Alapon

একমাত্র বিবাহ-ই কি সব সমস্যার সমাধান...?


"বিয়ে করে হেদায়াত করে নিলেই হবে" কথাটা শুনতে শুনতে বিরক্তি চলে এসেছে। কম-বেশি সব দ্বীনি বোনদের এই বাক্যটি শুনতে হয়। পরিবারের মতে শুধু দ্বীনদারিতার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া যাবে অন্য কিছুতে নয়।

*ছেলে নামাজ পড়েনা কিন্তু অনেক টাকার মালিক।
-তো সমস্যা কি? বিয়ে করে নামাজ পড়াবা।
*ছেলে সিগারেট খায় কিন্তু ভালো চাকুরীজীবি।
-কোনো সমস্যা নেই। বিয়ের পর না করে দিবা যেনো সিগারেট না খায়।
*ছেলে নামাজ পড়ে, রোজা রাখে কিন্তু সুদি ব্যাংকে চাকরি করে।
-নামাজ তো পড়ে। আর কি চাও?
*ছেলে বিদআত করে কিন্তু চাকরি ভালো।
-আরে নামাজ রোজা করলেই মুসলিম। বিদআত কি আবার? বিয়ে করে ফেলো।
*ছেলে তাহাজ্জুদও পড়ে আবার মেয়েদের গায়ে হাত দিয়ে সেলফিও তোলে।
-তাহাজ্জুদ পড়ে মাশাআল্লাহ। কতো ভালো ছেলে। মেয়েদের সাথে বিয়ের আগে এমন একটু আকটু হয়। এটা ব্যাপার না।

এগুলা তো অল্প কয়েকটা বললাম। গত একবছরে আরও কতো রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছে তা বলার মতো না! দ্বীনদার পরিবার না পাওয়ার অর্ধেক কষ্ট যেনো এই একটা বাক্যের মধ্যেই রয়েছে, "বিয়ে করে হেদায়াত করে নিও।" কিন্তু মানুষ বুঝতে পারে না হেদায়াত করিয়ে নেওয়া আমাদের হাতে নেই।

যেই মানুষটা বিশ বছর ধরে সিগারেটের নেশায় মগ্ন তাকে আমি বিয়ে করে সেই নেশা হতে মুক্ত করার ক্ষমতা রাখি?
যেই মানুষটা মেয়েসঙ্গ ছাড়া চলতে পারেনা সেই মানুষকে আমি বদলে দিবো?
যেই মানুষটার নিজের রব্ব এর সাথে সম্পর্ক খুবই ঠুনকো তাকে তার রব্ব এর সাথে হুট করে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে আমি সাহায্য করতে পারবো?
যেই মানুষটা পর্দা বুঝেনা তার বাসায় আমি পর্দা করে থাকতে পারবো? তাকে বুঝাতে পারবো?

এতো সহজ সব কিছু? যেখানে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) বলেছেন শুধুমাত্র তিঁনিই হেদায়াত করতে পারেন সেখানে আমি কিসের ভরসায় এমন একজনকে বিয়ে করতে চাইবো যে এখন হেদায়াতের মধ্যে নেই? যদি বিয়ে করে হেদায়াত করাই যেতো তাহলে মারসাদ ইবনু আবূ মারাসাদ আল-গানাবী (রাঃ) কে কেনো তার পূর্ব প্রেমিকাকে বিয়ে করতে নিষেধ করা হয়েছিলো? তিনি তার প্রেমিকাকে বিয়ে করে হেদায়াত করাতে পারতেন না? ইসলামের পথে আনতে পারতেন না? যদি হেদায়াত করা যেতো তাহলে অবশ্যই রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে অনুমতি দিতেন। কিন্তু অনুমতি দেওয়া হয়নি বরং আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) সূরা আন-নূরের আয়াত নাযিল করে নিষেধ করেছিলেন। [আবু-দাউদ, ২০৫১]

