Alapon

কাশ্মীর নিয়ে কোণঠাসা ভারত



ভারত কাশ্মীর সমস্যা সমাধান হিসেবে একতরফাভাবে যে সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছিল, ২০২০ সালের ৫ আগস্ট ছিল তার প্রথম বর্ষপূর্তি। ভারত সরকার ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসন দেয়া ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করে। পাশপাশি রাজ্যটিকে দুই খণ্ডে ভাগ করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার ফলে জম্মু ও কাশ্মীর পরিস্থিতির চরম পরিবর্তন হয়েছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার ক্ষমতাসীন দল বিজেপির জন্য ভারত-অধিকৃত কাশ্মীর হলো দিল্লী শাসিত ভারতীয় ইউনিয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখন বাকি যা করার আছে তা হলো জম্মু ও কাশ্মীরের বাকি অংশ, যা আজাদ কাশ্মীর, গিলগিট-বাল্টিস্তান ও চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকা লাদাখের অংশবিশেষ দখল করা।

কিন্তু মোদির স্বপ্ন যথাযথভাবে কাজ করছে না। বিশ্ব ও জাতিসঙ্ঘ কমবেশি নীরব থাকলেও কাশ্মীরীরা, সীমান্তের উভয় পাড়ের, পাকিস্তানিরা এবং এমনকি ভারতীয় লোকজন পর্যন্ত ব্যাপক প্রতিবাদ করছে।

৫ আগস্ট থেকে ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরে পুরোপুরি লকডাউন চলছে কাশ্মীরীদের প্রতিবাদ বন্ধ করতে। কাশ্মীরী সরকার ও পার্লামেন্টের বেশির ভাগ সদস্যসহ এই অঞ্চলে প্রায় চার হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। লকডাউনের মধ্যে রয়েছে টেলিফোন, মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগ পুরোপুরি বন্ধ করা, ভারতীয় ও বিদেশী সাংবাদিকসহ কারো যাতায়াত অনুমোদন না করা।

এছাড়া বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে হাজার হাজার সৈন্যও পাঠিয়েছে ভারত। তারা প্রবল কারফিউ জারি করেছে। স্কুল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে রয়েছে। কিন্তু তারপরও নয়া দিল্লীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাজপথে বিক্ষোভ হচ্ছে। শ্রীনগরে পাথর নিক্ষেপকারী স্থানীয় লোকজনের ওপর কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে নিরাপত্তা বাহিনী। লোকজনের চলাচলের ওপর কর্তৃপক্ষ কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ ও যোগাযোগ বন্ধ করা সত্ত্বেও বিক্ষোভ প্রদর্শন বন্ধ হয়নি। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা করে কাশ্মীরী মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছে।

২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি রয়টার্সের খবরে বলা হয়, কাশ্মীরে এখনো ইন্টারনেট সার্ভিস পুরোপুরি চালু না হওয়ায় ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য নিকটস্থ বানিহালে যেতে হয়। এ জন্য তারা গাদাগাদি করে যাতায়াত করা ট্রেনটির নাম দিয়েছে ইন্টারনেট এক্সপ্রেস।

কলমের এক খোঁচায় ভারত সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচিত সরকারকে খারিজ করে দিয়েছে। এই ক্যুয়ের মাধ্যমে কাশ্মীরী রাজনীতিবিদদের গৃহবন্দী করা হয়েছে। এগুলো করা হয়েছে জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাব এবং ১৯৭২ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সিমলা চুক্তি লঙ্ঘন করে। এতে কেবল এ কথাই বোঝা যায়, বিজেপি আত্মবিশ্বাসী যে তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে, দুনিয়ার কেউ তাদেরকে বাধা দিতে পারে না। এ ধরনের পদক্ষেপ ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ’ হিসেবে পরিচিত ভারতীয় গণতন্ত্রের আসল অবস্থাই প্রকাশ করছে।

অবশ্য, এতে মনে হচ্ছে, মোদি সম্ভবত খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন, তিনি হয়তো এর ফলে দম বন্ধ করা অবস্থায় পড়ে গেছেন।

