Alapon

বাংলাদেশের চামড়া শিল্প থেকে পঁচা দুর্গন্ধ বের হওয়ার নেপথ্যে কারণসমূহ...


একটা সময় ছিল যখন আমরা স্কুলে রচনা পড়তাম ‘সোনালী আঁশ পাট’। স্কুলে এখনো সোনালী আঁশ পাট রচনা পড়ানো হয় কিনা আমি জানি না, তবে দেশের বাজারে আর সেই সোনালী আঁশ পাট দেখা যায় না। চাষীরা আর আগের মত পাট চাষ করে না। চাষ না করার কারণ ন্যায্যমূল্য না পাওয়া। আর এই সুযোগে বিশ্বের পাটের বাজার দখল করে নিয়েছে আমাদের পাশ্ববর্তি রাষ্ট্র ভারত।

যদিও স্কুলের রচনায় কখনো চামড়া নিয়ে কোনো রচনা পড়ানো হয় না, তবে দেশের অন্যতম রপ্তানি যোগ্য পন্য ছিল চামড়া। বিগত কয়েক বছরে চামড়া রপ্তানি করে দেশের অর্থনীতিতে কী পরিমাণ অর্থের যোগান হয়েছে সেদিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, দেশের অথনীতিতে চামড়ার কতটা গুরুত্ব! বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয় ১১৩ কোটি ডলার। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১১৬ কোটি ডলারে। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে এই আয়ের পরিমাণ আরও বেড়ে হয় ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

কিন্তু ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে রফতানি আয় অস্বাভাবিক কমে ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। ওই অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১২ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ১০১ কোটি ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এ ক্ষেত্রে আয় কম হয়েছে ৯ দশমিক ২৭ শতাংশ।

গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় কমেছে ৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে চামড়া খাত থেকে ৮৩ কোটি ৭১ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। যদিও এ সময়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯১ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। এ হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৯ শতাংশ এবং আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ আয় কমেছে।

এতো গেল বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর রিপোর্ট। এবার আমার দেখা অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমানে দেশে চামড়ার বাজারের কী অবস্থা তা তুলে ধরছি। আমরা এবার যে গরু কোরবানি করেছি, সেটার দাম ছিল ৭১০০০ টাকা। গরু জবাইয়ের পরে চামড়া ছিলানোর সময় আমরা সতর্কতার সাথেই ছিলিয়েছি, যেন ভালো দাম পাওয়া যায়। কিন্তু চামড়া ক্রেতারা চামড়া কিনতে এসে দাম বলল, ২০০ টাকা! এর ১ টাকাও বেশি দিতে তারা রাজি না। অগত্যা আমাদের সেই দামেই চামড়া বিক্রি করতে হল।

এরপর বলি ঈদের দ্বিতীয় দিনের অভিজ্ঞতা! দ্বিতীয়দিন সন্ধ্যায় বিলের পাড়ে ঘুরতে গিয়েছি। হঠাৎ বিলের এক কোনায় চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমরা সেদিকে এগিয়ে গেলাম। কাছাকাছি যেতেই কোনো কিছু পঁচে যাওয়ার একটা বোটকা গন্ধ নাকে এসে লাগল। তারপরও ঘটনা জানার জন্য এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, চামড়ার বেপারীরা ন্যায্য মূল্য না পেয়ে চামড়াগুলো বিলের পানিতে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে। সেগুলোরই পঁচে যাওয়া বোটকা গন্ধ!

বাংলাদেশের চামড়া শিল্প পঁচে গিয়ে এখন এমনই বোটকা গন্ধ বেরিয়েছে। আমাদের চামড়া শিল্প নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেশের অন্যতম জাতীয় পত্রিকা যুগান্তর ২৯ টি কারণ খুঁজে পেয়েছে। আসুন জেনে নেই, সেই কারণগুলো কী কী-

কারণগুলো হচ্ছে- ১. সঠিক পরিকল্পনার অভাব, ২. সাভারে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ কাজ শেষ না করে কারখানা স্থানান্তর করা, ৩. সাভারে ট্যানারিপল্লীতে অবকাঠামোগত সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করা, ৪. নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ ও সময়মত গ্যাস সংযোগ দিতে না পারা, ৫. লোডশেডিং, ৬. জেনারেটর ব্যবস্থা ভালো না হওয়া, ৭. সড়ক যোগাযোগে অব্যবস্থাপনা, ৮. চামড়া কাটার পর বর্জ্য কোথায় ফেলা হবে সেটি নির্ধারণ করতে না পারা, ৯. জমির দলিল হস্তান্তরসহ নানা বিষয় নিয়ে চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব, ১০. তিন বছরেও সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে প্রত্যাশা অনুযায়ী সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারা, ১১. কারখানা স্থানান্তরের পরও অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যেতে না পারায় রফতানি আদেশ বাতিল হয়ে যাওয়া, ১২. হাজারীবাগে ২০৫ টি কারখানা থাকলেও সাভারে মাত্র ১৫০টি প্লট বরাদ্দ দেয়া, ১৩. প্লট না পাওয়া ৫৪টি কারখানা বন্ধ হওয়ায় এসব কারখানার শ্রমিকদের বেকার হয়ে যাওয়া, ১৪. অবৈধ পথে চামড়া পাচার, ১৫. বিশ্ব বাজারের দরপতনে দেশের চামড়া শিল্পের অবস্থান আন্তর্জাতিক বাজারে দুর্বল হয়ে যাওয়া, ১৬. টানা কয়েক বছর ধরে চামড়া রফতানি আয় কমে যাওয়া, ১৭. আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পণ্যের আধুনিকায়নে সামঞ্জস্যতা না থাকা, ১৮. চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ, ১৯. বিশ্ববাজারে চামড়ার জুতার পরিবর্তে সিনথেটিক বা কাপড় জাতীয় জুতার আগ্রহ বৃদ্ধি, ২০. চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদন কমে যাওয়া, ২১. চামড়া শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে না তোলা, ২২. ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী কারখানার পরিবেশ উন্নত না করা, ২৩. চাহিদার তুলনায় ব্যাংক ঋণ না পাওয়া, ২৪. পুঁজি সংকট, ২৫. দক্ষ শ্রমিকের সংকট, ২৬. গতবারের চামড়া এখনো প্রক্রিয়াজাত করতে না পারা, ২৭. আগের বছরের সংগৃহীত কাঁচা চামড়ার গুণগত মান কমে যাওয়া, ২৮. নতুন চামড়া সংরক্ষণে স্থান সংকট এবং ২৯. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা।

এখনো হয়ত সময় আছে, চাইলেই এই শিল্পটাকে বাঁচানো যাবে! যদি পাটের মত চামড়ার বাজারও ভারতের হাতে ছেড়ে দিতে না চায় তাহলে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

পঠিত : ৩৫১ বার

মন্তব্য: ০