Alapon

মঙ্গলদের উত্থান থেকে চেঙ্গিস খান...


উত্তরে ঠান্ডা সাইবেরিয়া, দক্ষিণে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে চীনের মহা প্রাচীর। একদিকে পামির মালভূমি আর অন্য পাশে দূরে রয়েছে সাগর। চারদিকে পাহাড়, চীন সিমান্তের গোবি নামক বালির সমুদ্রের ওপাশে ভাগ্যের অন্বেষণে ছুটে চলা কিছু মানুষ ৯০৭ খৃষ্টাব্দে মূলত পশু পালনের মাধ্যমেই যাযাবর জীবন বেঁছে নেয়। ধারণা করা হয় এরা মূলত চীনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক কারণে পালিয়ে আসা ভাগ্যহত মানুষ।

জায়গাটার নামকরন করা হয় খিতান লিয়াও। পশু পালনকারী সমাজগুলোর মতই খুব দ্রুতই এই খিতানের লোকজন সংখ্যায় বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথেই নিজেদের মাঝে স্বার্থের দ্বন্দ্বও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। ফলাফল, যে যার মত আলাদা গোত্র বানিয়ে জীবন যাপন করতে থাকে। তাই দেখা যায় খুব দ্রুতই নতুন আরেক শাসক গোত্র গোরিও জন্ম নেয়। আঞ্চলিক আধিপত্য বিষয়টি যেন মানুষের অস্তি মজ্জার সাথে মিশে আছে। থাকবেইনা কেন। সবার মাঝে মিল থাকলেত আর আলাদা হতে হয়না। আলাদা যেহেতু হয়েছেই এখনতো সিল্ক রোডের বাণিজ্য সুবিধা, পশুর জন্য আদর্শ জায়গা, নিজেদের বাসস্থান ও শিকার সুবিধার আঞ্চলিক আধিপত্য না থাকলেতো আর টিকা যায়না। ফলে ৯৯৩ সালে গোরিও ও খিতানরা নিজেদের শক্তি পরীক্ষা করতে গোয়ালিং নদীর তীরে একে অপরের উপর ঝাপিয়ে পরে।

শক্তি পরীক্ষা শেষে লিয়াওরা এবার খিতান থেকে মহান লিয়াওয়ে পরিণত হয়। যেহেতু নিজেরা মহান তাই আসপাশে পুছকে নেংটি ইদুররা থাকলে কেমন দেখায়? লিওয়ারা এমনটাই ভেবেনিল এবং পার্শবর্তী সুসভ্য চীনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কথায় আছে, পিপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। ঠিক তেমনি নতুন গজিয়ে উঠা মঙ্গোলরা জিন রাজবংশের হাত থেকে কেড়ে নিতে। ফলাফল, জিননদের ডান্ডা খেয়ে অবধারিত পরাজয়কে বুকে ধরে লিওয়াওরা চীন সীমান্ত ছেড়ে তিয়ানশান পাহাড়ের পাদদেশে নিজেদের নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তুলল। নাম দেয় পশ্চিম লিয়াও।

খিতান ছেড়ে লিয়াওরা চলে গেলেও বহু সংখ্যক মঙ্গোল যাযাবর জীবনকেই বেঁছে নেয়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে চৈনিক সিল্করোড হয়ে নিজেদের পশু থেকে উৎপাদিত পন্য আমদানি রপ্তানি ছিল যেমন সোজা ঠিক তেমনি পশ্চিম লিয়াও থেকে তিয়ানশান পাহাড় ডিঙ্গিয়ে তেজারতি বড্ড কঠিন বিষয়। তবে এবার আর একত্রে নয় বরং বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করতে থাকে। কিন্তু আধিপত্যের লড়াই কি এত সহজে থামে? থামে না। অবশেষে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কাবুল খান সমগ্র মঙ্গোল গোত্রগুলোকে ডেকে একত্রিত করার চেষ্টা করলেন। লিয়াও সাম্রাজ্যের পর আবারও নতুন করে আঞ্চলিক নামকরণ করা হল খাগান মঙ্গোল বা মঙ্গোল যুক্তরাজ্য।

