Alapon

যোগ্য লোক অলস হলে কূটচালে অভ্যস্ত হয়...


যোগ্য লোক অলস হলে কূটচালে অভ্যস্ত হয়। কূটচালে দক্ষ মানুষদের কুটিল বলে। মানুষের কুটিল স্বভাব সৃষ্টির পিছনে প্রধানত অলসতাই দায়ী। এধরনের মানুষের ধান্ধা থাকে কিভাবে অতি সহজে ধনী হওয়া যায়। অনৈতিক হলেও, কম বিনিয়োগে বেশী মুনাফার ব্যবসায়ের প্রতি তাদের আগ্রহ বেশী। অবৈধ কাজ হলেও, কম কষ্টে বেশী সফলতা অর্জন করা যায়, এমন কর্মের প্রতি তাদের ঝোঁক প্রবল। স্বল্প সময়ে ব্যাপক প্রাচুর্য অর্জন করার মানসিকতার কারণে, তারা সকল শ্রেণীর মানুষকে বন্ধু বানাতে পারে। পদবীর সাথে মানানসই না হওয়া স্বত্বেও উপরোক্ত মানুষের নিকট থেকে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা নিতে কখনও পিছপা হয়না।

ইংরেজিতে কূটচালকে Manipulation বলে। যার অর্থ দক্ষতার সাথে হস্তচালনা করা। শব্দের এই অর্থের দ্বারা দক্ষ শ্রমিকের কৌশলী হাতের কথা বুঝায় নি। নেতিবাচক অর্থে বুঝিয়েছে। আর কুটিল মানুষকে ইংরেজিতে বলা হয় Crooked Person তথা কূটবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। বর্তমান সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থাটি এমন, একজন ব্যক্তি অলস হলেও লেখাপড়া করে যোগ্য হতে পারে। সনদ দেখিয়ে এমন ব্যক্তিও কোন প্রতিষ্ঠানে ভাল চাকুরীও জুটিয়ে ফেলতে পারে। আগেকার দিনে অধ্যবসায়ী ও কঠোর পরিশ্রমী ব্যক্তিরাই যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন। যিনি প্রধান সেনাপতি তিনি যুদ্ধ কিংবা কুস্তিতেও প্রধান বিবেচিত হতেন। সে সমাজে অলসের জন্য কোন স্থান ছিলনা।

প্রতিষ্ঠানে কুটিলতার বিস্তার যেভাবে হয়

অলসতা মানবজীবনের এমন এক বাজে বদগুণ, যার কাছে এর ছিটো-ফোটা থাকে, সে আর মানবিক ইজ্জত, মর্যাদা নিয়ে দুনিয়ার জীবন পার করতে পারেনা। একই শিক্ষাগত যোগ্যতার একজন অলস মানুষ ও একজন কর্মঠ মানুষের মধ্যে যোজন দূরত্ব তফাৎ দেখা যায়। ব্যক্তিজীবনে যোগ্যতাসম্পন্ন অলস মানুষ যত বড় পজিশনেই যায় না কেন। সে তার যোগ্যতা দিয়ে প্রশাসনের ফাঁক-ফোঁকর কোথায় আছে, তার সন্ধানে ব্যস্ত থাকে। সুযোগ নিয়ে প্রশাসনের প্রতিটি দুর্বলতাকে শতভাগ কাজে লাগায়। অফিসে দেরী করে আসা, তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া। একেবারেই অফিস না করে ফাঁকি দেওয়া। চেয়ারে পোশাক টাঙ্গিয়ে রেখে, নিজের ব্যক্তিগত কাজে বাইরে চলে যাওয়া, এসব কুটিল মানুষের স্বভাব-চরিত্র। এটা চরম নির্লজ্জ কাজ হওয়া স্বত্বেও এরা সাধারণের সামনে নিজের চৌর্যবৃত্তিকে গৌরবের সাথে উপস্থাপন করে। অধিকন্তু চক্ষু-শরমকে মাথা খেয়ে, অফিসের অন্যান্য কলিগদের উদ্দেশ্যে তার দুর্বলতাকে বুদ্ধিমত্তা হিসেবে বর্ণনা করে। তারা লোভনীয় বাক্যে বলতে থাকে, এই চাকুরীর টাকায় আর দিন চলেনা, তাই সামান্য সময়ের জন্য বাহিরে গিয়ে অনেক টাকার ধান্ধাটা করে আসলাম! এর ফলে অন্যরাও তার কর্ম ও সাফল্য জানতে উৎসাহিত হয়। এর দ্বারা অন্যরা বুঝতে শিখে এভাবে সময় সুযোগ কাজে লাগানো যায়। একজন অলস কর্মকর্তা এভাবেই প্রতিষ্ঠানে কুটিলতার বিস্তার ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠানকে ক্ষণভঙ্গুর করে তুলে।

