Alapon

লিবিয়য়া সংকটের আদ্যোপ্রান্ত এবং বর্তমান অবস্থা...


আফ্রিকার বৃহত্তম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একটি হল লিবিয়া।দেশটির বেশিরভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে সাহারা মরুভূমি।আয়তনে বিশাল হলেও লিবিয়াতে জনবসতি খুবই কম।এবং দেশটির প্রায় সমস্ত লোক উপকূলবর্তী অঞ্চলে বাস করে। লিবিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং সরকারি ভাষা আরবি।

১৯৫০-এর দশকে খনিজ তেল আবিষ্কারের আগে লিবিয়া ছিল একটি দরিদ্র রাষ্ট্র। পেট্রোলিয়ামের বিরাট মজুদ আবিষ্কারের পর থেকে লিবিয়া আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী দেশগুলির একটি।

১৯৫১ সালে লিবিয়া স্বাধীন হয় এবং ১৯৬৯ সালে সামরিক অফিসার মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি লিবিয়ার ক্ষমতা দখল করেন।তিনি লিবিয়াকে একটি সমাজতান্ত্রিক আরব গণপ্রজাতন্ত্র আখ্যা দেন।বিশ্ববাসীর কাছে যা সামরিক একনায়কতন্ত্র হিসেবেই বেশি পরিচিত।

আরব বসন্তের মধ্য দিয়ে ২০১১ সালে ন্যাটো লিবিয়ার ৪২ বছরের স্বৈরশাসক গাদ্দাফিকে হত্যা করে। গাদ্দাফির মৃত্যুদন্ডের মাধ্যমে লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ভীনদেশীদের হাতে।

গাদ্দাফির মৃত্যুর পর খনিজ সম্পদে ভরপুর এই দেশটি কার্যত দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে দুটি আলাদা সরকার গঠন করে।

একটি আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসংঘ স্বীকৃত পশ্চিম লিবিয়ার ত্রিপলি ভিত্তিক সরকার।যার নেতৃত্বে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ফাইয়াজ আল সিরাজ।তার সমর্থনে আছে ইউ, মুসলিম
ব্রাদারহুড এবং জাতিসংঘ।এছাড়া ও তুরস্ক, ইতালি, কাতার, আলজেরিয়া এই সরকারকে একচেটিয়া সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে রয়েছে লিবিয়ার পূর্ব অঞ্চলের দখলদ্বার বেনগাজী ভিত্তিক সরকার খলিফা হাফতার। বিদ্রোহী সরকার নামে পরিচিত এই বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। যাদের পক্ষে আছে রাশিয়া, ফ্রান্স, আরব আমিরাত, মিশর, সৌদি আরব।

বিশ্বশক্তি ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এই দুই সরকারকে সমর্থন করা নিয়ে বিভক্ত হয়ে আছে।

একদিকে সৌদি সমর্থিত সুদানের সামরিক সরকার খলিফা হাফতারের সমর্থনে ১০০০ ' র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স পাঠায়।অন্যদিকে বিদ্রোহীরা তুরস্কের তেলবাহী জাহাজ আটকে দিলে, জাতীয় সরকারের সমর্থনে বিপুল সামরিক সহায়তা পাঠায় এরদোয়ান সরকার।
আবার বিদ্রোহের সমর্থনে লিবিয়ায় ড্রোন হামলা চালায় আরব আমিরাত। ফলে গত দুই বছর জুড়ে আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠে লিবিয়া।

লিবিয়া তুরস্ক চুক্তিঃ
-------------
২০১৯ সালে লিবিয়ার জাতীয় সরকার তুরস্কের সাথে একটি সামরিক চুক্তি করে।যার ফলাফল স্বরুপ এ বছর জানুয়ারিতে লিবিয়ায় সৈন্য মোতায়ন শুরু করে তুরস্ক।

এরই ফলশ্রুতিতে লিবিয়ার জাতীয় সরকার ত্রিপলিসহ দেশটির বিস্তীর্ণ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। এছাড়াও এই অঞ্চলে তুরস্কের সামরিক প্রভাব বিস্তারের জন্য তুরস্ক এখন লিবিয়ায় সামরিক ও নৌঘাটি স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, গোলযোগপূর্ণ লিবিয়ার জাতীয় সরকারকে সমর্থন দেয়ার জন্য দেশটিতে সেনা মোতায়েন শুরু করেছে আঙ্কারা। তিনি জানান, সম্প্রতি লিবিয়া সরকারের সঙ্গে যে সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরুণ ও নিরাপত্তা সামরিক চুক্তি সই করা হয়েছে তার আওতায় তুর্কি সেনা মোতায়েন করা হচ্ছে।