সব কিছু ঠিক থাকলেও সমস্যা দেখাদিল আরেক জায়গায়। লিয়াও সাম্রাজ্যের সময় থেকেই মধ্য এশিয়ান তাতাররা এ অঞ্চলে বেশ দাপটের সাথেই বসবাস করছিল। নতুন মঙ্গোল রাষ্ট্র গঠিত হলেও তাতাররা উপেক্ষিতই থেকে গেল। ক্ষোভ জমলে তার বিস্ফোরণ ঘটবেই এটাই স্বাভাবিক। তাতারাও আর বসে না থেকে নবগঠিত রাষ্ট্রের উপর হামলে পড়ল আর তাতে বাতাস দিল পুরাতন শত্রু জিন রাজবংশ। তাতার বিজয়ী হলেও এবার মঙ্গোল তাতার মিলে মিশে হয়ে গেল মঙ্গোলিয়া। নির্বাচিত কেন্দ্রীয় সরকার থাকলেও গোত্রগুলোর আভ্যন্তরীণ সংকট উত্তরনে কেন্দ্রের ভূমিকা রাখার সুযোগ তেমন ছিলনা বললেই চলে। ফলে গোত্রগুলোর আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ক্রমশই বাড়তে থাকে।

১১৬২ সালের মাঝামাঝি সময়ে মঙ্গোলিয়ার সর্বাপেক্ষা পুরাতন কেরাইত গোত্র যাকে মহান কাবুল খানের বংশধর হিসেবেও অনেক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, সেই গোত্রের গোত্রপ্রধান ইয়াসুগি ও ওলানের কোল জুড়ে আসে নতুন শিশু। ডান হাতে রক্তজমাট জন্মদাগ থাকায় কয়েকজন পুরোহিত ছেলের মাঝে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের আলো দেখতে পান। তাই বাবা আদর করে নাম রাখলেন, তেমুজিন (কামার/বজ্রমুষ্ঠি)।
পাহাড়, উপত্যকায় দস্যি ছেলেদের মত চষে ফিরলেও জীবনের রঙ পরিবর্তিত হতে বেশিদিন লাগেনি। ৯ বছর বয়সে বাবার সাথে নতুন দিনের আগমনে রওনা হলে, এ যাত্রাই যে হবে তেমুজিনের জীবন পরিবর্তনকারী যাত্রা তা হয়ত নিজেও জানতোনা। আরেক গোত্রের প্রধানের সাথে দুই বাবাই সম্মতি দেন যে, কেরাইত গোত্রের ইয়াসুগির ছেলের হাতেই ‘অরকনোদ’ গোত্রের দেই সেচেনের মেয়েকে তুলে দিয়ে নিজেদের ঘনিষ্ঠতা আরও বৃদ্ধি করা হবে। তবে দেই সেচেন চান ১২ বছর না হওয়া পর্যন্ত তেমুজিন যেন তার কাছেই থেকে যায়, সময় হলে জামাই বউ মিলে আপন গোত্রে ফিরে যাবে। বিধি বাম, ছেলেকে রেখে বাড়ি ফেরার পথে তাতারদের খাবারে মিশানো বিষ খেয়ে ইয়াসুগির মৃত্যু হয়।

জীবনের শুরুতেই তেমুজিন যেন বড় ধরণের এক ধাক্কা খেল। হবু শ্বশুর বাড়িতে আর থাকা হলোনা, আপন গোত্রে তাকে ফিরতেই হল। ১৬ বছর বয়সে অর্তে কে শ্বশুর বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসলেও সুখ তার কপালে যেন শোকের নামেই এসেছিল। বাসর রাত সকাল না হতেই পার্শবর্তি শত্রু গোত্র আক্রমণ করে হত্যা, লুন্ঠন ও অগ্নিসংযোগতো করলই, সেই সাথে অরতেকেও তুলে নিয়ে গেল, গোত্র নেতার বউ থেকে এবার হল অন্যের লালসার দাসী।