যদি বিয়ে করে হেদায়াত করা আমাদের হাতে থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের আদেশ করা হতো কাফির, মুশরিক, পথভ্রষ্টদের বিয়ে করার জন্য। বিয়ে করে তাদের সঠিক পথে আনার জন্য। কিন্তু আমাদের শরীআতে এইরকম কোনো রুলিং নেই। একজন মানুষ কতোটুকু দ্বীনদার আমি তা দেখে বিয়ে করবো। এই আশায় বিয়ে করবোনা সে ভবিষ্যতে কতোটুকু বদলাবে। কারণ সে যদি ভবিষ্যতে নিজেকে পরিবর্তন না করে তাহলে ভুগতে হবে আমাকে। সে নামাজ পড়বে না, মেয়েদের নিয়ে ঘুরবে, বিদআত করবে, সুদ নিবে, আমাকে পর্দা করতে না দিয়ে তার বন্ধুদের সামনে নিতে চাইবে এসব মেনে নিয়ে তার সাথে থাকা সম্ভব হবেনা। আর তখন যদি আমি তার সাথে থাকতে না চাই, আলাদা হয়ে যেতে চাই তখন দোষ না করেও দোষী আমাকেই হতে হবে।
"মেয়ে হয়ে ডিভোর্স দিয়েছে! সাহস কতো!"
"মেয়েদের একটু সহ্য ক্ষমতা না থাকলে এমনই হয়।"
"ইসস, কুরআন হাদিসের কথা বলে কিন্তু স্বামীর কথা শুনে চলে না। ভন্ড!"
"নিশ্চয়ই চরিত্রে দোষ আছে। গিয়ে দেখো ছেলে নিজেই ছেড়ে দিয়েছে। দোষ ঢাকতে নিজে আগে আগে চলে এসেছে।"
এই কথাগুলো তাদের মুখ থেকেই বের হবে যারা এখন বলছে বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাবখানা এমন যনো তারা গায়েব জানে! আস্তাগফিরুল্লাহ।

হেদায়াত করে নেওয়ার কথা যারা বলে তারা নিজেরাই নিজের জীবনসঙ্গীকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়াতে পারেনি, দাঁড়ি রাখাতে পারেনি, হারাম থেকে দূরে আনতে পারেনি। উল্টো নিজেরাই নানা রকম হারামে ডুব দিয়েছে! অদ্ভুত তাই না? আমার মনে হয়, একজন ছেলে যতোটা অন্যের ভাবনার জগতে ঢুকে ভাবনার পরিবর্তন করাতে পারে একজন মেয়ে তা পারেনা। মেয়েরা অনেক সহজে নিজেদের চিন্তার জগৎ পরিবর্তন করে ফেলে অন্য কারো সঙ্গ পেলে। অর্থাৎ, মেয়েদের ভাবনার জগতকে পরিবর্তন করতে পারার ক্ষমতা ছেলেদের আছে। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় বিয়ের পর স্বামীর অনেক একটিভিটি স্ত্রীর মধ্যে চলে আসে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি আমার এক দ্বীনি বোনের কথা। যে বিয়ের আগে সঠিকভাবে দ্বীনের পথে ছিলো কিন্তু বিয়ের পর তা আর ধরে রাখতে পারেনি। স্বামীর পথ ধরেছিল। আফসোস! আমার নিজের দেখা এমন আরও অনেক উদাহরণ আছে৷

