Alapon

বাণিজ্য ঘাটতি থেকে আফিম যুদ্ধ...


চীনের সাথে বর্তমানে পাশ্চাত্যের যে বাণিজ্য-ঘাটতি, তা শেষপর্যন্ত যুদ্ধে গড়াতে পারে, যেমনটি হয়েছিলো ঊনিশ শতকে চীন ও ব্রিটেইনের মধ্যে। সে-যুদ্ধে ব্রিটেইন বাংলাকেও ব্যবহার করেছিলো তার উপনিবেশ হিসেবে।

চীনের বিলাস সামগ্রী - বিশেষতঃ সিল্ক, পর্সোলিন ও চা - বিদেশে রফতানি হওয়ার ইতিহাস অতি প্রাচীন। সমুদ্রে আরব আধিপত্য ইউরোপীয়দের কাছে পরাস্ত হলে, চীনের সাথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণের শীর্ষে চলে আসে বাংলা দখলকারী প্রবল প্রতিপত্তিশালী ব্রিটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী।

আঠারো শতকের শেষের দিকে চীনের সাথে ব্রিটিশ বাণিজ্য ঘাটতি এমনই পর্যায়ে যায় যে, ব্রিটেইনের পক্ষে তা প্রথা অনুসারে আর রৌপ্য মুদ্রা দিয়ে কুলানো সম্ভব ছিলো না। চীনের সাথে 'ট্রেইড ব্যালেন্স' বা বাণিজ্যিক ভারসাম্য ব্রিটেইনের অনুকূলে আনার জন্যে ব্রিটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী সাংঘাতিক অনৈতিকতার আশ্রয় নেয় এবং এতে তারা তাদের উপনিবেশিত বাংলাকে ব্যবহার করে।

ব্রিটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী বাংলার কৃষকদের দিয়ে বলপূর্বক আফিম ফলিয়ে তা সমুদ্রপথে বে-আইনীভাবে চীনে রফাতানি শুরু করলে তা শুধু 'ট্রেইড ব্যালেন্স'কে ব্রিটেইনের পক্ষে ঘুরিয়ে দেয়নি, চীনের কোনো-কোনো স্থানে তরুণদের ৯০% সাংঘাতিকভাবে আফিমাসক্ত হয়ে ওঠে, যা সমগ্র চীনা-জাতির অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দেখা দেয়।

চীন-সম্রাট ব্রিটেইনের এই বে-আইনী আফিম-বাণিজ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে চীনের সাথে ব্রিটেইনের যুদ্ধ বাঁধে, যা ইতিহাসে 'Opium War' বা 'আফিম-যুদ্ধ' নামে সমধিক পরিচিত।

চীনের সাথে ব্রিটেইনের দু'-দু'বার আফিম-যুদ্ধ হয়। প্রথম আফিম-যুদ্ধ ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ পর্যন্ত চলে। আর, দ্বিতীয় আফিম-যুদ্ধ চলে ১৮৬৫ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত। উভয় যুদ্ধে ব্রিটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী বাংলায় প্রতিষ্ঠিত তাদের সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে বিজয় লাভ করে, যদিও দ্বিতীয় আফিম-যুদ্ধে ব্রিটেইনের সাথে ফ্রান্সও যোগদান করে, এবং রাশিয়া ও আমেরিকাও নানাভাবে চীনের বিরুদ্ধে ব্রিটেইন ও ফ্রান্সকে সহযোগিতা করে।

প্রথম আফিম-যুদ্ধে পরাজিত হয়ে চীন ব্রিটেইনের সাথে 'নানকিং-চুক্তি' স্বাক্ষর করে, যা একটি জঘন্য অসম-চুক্তি হিসেবে কুখ্যাত। এ-চুক্তির মাধ্যমেই চীনের কাছ থেকে ব্রিটেইন হংকং দ্বীপ কেড়ে নেয়, এবং মূল-ভূখণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলোতে বাণিজ্যিক ও শুল্ক সুবিধা লাভ করে। এ-ছাড়াও চীনের কাছ থেকে ব্রিটেইন ২১ মিলিয়ন রৌপ্যমুদ্রা ক্ষতিপূরণ-সহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে 'Most Favioured Nation' বা 'সর্বোচ্চ সুবিধাপ্রাপ্ত জাতি'র মর্য্যাদা আদায় করে নেয়।

চীনের পক্ষে অসম 'নানকিং-চুক্তি' পালন করা সম্ভব না হলে, ব্রিটেইন ও ফ্রান্স মিলে দেশটির বিরুদ্ধে ১৮৫৬ সালে দ্বিতীয় আফিম-যুদ্ধ শুরু করে এবং এতে চীনের রাজধানী পিকিং পর্যন্ত দখল করে চীন-সাম্রাজ্যের গর্ব হিসেবে প্রত্যক্ষিত বিখ্যাত গ্রীষ্ম-প্রাসাদ লুট করে তা আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। অধিকন্তু, ক্যাণ্টনের ভাইসরয় ইয়ি মিংচেনকে অপমানজনকভাবে বন্দী করে কোলকাতায় নির্বাসিত করা হলে সেখানে তাঁর অনাহারে মৃত্যু হয়।

দ্বিতীয় আফিম-যুদ্ধের শেষে চীনকে অপমানজনক 'তিয়ানজিন চুক্তি' করতে হয় যুদ্ধে বিজয়ী ইঙ্গ-ফরাসী ও তাদের সহযোগী রুশ-মার্কিন শক্তির সাথে। এই চুক্তির ফলে চীন আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও অবাধ বাণিজ্যিক, চলাচল ও আবাসিক সুবিধা-সহ আফিম বিক্রির আইনী স্বীকৃতি আদায় এবং হংকংয়ের মতো কাউলুন দখল করে নেয়।

রাশিয়া একটি স্বতন্ত্র চুক্তির মাধ্যমে চীনের কাছ থেকে আমুর নদীর বাম তীর হস্তগত করে নেয়, যেখানে তারা ভ্লাদিভস্তক বন্দর প্রতিষ্ঠা করে।

আজ একবিংশ শতাব্দীতে আবার চীনের সাথে পাশ্চাত্যের যে বাণিজ্য-ঘাটতি নিয়ে বাণিজ্য-যুদ্ধ চলছে, তা যে শেষপর্যন্ত সামরিক সংঘর্ষে পরিণতি লাভ করবে না , এমনটি বিশ্বাস করা হবে অযৌক্তিক ও অনৈতিহাসিক।

- Barki

পঠিত : ৪২৭ বার

মন্তব্য: ০