প্রতিপক্ষ শক্তিশালী, তাদের সাথে একা পারা যাবেনা, তাই বন্ধু জামুইকাকে সাথে নিয়ে বাবার পুরাতন রক্তে পাতানো ভাই কেরেইত গোত্রপ্রধান তগ্রুল খানের দরবারে হাজির হন। উপহার হিসেবে সাথে নিয়ে যান ফুলশয্যার রাতের জন্য প্রাপ্ত দামি চামড়ার কম্বলটি। সব শুনে তগ্রুল খান যখন চুপ করে ছিলেন, ঐতিহাসিকগণ বলেছেন এই সময়টি ছিল তেমুজিনের জন্য অত্যন্ত টার্নিং পয়েন্ট। তগ্রুল খান যদি তাদের ফিরিয়ে দিতেন তবে তেমুজিনের ইতিহাস এখানেই শেষ হয়ে যেত। অবশেষে রক্তে পাতানো ভাই হত্যার প্রতিশোধ নিতে তগ্রুল খান, তেমুজিন ও জামুইকা সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে প্রায় চারমাস পর স্ত্রীকে উদ্ধার ও প্রতিশোধ নেয়।

দিকে দিকে তেমুজিন ও জামুইকার না চারদিকে ছড়িয়ে পরে। জামুইকা বুঝতে পারে তেমুজিনের সাথে থাকলে তার ছায়া হয়েই থাকতে হবে, তগ্রুল খান মৃত্যু বরণের পর তার আর নেতা হওয়ার সুযোগ থাকবেনা। তাই যে তেমুজিনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যায়। তেমুজিন তাকে নিজেদের মাঝে রক্তে পাতানো রক্ত শপথের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও রুখতে পারেনি। খান (রাজার উপাধি) মৃত্যু বরণ করলে নতুন খান নির্বাচনের আগেই নিজের পক্ষের গোত্রগুলোকে নিয়ে তেমুজিন প্রভাবিত গোত্রগুলোর উপর জমুইকা নির্মম আক্রমণ চালায়। জীবিত বন্দিদের সে ফুটন্ত পানিতে চুবিয়ে সেদ্ধ করে হত্যা করে।

একদিকে জামুইকার সাহস ও যুদ্ধক্ষেত্র নিরীক্ষণের অসম্ভব ক্ষমতার কারণে তার বিরুদ্ধে দাড়ানোর সাহস কোন গোত্রই করছিল না। সময়টি চলছিল সত্যিই এক মনস্তাত্যিক যুদ্ধের আর সে যুদ্ধের উভয়ের নিজের তুনিরের শেষ তীরটি ব্যাবহারে ছিল বদ্ধপরিকর। জামুইকাকে যে কোন মূল্যে থামাতেই হবে অন্যথায় এ এশিয়ান স্তেপ অঞ্চলে জামুইকার রক্তনীতির হাত থেকে কেও রেহায় পাবেনা। তেমুজিন সকলকে বুঝাতে পারলেন এককভাবে থাকলে একে একে সকলকেই জামুইকার শিকারে পরিণত হতে হবে। তাই সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জামুইকার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে।

মনস্তাত্বিক যুদ্ধের এ পর্যায়ে এসে তেমুজিন এক নতুন চাল চাললেন। তিনি প্রথাগত মঙ্গোল এলোপাতাড়ি আক্রমণ পন্থা বাদ দিয়ে বরং নতুন পন্থা গ্রহণ করলেন। সেনাপতি সুবুতাই ও জেবের নেতৃত্বে গড়ে তুললেন সুশৃঙ্গল তীরন্দাজ (যারা ঘোড়ায় চড়েও নিখুত নিশানা ভেদ করতে পারত) বাহিনী ও বর্ষা বাহিনী। পদতিক বাহিনী না রেখে শুধুমাত্র অশ্বরোহী বাহিনীই গঠন করেন যা ইতিহাসে চেঙ্গিস খানের অশ্বারোহি বাহিনী নামে পরিচীত।

প্রস্তুতি শেষে এবার যুদ্ধ যাত্রায় গিয়ে আবারো জামুইকার মনস্তাত্বিক যুদ্ধের সম্মুখিন হলেন। ভেবেছিলেন রাতের আধারেই জামুইকাকে পরপারের টিকিট ধরিয়ে দিবেন কিন্তু জামুইকা তার বাহিনীকে আদেশ করল প্রতি সৈন্যের অনুপাতে ১/৫ হারে আগুন জালিয়ে রাখো যেন বুঝা যায় বিস্তির্ণ অঞ্চল জুড়ে মূলের চেয়ে ৫গুণ সেনা রয়েছে এবং সবাই আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রস্তুত।

