন্য আমেরিকাতে কর্তৃত্ব স্থাপন কল্পনা বিলাস ব্যতীত আর কিছুই ছিল না।

মুসলিমরা আমেরিকার সন্ধান অনেক পূর্বে পেলেও ব্যবসার মূল পথ ছিল এশিয়া ও ভারত মহাসগর। তাই আমেরিকা প্রথমে সেভাবে নজর কাড়তে সক্ষম হয় নি। কিন্তু যখন আমেরিকার ব্যাপারে তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী মুসলিম সাম্রাজ্য উসমানীরা আগ্রহী হয়ে উঠে তখন তাদের গলার কাটা হয়ে দাঁড়ায় মরক্কোর সাদি সালতানাত ও স্পেন। পরবর্তীতে নিজেদের শক্তি হারাতে থাকে উসমানীরা এবং সাদি সালতানাত গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত হয়ে ভেঙ্গে পড়ে। এরপর ইউরোপীয়ান শক্তিগুলো পুরো দুনিয়াতে কলোনী স্থাপন করে লুটতরাজে মেতে উঠে। উসমানীরা তখনো নিজেদের সামলাতেই ব্যস্ত ছিল। যার দরুন মুসলিমদের কর্তৃক কখনোই আমেরিকাতে কর্তৃত্ব স্থাপন সম্ভব হয়ে উঠেনি।
পূর্বে উল্লেখ করেছি যে- ইউরোপীয়ানদের মধ্যে কোন ধরণের মূল্যবোধ ছিল না। তারা নিজেদের জাতি ব্যতীত অন্যদের কখনো মানুষ হিসেবে গণ্য করতো না। কিন্তু মুসলিমরা ছিল ভিন্ন। মুসলিমদের উসূল ছিল যেখানে যাবে সেখানে আবাদ করবে। ন্যায়ভিত্তিক ও ইনসাফপূর্ণ একটি সমাজ উপহার দিবে। মুসলিমরা মিশর গিয়েছে কিন্তু মিশরের পিরামিড ও স্থাপনাকে অক্ষত রেখেছে অপরদিকে ইউরোপীয়ানরা আমেরিকায় গিয়েছে কিন্তু সেখানকার পুরো সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। শুধু আমেরিকা নয়, আজ আফ্রিকা এবং ভারত উপমহাদেশের কথা ধরেন। কি ছিল না এই দু-অঞ্চলে। সভ্যতার কোন চিহ্নই রাখে নি মানবিকভাবে অসভ্য ইউরোপীয়ানরা।

শুধু চিন্তা করে দেখুন, ১৩’শ শতাব্দীর আন্দালুসিয়া তথা স্পেন যদি আরও ৩০০ বছর নিজেদের টিকিয়ে রাখতো অথবা সাদি সালতানাত যদি উসমানীদের আনুগত্য মেনে নিত তাহলে হয়তো পৃথিবীর ইতিহাসে আমেরিকা হতে পারতো নতুন কোন মুসলিম সালতানাত। আমরা হয়তো ইনকা, মায়া এবং এজটেকদের সভ্যতা সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে পারতাম। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন শাখা হয়তো উন্মোচিত হতো তখন।
মুসলিমদের ভৌগলিক অবস্থান এবং শক্তি পর্যবেক্ষণ করে মার্কিন ঐতিহাসিক Marshall Hodgson যে উক্তিটি করেছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর দুনিয়াকে কেন্দ্র করে তা যদি আরও একশ বছর সেভাবে দুর্বার গতিতে ছুটতো তাহলে আজ হয়তো আমরা নতুন এক দুনিয়াতে বাস করতাম। হয়তো আজ আমেরিকার ভিন্ন এক ইতিহাস পঠিত হতো স্কুলের পাঠ্যবই গুলোতে।

কিন্তু আফসোস!! ইতিহাসের তিক্ত বাস্তবতার কারণে আজ আমরা তা থেকে বঞ্চিত।

পঠিত : ৯৯৯ বার

মন্তব্য: ০