Alapon

গ্রিস-মিশর চুক্তি; তুরস্ক-গ্রিস সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি...


ইতিহাস বিখ্যাত ট্রয় নগরীর কথা কে না জানে।ইতিহাসে ট্রোজান যুদ্ধ নামে পরিচিত এই যুদ্ধটি সংগঠিত হয় বর্তমান গ্রীস এবং তুরস্কের মধ্যে।ভূমধ্য সাগরের তীরে অবস্থিত এ দুটি দেশই ন্যাটোর সদস্য।কিন্তু তাদের মধ্যে 'দা-কুমড়া' সম্পর্ক চলে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরে। এই শত্রুতা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে।

শত্রুতা শুরু হয় মূলত ১০৪৮ সালে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য থেকে।বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য ছিলো অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের সাম্রাজ্য যার রাজধানী ছিলো ইস্তাম্বুল বা কনস্টান্টিনোপল।অন্যদিকে সেলজুকরা ছিল সুন্নি-হানাফি মুসলিম।যারা ১৩০৮ সালে আনাতোলিয়া দখল করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়।

অঘুজ তুর্কিরা সেলজুকদের পরাজিত করে উসমানীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।ফলে উত্তরাধিকার সুত্রেই তারা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্বে জড়িয়ে পড়ে।

তবে প্রথম বিশ্বযুদ্বের অব্যবহিত পরে(১৯১৯-২২) যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলোকেই এই শত্রুতার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ মনে করা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্বে তুর্কিরা জার্মানদের পক্ষে আর গ্রীকরা জার্মানদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।যুদ্বে জার্মানরা পরাজিত হলে মিত্রবাহিনী উসমানীয় সাম্রাজ্য ভেঙ্গে দেয়।এদের পালের গোদা হিসেবে কাজ করে ব্রিটিশরা।ব্রিটিশরা গ্রীকদেরকে তুরস্ক আক্রমণের জন্য উসকে দেয়।

তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড
গ্রিসকে আশ্বাস দেন যে,তুরস্ক আক্রমণ করলে পুরাতন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের এলাকা গ্রীকদেরকে দিয়ে দেয়া হবে।যার কারণে গ্রীকরা ১৯১৯ সালে আনাতোলিয়ার উত্তর-পশ্চিম অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয়।ধীরে ধীরে মানিসা,বালকেসির,কুতাহিয়া দখল করে সামনে আগাতে থাকে।এ যাত্রা থামানো সম্ভব হয় ১৯২১ সাকারিয়ার যুদ্বে। ১৯২২ সালে তুরস্কের পালটা আক্রমণে গ্রীকরা পলায়ন করে।

পরবর্তীকালে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের সময় গ্রিসের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসলে ও সাইপ্রাসের দখল,ইজিয়ান সাগরের মালিকানা,গ্রিস কর্তৃক আবদুল্লাহ ওজালানকে আশ্রয় দান,অবৈধ অভিবাসন এসব নিয়ে আবারব দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে গ্রিস-তুরস্কের এই ঐতিহাসিক শত্রুতা আবারও মাথাছড়া দিয়ে উঠেছে জলসীমা,আয়া সোফিয়া মসজিদ ও শরণার্থী বিরোধকে ঘিরে।এ মাসের প্রথম দিকে ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়া জাদুঘর (যা কয়েক শতাব্দী ধরে অর্থডক্স খ্রিষ্টানদের গির্জা ছিল)মসজিদে পরিণত করে তুরস্ক।
এ ঘটনাটি গ্রিসকে মর্মাহত করে।গ্রীস এই পদক্ষেপকে “সভ্য বিশ্বের উস্কানিমূলক”বলে অভিহিত করেছে।

