Alapon

মেয়েরা যত শিক্ষিত হচ্ছে ডিভোর্সের হার ততই বাড়ছে...


একটি কথা এখন খুব শোনা যায়, ‘মেয়েরা যত শিক্ষিত হচ্ছে ডিভোর্সের হার ততই বাড়ছে’। কথাটা বলার মাঝে কেমন যেন একটা নেতিবাচক সূর আছে। মানে বিষয়টি হচ্ছে পুরো ভিডিও না দেখে বা পুরো বই না পড়ে মাঝখানের একটা লাইন টেনে সমালোচনার ঝড় তোলার ট্রেন্ডের মতো। পুরো বিষয়টি খতিয়ে ভাবার ধৈর্য নাই আবার অনেকের ক্ষতিয়ে ভাবার মাথাটাই নাই… আর তার উপর কারণটি যদি হয় ‘নারী’, তাহলে তো কথাই নাই, বিনা দোষে ফাঁসি…

নারীর শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়ার সাথে ডিভোর্সের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার এই সমীকরণটি কখনও মিলিয়ে দেখেছেন?
একজন শিক্ষিত নারী, যিনি আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন, সেই নারী দুটো ভাত-কাপড়ের জন্য প্রতিনিয়ত স্বামীর চড়-থাপ্পড় সহ্য করবে না। চড়-থাপ্পড় স্বামীর আদর সোহাগের একটি অংশ ভেবে নিজের মন কে আর প্রবোদ দিবে না… এমন একটি বিষাক্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে এই নারী যখন বাহির হয়ে আসবেন, তখন দোষ পড়বে তার শিক্ষার। কারণ, ‘মেয়েদের একটু মানিয়ে নিতে হয়’ এই কথা আর ধোপে টিকবে না। ‘লেখা পড়া শিখলে মাইয়া সেয়ানা হইয়্যা যাইব’, মীনার ফুপু আম্মার এই কথাটিও আর যুক্তিতে খাটবে না।

আমাদের এখনকার সমাজে বহুল প্রচলিত আরও একটি প্র্যাকটিস হচ্ছে, প্রথম স্ত্রী-কে ঝুলিয়ে রেখে, দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে সংসার করা। ঝুলিয়ে রাখা অর্থাৎ, তাকে কোন প্রকার আর্থিক সহায়তা না করা আবার ডিভোর্সও না দেওয়া, কারণ ডিভোর্স দিলে পাছে আবার দেনমোহর পরিশোধ করতে হয়। জীবনে তখন চলে লারেলাপ্পা মজা!!! প্রথম স্ত্রীকে দেনমোহর পরিশোধ করতে হচ্ছে না, আর্থিক দায়িত্ব নিতে হচ্ছে না আবার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে জৈবিক চাহিদাও মিটে যাচ্ছে। আর এক স্ত্রী ঝুলায় রেখে অপর স্ত্রীর সাথে রংঢং করলে দোষ কি??? চাইর বিয়া তো করাই যাই… অন্যান্য অনেক ব্যাপারে আস্তাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ, এটা তো জাহেলি নিয়ম বলে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও, এই ‘ঈলা’ নামক প্রথার (প্রথম স্ত্রীর দায়িত্ব না নিয়ে বা ডিভোর্স না দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা) মতো নিকৃষ্ট জাহেলি প্র্যাকটিস নিয়ে মাওলানারা খুব কম-ই মুখ খুলেন। জেনে রাখা ভাল, বৈবাহিক জীবনে এই ধরণের চর্চা, ইসলামি শরিয়া মোতাবেক একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমন একটি অবস্থায় প্রথম স্ত্রী না পারেন নতুন জীবন শুরু করতে, না পারেন বর্তমান স্বামীর সাথে স্বাভাবিক ভাবে সংসার করতে। সেই ক্ষেত্রে এই নারী বর্তমান স্বামী-কে ডিভোর্স দিবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরিসংখ্যানে এই নারীর ডিভোর্সের সিদ্ধান্তটি গণা হবে নারী শিক্ষার কারণ হিসেবে।

যেই নারী শিক্ষিত এবং আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী, সেই নারী দিনের পর দিন যৌতুকের দাবীতে, স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির মানুষের গালমন্দ, অত্যাচার, নির্যাতন সইবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দিন শেষে এই জুলুম থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার দোষটাও আবার পড়বে নারী শিক্ষার। কারণ ওই যে…’লেখাপড়া শিখলে মাইয়ারা সেয়ানা হইয়্যা যায়’…

বিবাহ পরবর্তী সেক্সুয়াল এবিউস অথবা যৌন অক্ষমতা সম্পন্ন স্বামীর জন্য সারা জীবন নিজেকে বাজা বা বন্ধ্যা হিসেবে গালমন্দ শুনতে না চাওয়া নারী যখন ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেন, তখন দোষ পড়ে নারী শিক্ষার। যৌন অক্ষমতা সম্পন্ন সেই সব স্বামীর কথা আমি বলছি, যারা ইগো-র ঠেলায় চিকিৎসা করাইতে চান না, কিন্তু নিজের স্ত্রীর ক্ষেত্রে বাজা/বন্ধ্যা শব্দ গুলো শুনতে তাদের কোন আপত্তি নাই।

শিক্ষা প্রতিটি মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষা মানুষকে বিবেক সম্পন্ন করে, স্বনির্ভর করে। শিক্ষার তাৎপর্য নারী এবং পুরুষের ক্ষেত্রে কেন ভিন্ন ভাবে বিবেচিত হবে? প্রতিটি মানুষের (নারী/পুরুষ) বিষাক্ত পরিবেশ থেকে নিজেকে উদ্ধার করার অধিকার আছে। প্রতিনিয়ত নিজের প্রতি অন্যায় সহ্য করে ‘সর্বংসহা’ টাইটেলে নিজেকে ভূষিত করাও একটি পাপ, কারণ অন্যায় করা এবং সহ্য করা দুটোই অপরাধ।

ডিভোর্সের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া কোন সমাজের জন্যই কাম্য নয়। সেই ক্ষাত্রে নারী পুরুষ উভয়কে হতে হবে সহনশীল এবং উভয়ের মাঝে উভয়ের জন্যই থাকতে হবে সম্মানবোধ। ঢালাও ভাবে নারী শিক্ষাকে দায়ী করার আগে, ভেতরের কারণ গুলো খুঁজে দেখেছেন কি? সেখানে নারী কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন? বা পুরুষ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন? সব মিলিয়ে যৌক্তিক আলোচনার জায়গা বা সমাধান খোঁজা হচ্ছে কি?

যারা নেতিবাচক অর্থে বিশ্বাস করেন নারী শিক্ষাই মূল কারণ, তাহলে সমাধান একটাই, নিজের কন্যা সন্তানটি কে শিক্ষিত কইরেন না, পাছে আবার সংসার না ভেঙ্গে যায়…

পুনশ্চ: এই লেখাটি শুধুমাত্র ডিভোর্স এবং নারী শিক্ষার তথাকথিত সমীকরণ নিয়ে লেখা। তাই দয়া করে আশা করবেন না, ‘আফা, এইটা তো বললেন, ওইটা তো বললেন না’। আজকে এইটাই বলতে এসেছি, ওইটা হয়তো অন্য কোন দিন বলব!

পঠিত : ৭০৯ বার

মন্তব্য: ০