অলস কর্মকর্তার কুটিল হবার পিছনে

অলস কর্মকর্তা যোগ্যতাকে ধারালো করতে পারেনা ফলে তাদের প্রমোশনে গতি পায়না। ফলে এসব মানুষ পরশ্রীকাতর হয়ে পড়ে। তারা যোগ্যতাকে শানিত করার পরিবর্তে, উপরস্থ কর্মকর্তাদের কানভারী করার কাজে লেগে পড়ে। অলস জানে তার অগ্রগতি হবে মন্থর তাই পরশ্রীকাতরতার কারণে সে অন্যের অগ্রগতির অন্তরায় হয়ে উঠে। সে সর্বদা অন্যের পিছনে লেগে থাকাকেই নিজের জন্য কর্তব্য বানিয়ে নেয়। তবে, এই কাজের জন্য চাই কিছু প্রস্তুতি ও করণীয়। তার আশে পাশের কর্মকর্তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি গুলোর তথ্য উপাত্ত সে সংগ্রহ করতে থাকে। মানুষের ভুলের পিছনে তার চোখ জোড়া কিলবিল করতে থাকে। এই কাজে আঞ্জাম দিতে তাকে কোন বড় প্রকৃতির গোয়েন্দা হতে হয়না। কোম্পানির জন্য একজন নিবেদিত প্রাণ কর্মীর সম্ভাবনার গতিকে স্তব্ধ করে দেবার জন্য, সামান্য উপাত্তই যথেষ্ট। কোন একদিন অফিসে ঘুমিয়েছিল কিংবা কিছুদিন দেরী করে অফিসে পৌঁছেছে এমন তথ্য একজন চৌকশ কর্মকর্তার প্রমোশন তো বাদ, উল্টো ডিমোশন হবার জন্য যথেষ্ট হয়ে যেতে পারে। কুটিল মানুষগুলো সে কাজের মাল-মসল্লা সাপ্লাই দাতার কাজ করে। পাশে ঘাপটি মেরে থাকা কুটিল প্রকৃতির মানুষটির জন্য এই কাজ অনেক সোজা।

প্রতিষ্ঠানে অল্পশিক্ষিত কর্মচারী কুটিল হলে

অল্পশিক্ষিত অলস মানুষগুলো চাটুকার হয়। অফিসে তাদের দৌরাত্ম্য অনেক প্রবল। এসব মানুষ পিয়ন হলে প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ হয়ে উঠে। তাদের কাজ হল অফিসের প্রশাসনিক কাজের ক্ষুদ্র ছিদ্রগুলোকে কায়দা করে বড় করে তোলা। বড় অফিসারকে লোভ লাগানো এবং অবৈধ আয়ের রাস্তাগুলো বারে বারে চিনিয়ে দেওয়া। কোন বাজারে সস্তায়, তাজা বড় মাছ-মুরগী পাওয়া যায় তার খবর সরবরাহ করা। বড় কর্তাদের সর্বদা বাজারে যাওয়া কঠিন। পিওন এসব বাজারী তথ্য দিয়ে কাজটি নিজে করিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখায়। বসের জন্য এটা বিরাট সহযোগিতা। আর পিয়নের লক্ষ্য থাকে কোন ছল-ছুতোয় বসের গিন্নী পর্যন্ত পৌঁছা! গিন্নীর কানে সেসব কথা জানিয়ে দেওয়া, বস কোন কাজটি কিভাবে করলে সহসা অনেক অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়া যায়। নির্লোভ গৃহিণী হলে তো বাঁচে। নতুবা এই গৃহিণী কর্মকর্তা স্বামীর জন্য এক স্থায়ী আপদে পরিণত হবে! গিন্নীই সেই তাকে শ্রেষ্ঠ ঘুষখোর কর্মকর্তা বানিয়ে ছাড়বে আর পিওন হবে তার পাহারাদার। পরিনতিতে এ ধরণের ব্যক্তিদের হাতেই উল্টো পুতুল নাচের সুতার নিয়ন্ত্রণ চলে যায়। সেই সব কিছু Manipulate করা শুরু করে। তাই প্রতিষ্ঠানের ছোট কর্মকর্তা বলে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। একজন চৌকশ কুটিল কর্মচারী পুরো প্রতিষ্ঠানের নিয়মনীতি ভেঙ্গে দেবার জন্য একাই যথেষ্ট।