কাশ্মীর উদ্যোগ ছাড়াও বিজেপির ফ্যাসিবাদী ও বর্ণবাদী কর্মসূচিতে আরো অনেক বিভেদসূচক পদক্ষেপ রয়েছে। মুসলিম ও খ্রিস্টানদের হিন্দু ধর্মে আবার ধর্মান্তরিত করার জন্য ঘর ওয়াপসি আন্দোলন চলছে। ভারতীয় মুসলিমদের নাগরিক মর্যাদাকে টার্গেট করে আরো কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।

কাশ্মীরীদের আইন মানতে বাধ্য করার জন্য ৫ লাখের বেশি সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে কাশ্মীরে। কয়েক বছর ধরে কাশ্মীর পরিণত হয়েছে উন্মুক্ত কারাগারে। অতি সাম্প্রতিক সময়ে দাদার মৃতদেহের ওপর তিন বছরের নাতিকে বসে থাকার দৃশ্য দেখে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলটিতে ক্রোধের সৃষ্টি হয়।

তরুণ কাশ্মীরীদের অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার কথাও আসছে। নতুন একটি গৃহযুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে। সহিংসতা প্রত্যাখ্যানকারী নাগরিকেরা ক্রসফায়ারে পড়ে যাচ্ছেন। প্রত্যেকের স্বাভাবিক জীবনে বিঘ্ন ঘটছে। কোয়ালিশন অব সিভিল সোসাইটির হিসাব অনুযায়ী, ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে ৩২ জন বেসামরিক নাগরিকসহ অন্তত ২২৯ জনের মৃত্যু ঘটেছে গত ছয় মাসে।

এদিকে কাশ্মীরের বাইরে থেকে লোকজনকে কাশ্মীরে বসতি স্থাপনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। ১৮ মে থেকে এ পর্যন্ত ২৫ হাজার লোককে ডোমিসাইল সনদ দেয়া হয়েছে। এর ফলে এসব লোক কাশ্মীরে স্থায়ীভাবে বাস করতে পারবে, সরকারি চাকরি গ্রহণ করতে পারবে। অথচ এসব সুবিধা কেবল কাশ্মীরীদের জন্যই নির্ধারিত ছিল।

চীন, নতুন ফ্যাক্টর
চলতি বছরের জুন থেকে তুলনামূলক নতুন খেলোয়াড় হিসেবে চীনের আবির্ভাব ঘটেছে। লাদাখ নিয়ে তারা সরব হয়েছে। এর আগে তারা নীরবতা পালন করে আসছিল। চীনকে থামাতে পারছে না ভারত।

নেপালের সাথেও ভারতের সমস্যা হচ্ছে। লিপুলেখ পাসের ওপর দাবি জোরালো করেছে নেপাল। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক অবনতি ঘটছে।

এখানেই শেষ নয়। ইরানের চাবাহার রেল প্রকল্প থেকে ভারতকে বাদ দিয়েছে দেশটি। তারা এখন চীনের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। চাবাহার বন্দরটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশে পরিণত হবে।

কাশ্মীর সমস্যা একতরফাভাবে সমাধানের জন্য ভারত যে পদক্ষেপ নিয়েছে, কাশ্মীরীরা তার মূল্য দিচ্ছে। ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরের জন্য এটি নতুন জটিলতার সৃষ্টি করেছে। অদূর ভবিষ্যতে কোনো সমাধান দেখা যাচ্ছে না। মোদির মুসলিমবিরোধী আগ্রাসী নীতির ভিত্তি হলো অখণ্ড ভারত। কিন্তু সেটিই দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে নিঃসঙ্গ করে ফেলছে। আর সব মিলিয়ে ভারত তার ঐক্য ও অখণ্ডতার ব্যাপারে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এটি ভারতের অর্থনীতির ওপর নিশ্চিত প্রভাব সৃষ্টি করবে।

পঠিত : ৬৮১ বার

মন্তব্য: ০