রাতে যেভাবে তেমুজিন বোকা বনে গেলেন বন্ধুর বুদ্ধিতে ঠিক তেমনি সকালে জামুইকা তার প্রথাগত মঙ্গোল বাহিনী নিয়ে এগিয়ে এসে দেখে সেকশন বাই সেকশন হাজার হাজার সৈন্য প্রায় অর্ধ মেইল জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে যা জামুইকার কাছে ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। দাম্বিকতার অহংকার যখন কাওকে অন্ধ করে তোলে, ভাল মন্ধ বুঝবার ক্ষমতা তার আর থাকে না। জামুইকারও হয়েছিল একই অবস্থা। তাই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সারিবদ্ধ সেনদলকে পুরাতন এলোপাতারি আক্রমণ যে একেবারেই আত্মহত্বার সামিল তা জেনে বুঝে জামুইকা সর্বাত্মক আক্রমণ করে বসে। যদিও তেমুজিনের প্রশিক্ষিত সেনাদের তীরন্দাজীতে ছুটে আসা ফ্রন্ট লাইন ভাঙ্গে পরছিল কিন্তু তেমুজিন জানত একটু পরেই দুই সেনা যখন সর্বাত্মক আক্রমণ করে একত্রে মিশে যাবে তখন আর তীর ছোড়া যাবেনা, লম্বা বর্শা তখন হিতে বিপরীত হতে পারে। আর এই একটু সুযোগেই জামুইকা তার রিজার্ভড বাহিনী দিয়ে রণক্ষেত্রে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে। জামুইকাকেতো তেমুজিনের চাইতে অধিক কেও চিনেনা।

তেমুজিন জানতো যে কোন মূল্যে জামুইকার রিজার্ভ ফোর্সকে রণক্ষেত্র থেকে দূরে রাখতে হবে তাই ডানের অশ্বারোহীদের পাহাড়ের গিরিপথে পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তেমুজিনের সেনারা পালাচ্ছে দেখে জামুইকা তার রিজার্ভ ইউনিটকে আদেশ দিল যেন পলায়নপর সৈন্যদের হত্যা করে পিছন থেকে আক্রমণ করে। জামুইকা জানতোনা তেমুজিন আগে থেকেই তার শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজদের দিয়ে এক ফাঁদ পেতে রেখেছে। টার্গেটে আসতে যা বাকী, অগ্রগামী রিজার্ভ ফোর্স অল্পক্ষণেই একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেল। আর এই ফাঁকে তেমুজিন নিজের রিজার্ভ কাজে লাগিয়ে জামুইকার শেষ ভরসার নিঃশেষ করে দিল। পলায়ন ছাড়া জামুইকার আর উপায় রইল না।

প্রায় অনেক মাস লুকিয়ে থাকার পর জামুইকা নিজের দুই সেনাপতির কাছেই গ্রেফতার হয়। বড় ইনামের আশায় জামুইকাকে তারা তেমুজিনের সামনে হাজির করলে দুই সেনাপতিকেই হত্যার আদেশ দেয়া হয়। তেমুজিন জামুইকাকে নিজেদের রক্ত শপথের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আবারো দুই বন্ধু মিলে মঙ্গোলিয়া গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করলে জামুইকা বলেঃ
“এক আকাশে সূর্য একটিই থাকে, এক পৃথিবীতে রাজা একজনি হয়”

সুতরাং বন্ধুত্বের চাইতে মৃত্যুকেই জামুইকা গ্রহণ করে নেয়। জামুইকার পর তেমুজিনের আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় সকলে মিলে তেমুজিনকেই মঙ্গোল খান হিসেবে মনোনিত করে। খান হওয়ার পর তেমুজিন হারিয়ে যায় ইহিহাসের অতল গহব্বরে, কারণ লোকেরা তাকে আদর করে নাম রাখে

- Sadik

পঠিত : ৪৬৬ বার

মন্তব্য: ০