সম্প্রতি সাইপ্রাস থেকে দূরে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে বিপুল পরিমান গ্যাস মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। এ সম্পদ আহরন নিয়ে এক দিকে অবস্থান নিয়েছে সাইপ্রিয়ট সরকার, গ্রিস, ইসরাইল এবং মিশর। পূর্ব ভূমধ্য সাগরের তেল গ্যাস আহরনের জন্য তারা পরষ্পর চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী ভূমধ্য সগারের মধ্য দিয়ে ১ হাজার ২শ মাইল পাইপ লাইনের মাধ্যমে তেল গ্যাস নিয়ে যাবে ইউরোপের বাজারে।

এরপর গত বছর তুরস্ক সাইপ্রাসের পশ্চিম দিকে গ্যাসকুপ খনন জোরদার করে। তুরস্ক নিয়ন্ত্রিত উত্তর সাইপ্রাসকে একমাত্র আংকারাই একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।আংকারা সবসময়ই যুক্তি দিয়ে আসছে যে সাইপ্রাসের প্রাকৃতিক সম্পদ ভাগাভাগি করতে হবে।

এরপর ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে তুরস্ক লিবিয়ার সাথে এক চুক্তি স্বাক্ষর করে। আংকারার বক্তব্য, এর মাধ্যমে তারা তুরস্কের দক্ষিণ উপকুল থেকে লিবিয়ার উত্তর-পূর্ব
তীর পর্যন্ত একটি বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা সৃষ্টি করেছে।

মিশর বলেছে, এ উদ্যোগ অবৈধ। গ্রিস বলে, এটা এক অবাস্তব উদ্যোগ কারণ এ দুটি দেশের মাঝখানে যে গ্রিসের একটি দ্বীপ ক্রিটের অবস্থান তা বিবেচনায় নেয়া হয়নি।

পূর্ব ভূমধ্যসাগর এবং ইজিয়ান সাগর এলাকায় গ্রিসের এমন বহু দ্বীপ আছে যা তুরস্কের খুব কাছে এবং উপকুল থেকে দেখা যায়।ফলে এখানে কার সমুদ্রসীমা কোথায় তা নির্ধারণ এক জটিল ব্যাপার।

সমুদ্রসীমা ছাড়াও এখানে আছে বিশেষ
অর্থনৈতিক এলাকা।একটি হচ্ছে তুরস্ক আর লিবিয়ার মধ্যে এবং অন্যটি সাইপ্রিয়ট বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা যাতে রয়েছে লেবানন, মিশর ও ইসরায়েল।এগুলোর সীমা হতে পারে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত।

মে মাসের শেষ দিকে তুরস্ক ঘোষণা করে যে তারা আগামী মাসগুলোতে আরো পশ্চিমের কিছু এলাকায় গ্যাসকুপ খনন শুরু করার পরিকল্পনা করছে।পূর্ব ভূমধ্যসাগরে খনন কাজ চালানোর জন্য টার্কিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানিকে বেশ কয়েকটি লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে গ্রিসের রোডস এবং ক্রিট দ্বীপের নিকটবর্তী সামুদ্রিক এলাকাও রয়েছে।এ খবরে ইউ’র সদস্য গ্রিস ও সাইপ্রাসের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।

তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতে বলেছেন, সবাইকে এটা মেনে নিতে হবে যে তুরস্ক এবং উত্তর সাইপ্রাস প্রজাতন্ত্রকে এ অঞ্চলের জ্বালানি সংক্রান্ত সমীকরণের বাইরে রাখা যাবে না।তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ২০১৯ সালে এক ঘোষণায় বলেছেন এ অঞ্চলে তুরস্কের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা অসম্ভব।

গ্রিস বলছে, তুরস্ক গ্যাস অনুসন্ধান জাহাজ সংক্রান্ত যে সতর্কবার্তা দিয়েছে তা অবৈধ।
কারণ তা সাইপ্রাস এবং ক্রিট দ্বীপের মাঝখানে এবং তা কাস্টেলোরিজোর উপকুলীয় এলাকার মধ্যে তার অনেকখানি পড়ে যায়।ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এ ব্যাপারে গ্রিসকে সমর্থন করেছে।