জবাবে লিবিয়ার স্বঘোষিত কমান্ডার জেনারেল হাফতার তার দেশের সব নাগরিককে তুরস্কের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার আহ্বান জানান।

টেলিভিশনে দেয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, মাতৃভূমি লিবিয়াকে রক্ষার জন্য নারী-পুরুষ সামরিক-বেসামরিক সবাইকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে এবং তুরস্কের বিরুদ্ধে গণঅভ্যূত্থান ঘটাতে হবে। জেনারেল হাফতার বলেন, লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে তুর্কি সরকার এবং তার দেশ এখন উপনিবেশবাদের মুখে পড়েছ।

আক্ষরিক অর্থে লিবিয়ার এই দুই দলের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই মূলত পশ্চিমা মদদে পরিচালিত মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান দুই বলয়ের লড়াইয়ের প্রতিফলন, অনেকটা সিরিয়ার যুদ্ধের মত।পশ্চিমারা নিজেদের স্বার্থ নিরাপদ রাখতে সময়-সময় মিত্র বদলিয়ে বন্দুকের বাণিজ্য সচল রাখে।

অনিশ্চিত এই যুদ্ধে আঙ্কারার শামিল হওয়ার ঘটনা উত্তর আফ্রিকার বর্তমান রাজনৈতিক চিত্রকে পাল্টে দেবে।লিবিয়ায় সৈন্য পাঠিয়ে এরদোয়ান তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ লিবিয়ার লাগামহীন গৃহযুদ্ধ ও ভৌগোলিক অবস্থান।

লিবিয়ায় সঙ্গে কাতার এবং আঙ্কারা ব্যতীত কেউ নেই। প্রতিপক্ষের তালিকায় ইইউ থেকে শুরু করে সবাই। তাই ভবিষ্যতে লিবিয়ায় তুর্কি সৈন্যদের যেকোনো ধরনের বিপর্যয়ের দায় এরদোয়ানকেই নিতে হবে।এরদোগান সেই দায় ঝেড়ে উঠতে পারবেন কি না, তা আগামীর নির্দয় প্রশ্ন হয়ে থাকল।

তবে লিবিয়ার এই গৃহযুদ্ধের ফলাফল অন্ততপক্ষে দুটি বিষয়ের পরিষ্কার সমাধান করবে।
১.আগামীর ভূমধ্যসাগরের তেল-গ্যাসের মালিকানা।
২. তুর্কি-কাতার বলয়ের ভবিষ্যৎ।

তুর্কি সৈন্যের উপস্থিতিতে ত্রিপোলিতে জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের টিকে গেলে উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোয় ৫০ বিলিয়ন ডলারের তুর্কি বিনিয়োগ রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ভূমধ্যসাগরের তেল-গ্যাসের মালিকানার আলোচনায় আঙ্কারার অবস্থান শক্তিশালী হবে। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত সৌদিবিরোধী জোটের প্রথম সফল অভিযান হতে পারে ত্রিপোলি রক্ষা।

নিশ্চিতভাবেই মিসরের সিসি নাকের ডগায় এরদোয়ানের উপস্থিতি সহ্য করবেন না। তাই বিশেষজ্ঞরা তুরস্ক-মিসর হাঙ্গামার আশঙ্কা বাতিল করে দিচ্ছেন না। যদি সেই সম্ভাবনা বাস্তব রূপ ধারণ করে, তাহলে তা আঞ্চলিক যুদ্ধ থেকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধে রূপান্তরিত হতেও পারে।

তবে তার আগে রাশিয়া ও তুরস্কের সমঝোতা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে হবে। উভয় দেশের আহ্বানে বিদ্রোহী জেনারেল হাফতার যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছেন। এখন জাতিসংঘ সমর্থিত সরকার ও জেনারেল হাফতারের বাহিনীকে কীভাবে এক রাজনৈতিক বন্দোবস্তে আনা যায়, সেই লক্ষ্যে আলোচনা চালাচ্ছে দেশ দুটি।

আফ্রিকায় তুরস্কঃ
------------
লিবিয়ায় তুরস্কের সরব উপস্থিতি নিয়ে যখন উত্তেজনা চলছে তখন জানা গেল আফ্রিকার দেশ নাইজারের সঙ্গেও সম্প্রতি সামরিক চুক্তি করেছে তুরস্ক।লিবিয়ার পার্শ্ববর্তী এ দেশটির সঙ্গে সামরিক চুক্তির কথা প্রকাশ পেলে সংশ্লিষ্টরা বলেন, নতুন এই চুক্তি প্রমাণ করে ওই অঞ্চলে তুরস্ক নিজেদের প্রভাব আরো দৃঢ় করার লক্ষ্যেই এগুচ্ছে।

