Alapon

ব্রিটিশ দার্শনিক হ্যারল্ড জোসেফ লাস্কি এর জীবন ইতিহাস...


হ্যারল্ড জোসেফ লাস্কি ছিলেন একজন ইংরেজ রাজনীতিবিদ,শিক্ষাবিদ, তাত্ত্বিক, অর্থনীতিবিদ ও লেখক। তিনি ৩০ জুন ১৮৯৩ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরের একটি মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

তার পিতা নাথান লাস্কি ছিলেন একজন তুলা ব্যবসায়ী ও লেবার পার্টির নেতা।মাতা সারাহ লাস্কি।প্রতিবন্ধী বোন মাবেল লাস্কি ও ভাই নিভিলি লাস্কিসহ তাঁদের পরিবার বসবাস করত পুরনো ম্যানচেস্টারে। লাস্কি ম্যানচেস্টার গ্রামার স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন।

১৯১১ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে লাস্কি পরিবারের অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও তার চেয়ে ৮ বছরের বড় ফিদা কেরীকে (খ্রিস্টান) বিয়ে করেন।

১৯১৪ সালে অক্সফোর্ড থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন।এর মধ্যে কিছুদিন 'ডেইলি হ্যারল্ড' এ কাজ করেন।১৯১৬ সালে কন্যা ডায়ানার জন্ম হয়।এবং একই সালে কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ইতিহাসের লেকচারার হিসেবে যোগ দেন।

অর্থনীতির ওপর ভালো দখল থাকায় প্রায়ই হার্ভার্ডে বক্তৃতা দেওয়ার ডাক পেতেন।সেই সাথে হার্ভাডে ও পড়াতে শুরু করেন।
১৯১৯-২০ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।১৯২০ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন।১৯২৬-৫০ দীর্ঘ ২৫ বছর 'লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে' অধ্যাপনা করেন।

লাস্কি শিক্ষক হিসেবে ছিলেন ব্রিলিয়ান্ট এবং
অত্যন্ত জনপ্রিয়।তার বক্তব্য তার ছাত্রদেরকে
ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিলো।রাজনৈতিক তত্ত্বের ইতিহাস বিষয়ে তার ক্লাসগুলো ছিলো অসাধারণ।হাতে কোনো নোট না নিয়েই তিনি অনর্গল বলে যেতেন।তাত্ত্বিক পড়া পড়ানোর সময়, এমনকি 'হবস' এর 'সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব' পড়ানোর সময় ও তিনি সমসাময়িক বিতর্কগুলোকে যুক্ত করে উদাহারণ দিতেন।

বৃটিশ সাংবাদিক kingsley martin লিখেছেনঃ লাস্কির বয়স যখন ত্রিশের কাছাকাছি তখন ও তাকে কিশোরসুলভ দেখাতো।

এশিয়ান ও আফ্রিকান স্টুডেন্টদের উপর লাস্কির ব্যাপক প্রভাব ছিলো।যাদের মধ্যে কেউ কেউ পরবর্তীতে এশিয়া ও আফ্রিকার নতুন স্বাধীন দেশগুলির নেতা হয়েছিলেন।
তার অনেক ছাত্রই পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়েছেন। ভারতের জওহরলাল নেহেরু,
বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক ও তার ছাত্র ছিলেন।

এছাড়া ও তার উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থীরা হলেনঃ-
লেসলি গুওন ওয়ার্ডেন,জোসেফ পি।কেনেডি জুনিয়র,সি বি ম্যাকফারসন,ভি.কে.কৃষ্ণ মেনন,কে আর আর নারায়ণন,পিয়ের ট্রুডো।

ডক্টরাল শিক্ষার্থীরাঃ- র‌্যালফ মিলিবান্ড,ফ্রাঞ্জ নিউম্যান।

হ্যারল্ড লাস্কি ব্রিটিশ লেবার পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।লাস্কি শ্রমিকদের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন করার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেন। শ্রমিকদের অধিকার আদায়, শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ, মজুরি এসব ব্যাপারে তিনি কার্ল মার্ক্সের নীতি অনুসরণ করেন।মূলত,লাস্কি ছিলেন মার্ক্সবাদের পক্ষে ব্রিটেনের অন্যতম প্রভাবশালী বৌদ্ধিক মুখপাত্র ।

তিনি ১৯৪৫-৪৬ সালে লেবার পার্টির জাতীয় নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।তিনি সম্ভবত লেবার পার্টির সর্বাধিক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ছিলেন, বিশেষত সমাজতন্ত্র বিশ্বাসীদের জন্য।তারা জোসেফ স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন।কিন্তু লেবার পার্টির কর্তাব্যক্তিদের লাস্কি ও তার অনুসারীদের প্রতি আস্থা ছিলোনা।

যেমনঃ ক্লিমেন্ট অ্যাটলি(১৯৪৫-৫১)পর্যন্ত লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।সেসময় তিনি লাস্কিকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দেননি। লাস্কি এই দুরত্ব ঘুচানোর ও চেষ্টা করেননি।এবং এক পর্যায়ে গনতন্ত্রের ভবিষ্যতের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়েন।

ইহুদি পরিবারে জন্ম নেওয়া লাস্কি
জায়নিজমের সমর্থক ছিলেন এবং ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ছিলেন।

প্রথমদিকে তিনি প্লুরালিজমের পক্ষে ছিলেন।পরবর্তীতে ১৯৩০ সালের পর মার্কসবাদের উপর জোর দেন এবং শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলেন।তিনি বলেন যে, বিপ্লব সহিংস ও হতে পারে।লাস্কির অবস্থান অহিংস ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ লেবার পার্টির অন্য নেতাদের ক্রুদ্ধ করে।

১৯৪৫ সালের নির্বাচনে লাস্কির নীতিকে তীর্বভাবে আক্রমণ করে 'উইনসটন চার্চিল'।এর প্রেক্ষিতে লেবার পার্টি বলে, "লাস্কি যে নীতির কথা বলেছেন, এটা তার নিজস্ব নীতি।এর সাথে লেবার পার্টির কোনো সম্পর্ক নাই"।এবং লেবার পার্টির চেয়ারম্যান কর্তৃক লাস্কিকে প্রত্যাখ্যান করা হয়।

ব্যাপক জনপ্রিয় হ্যারল্ড লাস্কি মার্ক্সবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তনের পক্ষে তাঁর মত থাকলেও তিনি নানাভাবে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে মত দিয়েছেন। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য একটি আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে তাঁর অবস্থান ছিল।

স্পষ্টবাদী পণ্ডিত লাস্কি, নিজেই সামাজিক গবেষণার জন্য এই সময় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। হার্ভার্ডে আমেরিকান বন্ধুদের নিয়ে তিনি বিশাল একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। ব্রিটিশ আইনসভার পর্যালোচনা করে তিনি একটি গবেষণামূলক বই লেখেন।

তার উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হচ্ছেঃ- Grammar of politics
Authority of modern State
Faith reason and civilization
The state in theory and practice

লাস্কি সরকারের কর্তাব্যক্তি, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ইত্যাদি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তিনি নানা বিষয়ে পরামর্শ দিতেন, আবার তুখোড় সমালোচনাও করতেন।

আমেরিকার প্রতি রক্ষণশীল ও আজীবন লেবার পার্টির সমর্থক লাস্কি ৫৬ বছর বয়সে ১৯৫০ সালের ২৪ মার্চ ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

তথ্যসূত্রঃ সময় টিভি নিউজ,কালের কন্ঠ,উইকিপিডিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা।
- সালমা

পঠিত : ৮৬২ বার

মন্তব্য: ০