কিন্তু তুরস্ক বলছে, যে তাদের জরিপ জাহাজটি তাদের উপকুলবর্তী সামুদ্রিক এলাকার মধ্যেই কাজ করছিল।

তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট গত মাসে বলেছেন, তুরস্কের মানুষকে তাদের মূলভূমিতে আটকে রাখতে যে মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে - আংকারা তা ছিঁড়ে ফেলে দেবে। আংকারা জোর দিয়ে বলেছে তারা জাতিসংঘের সমুদ্র সংক্রান্ত আইন মেনেই কাজ করছে।

ইউ ও যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্কের এই অঞ্চলে বর্ধিত প্রভাবের জন্য গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
ইউরোপের নেতারা বলছেন, পূর্ব ভুমধ্যসাগরে তুরস্ক এবং রাশিয়া তাদের তৎপরতা ক্রমশ:ই বাড়িয়ে চলেছে এবং এতে তারা স্পষ্টতই উদ্বিগ্ন।

এদিকে,গত বৃহস্পতিবার গ্রিস সরকার মিশরের সঙ্গে তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত তেলও গ্যাস চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভূ-মধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে তুরস্কের তেল ও গ্যাস উত্তোলনের প্রয়াসকে বাঁধা দিতে গ্রিস ও মিশর সম্প্রতি একটি নৌচুক্তি স্বাক্ষর করে।

এই চুক্তির বিরোধিতা করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট।শুক্রবার ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়ায় জুমার নামাজ আদায়ের পর দেয়া এক বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেন, মিসর এবং গ্রিস চুক্তি করেছে মূলত লিবিয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার এবং তুর্কি সরকারের মধ্যকার চুক্তি বানচাল করার লক্ষ্য নিয়ে।

তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, মিসরের সাথে গ্রিসের কোনো সমুদ্রসীমা নেই তারপরও ওই চুক্তি করা হয়েছে যার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।
এবং এই চুক্তি আঙ্কারার পক্ষে"বাতিল এবং বাতিল"।

এরদোয়ান এ চুক্তির পাল্টা কড়া ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এবং সেখানকার দুটি দ্বীপের উপকূলীয় এলাকায় সম্ভব্য ড্রিলিং সাইটে গবেষণা জাহাজ পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

এরপরই প্রাথমিক ড্রিলিং শুরু করতে দুটি যুদ্ধজাহাজ বেষ্টিত তুরস্কের একটি গবেষণা জাহাজ বিতর্কিত জলসীমায় পৌঁছায় এই আশংকায় যে, গ্রিস তাদের প্রবেশে বাধা দিতেপারে।

গ্রিস মনে করছে এর মাধ্যমে এর্দোয়ান সরকার‘শান্তিকে হুমকিতে ফেলছে’৷ সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে আরো বলেছে, আঙ্কারার এ সিদ্ধান্ত নতুন করে উত্তেজনা বাড়ানোর প্রয়াস৷ পাশাপাশি গ্রিস সার্বভৌমত্ব এবং সার্বভৌম অধিকার রক্ষা করবে বলেও বিবৃতিতে জানানো হয়েছে৷

এদিকে গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিটসোটাকিস বিষয়টি নিয়ে ইইউ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মাইকেল এবং ন্যাটোর মহাসচিব ইয়েন্স স্টোলেনবার্গের সঙ্গে কথা বলেছেন৷ দু পক্ষের প্রতি আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন স্টোলেনবার্গ৷

গ্রিসের দুটি দ্বীপের কাছে দু’দিনব্যাপী নৌ মহড়া চালিয়ে তুরস্ক মূলত এ সিগন্যাল দিয়েছে যে, সম্প্রতি মিসরের সঙ্গে গ্রিস যে চুক্তি করেছে আঙ্কারা তা মানবে না।

cltd

পঠিত : ৫৩৯ বার

মন্তব্য: ০