মিডেল ইস্ট মনিটর বলছে, নাইজারের সঙ্গে তুরস্কের সামরিক চুক্তির ফলে লিবিয়ায় বেশ সুবিধা পাবে তুর্কিরা। কারণ লিবিয়ায় দীর্ঘদিন তুর্কিদের উপস্থিতি থাকলেও তুরস্কের সঙ্গে লিবিয়ার কোনো সীমান্তে যোগাযোগ না থাকায় তারা সাংগঠনিকভাবে পিছিয়ে ছিলো।

কিন্তু নাইজারের সঙ্গে লিবিয়া সীমান্তের বড় একটি অংশ যুক্ত আছে।সীমান্তের কাছে থাকায় মিশর কর্তৃক এলএনএকে সাহায্য করা সহজ হলেও তুরস্কের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি এতদিন। তবে নাইজারের সঙ্গে নতুন চুক্তিতে সে সুবিধাই পেতে যাচ্ছে আঙ্কারা।

সামরিক তৎপরতা ও চুক্তির বাইরেও তুরস্ক আফ্রিকার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগী হয়েছে। ২০০৮ সালে তুর্কি-আফ্রিকা সহযোগিতা সম্মেলনে আফ্রিকার ৫০টি দেশ অংশ নেয়। ২০১৩ সালে গ্যাবনে গিয়ে এরদোয়ান বলেছিলেন, ‘আফ্রিকা আফ্রিকানদেরই থাকবে; আমরা এখানে সোনার জন্য আসিনি।

গত মাসে এরদোয়ান আলজেরিয়া, সেনেগাল ও গাম্বিয়া সফর করেন। লিবিয়াতে সৈন্য পাঠালেও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই আফ্রিকার দেশগুলোকে আস্থায় আনতে চাইছে তুরস্ক। গত বছর তুরস্ক ও আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৩ সালে আফ্রিকার দেশগুলোয় তুরস্কের বিনিয়োগ ছিল ১০০ মিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সাল নাগাদ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে তুরস্ক ৬.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে।

তুরস্কের বিনিয়োগ মহাদেশজুড়ে ৭৮ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করেছে। গত ১০ বছরে এরদোয়ান ৩০টি আফ্রিকান দেশে ২৮টি সফর করেছেন। এমনকি ২০১১ সালে দুর্ভিক্ষ, খরা ও যুদ্ধাক্রান্ত সোমালিয়া সফর করে আলোচনায় আসেন তিনি।

আফ্রিকাকে ঘিরে তুরস্কের এসব উদ্যোগকে অনেকেই মহানুভব বললেও উপসাগরীয় দেশগুলো এর বিরোধিতা করছে। সৌদি আরবসহ অন্য উপসাগরীয় দেশগুলো মনে করে, ‘নব্য অটোমান' পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে হর্ন অব আফ্রিকা দখল করতে চাইছে তুরস্ক।

মূলত, ২০০০ সালে এরদোয়ানের নেতৃত্বে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিরও বদল ঘটতে থাকে।

আরব বসন্তের ধাক্কায় আঞ্চলিক রাজনীতি থেকে মিসর হারিয়ে যায়। ধীরে ধীরে ইরানের উত্থান ঘটতে থাকে। পাশাপাশি তুরস্কও বিভিন্ন সংকটে নিজের অবস্থান দৃঢ় করার সুযোগ পায়। এর পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বকে সৌদির প্রভাববলয় থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছে।

তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য হয়েও রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে ইউরোপের সঙ্গে দর-কষাকষির পথ তৈরি করছেন এরদোয়ান। কিছুদিন আগে ক্ষেপণাস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি করেছে। সম্প্রতি গ্যাস পাইপলাইনের চুক্তি করেছে। গ্যাস পাইপলাইনের চুক্তি বাস্তবায়িত হলে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার নির্ভরতা কমে তুরস্কের ওপর ইউরোপের নির্ভরতা বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে ইউক্রেন দিয়ে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি করে। তুরস্ক রাশিয়ার জন্য বিকল্প পথ বের করে দিয়েছে। অন্যদিকে, ইউরোপের সঙ্গে তুরস্কের দর-কষাকষির সুযোগ বেড়ে যাবে নতুন এই চুক্তির কারণে।

তথ্যসূত্রঃউইকিপিডিয়া, প্রথম আলো,বিডি ভিউজ চ্যানেল

পঠিত : ৪৬২ বার

মন্তব্য: ০