কর্মঠ মানুষ সদা ভাগ্যবান হয়। কর্মঠ মানুষের জীবনে ধৈর্যের অবদান বেশী। পৃথিবীতে একমাত্র কর্মঠ অধ্যবসায়ীরাই সফল হয়েছে। যোগ্যতানুসারে স্বীয় ময়দানে যে ব্যক্তি কঠোর পরিশ্রম ও সময় দেয় তার সফলতা আসবেই। অলস মানুষের প্রথম বদগুণ হল তারা চরম অধৈর্য পরায়ণ। তাই সে সফল হবার জন্য সদা সংক্ষিপ্ত পথের তল্লাশি করতে থাকে। অন্যের ক্ষতি করে, কাউকে প্রলোভন দেখিয়ে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে, চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে, দুই নম্বরি ব্যবসা ফেঁদে, অন্যের টাকা নিজের পকেটস্থ করাকে চরম বুদ্ধিমানের কাজ মনে করে। উচ্চ শিক্ষিত হওয়া স্বত্বেও কুটিল স্বভাবের মানুষ, উপরের কাজগুলো করতে গিয়েও, ন্যুনতম বিবেকবোধ সৃষ্টি হয়না। এ ধরনের অনৈতিক ধাপ্পাবাজিকে তারা চরম সফলতা মনে করে এবং মাঠে-ময়দানে, মিডিয়ায় উচ্চকণ্ঠে নিজের সফলতার সাফাই গাইতে থাকে।

ইসলাম ধর্মে এই কাজ চরম নিন্দনীয়। এসব মানুষের নগদ টাকার লোভে অনেকে হয়ত তাদের সম্মান দেয় কিন্তু প্রত্যেকের জন্য চরম অপমানকর একটা দিন অপেক্ষায় থাকে। সেদিন তারা মানুষের তামাশার পাত্রে পরিণত হয়। তবুও কুটিল মানুষ সেই চরম সত্যের কথা বুঝতে চায়না। তারা ভাবতে থাকে, গ্যাঁটে টাকা থাকলে সবই নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে এসব মানুষ উপদেশ-নসিহতের জায়গায় চরম অহংকারী হয়ে উঠে। সে কারণেই হয়ত রাসুল (সাঃ) বলেছেন, "আল্লাহর নিকট সর্বাধিক ঘৃণিত মানুষ হচ্ছে সর্বদা কূটতর্ককারী"- বোখারী, মুসলিম। অন্যত্র বলা হয়েছে পথভ্রষ্ট মানুষদের জন্য কুটিলতা, কূটতর্কের বিষয়গুলো প্রিয় করিয়ে দেওয়া হয়। যাতে তারা সীমালঙ্ঘনের চূড়ান্ত সীমারেখা অতিক্রম করতে পারে। আবু উমামা (রা) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা) বলেছেন, "হেদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কোন জাতি যদি পথভ্রষ্ট হয়, তবে তাদেরকে কুট বিতর্কে জড়িয়ে দেওয়া হয়" তিরমিযী, ইবনে মাজা।

- টিপু

পঠিত : ৫১৯ বার

মন্তব্য: ০