আরও শুনতে হয় নামাজী ছেলে বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়? নামাজী ছেলেরা কি দ্বীনদার না? জি, সমস্যা আছে একটু৷ সমস্যাটা হলো সব নামাজী ছেলে আমাদের পছন্দ মতো হয় না! যেমন, এমন অনেক নামাজী ছেলে আছে যারা নামাজ পড়ে আলহামদুলিল্লাহ, কিন্তু তারা পর্দা করে চলা জীবনসঙ্গী খুঁজে না। বিশ্বাস হচ্ছে না? আমার পরিচিত একজনের জন্য এমনই এক ধার্মিক পরিবার থেকে প্রস্তাব এসেছিল! তাদের মতে পাত্রী বাড়াবাড়ি রকমের পর্দা করে। তারা ঘরে-বাইরে পর্দা করে, চাকরি করে বা করবে এমন কাউকে খুঁজছে!!
যাই হোক, নামাজী অনেক ছেলে আছে যারা বিদআতে লিপ্ত, হারাম সম্পর্কে জড়িত, নজর সংযত করতে অক্ষম, অশালীন কথা বলে, পীর বলতে অজ্ঞান! আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। রমজানে এক রাজমিস্ত্রীকে দেখেছিলাম। কপালে কালো দাগ হয়ে আছে যা সিজদার চিহ্ন, দাঁড়ি, টুপি, পাঞ্জাবি পরা। মাশাআল্লাহ। রোজার সময় তাকে একপাশে গিয়ে সিগারেট ফুঁকতে দেখেছি! দ্বীনদার মানে শুধু নামাজী বুঝানো হয়না৷ দ্বীনের সঠিক জ্ঞান সম্পন্ন মানুষদের বোঝানো হয়। তাই নামাজ পড়ে এট্টুক দেখেই বিয়ে করবোনা। নামাজ অবশ্যই পড়তে হবে৷ নামাজ অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নামাজ পড়ার সাথে সাথে ইসলাম সম্পর্কে আরও কিছু পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে।

যাই হোক, আমি দ্বীনের পথে আসার পর আমার পরিবারকেই আজও হেদায়াত করতে পারলাম না। এতো বছরের সম্পর্ক যাদের সাথে তারাই যখন আমার সান্নিধ্যে পরিবর্তন হয়নি তখন একজন অচেনা মানুষ আমার কথা মতো নিজেকে বদলে ফেলবে, তা আমি কিভাবে আশা করতে পারি?

আমাদের চাহিদা খুবই সীমিত। একজন দ্বীনদার জীবনসঙ্গী, যার আখলাক সুন্দর, আকীদা বিশুদ্ধ, দ্বীনের দাওয়াহ দেওয়ায় সক্রিয়, মোটামুটি চলার মতো ইনকাম আছে ইত্যাদি। খুব কম দ্বীনি বোন হয়তো বিলাসবহুল জীবন চায়। আমি এমন কাউকে দেখিনি যে দ্বীনদার এবং সে বিলাসিতা পছন্দ করে। কিন্তু এই অল্প চাহিদা নিয়েও বছরের পর বছর সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটার আগমনের জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু তার দেখাতো মিলে না!

আমাদের বিয়ে না হওয়ার পিছনে আমাদের পরিবার অনেকাংশে দায়ী। পরিবারের নজর শুধু ছেলে কতো টাকা ইনকাম করে, কোথায় পড়াশোনা করে, ছেলের বাড়ি কেমন ইত্যাদি দুনিয়াবি চিন্তায় সীমাবদ্ধ। খুব কম পরিবারের মানুষই দেখে ছেলে কতোটুকু দ্বীনদার! আমাদের দেশে হয়তো ১০% ও হবেনা এমন পরিবারের সংখ্যা। এতো এতো দুনিয়াবি চাহিদার মাঝে আমাদের মনে গড়ে উঠা সুপ্ত অল্প কিছু চাহিদাগুলোকে দাফন করা হয়। ফলাফল হয় ভয়ংকর। হতাশা, কান্না, বিয়ের প্রতি একসময় অনীহা চলে আসা, বয়স বেড়ে যাওয়া, আত্মীয়দের কটু কথা আরও কতো কি! ভিক্টিম কিন্তু আমরাই হচ্ছি। না এই সমাজের কিছু হচ্ছে, না আমাদের পরিবারের। দিনশেষে ভুক্তভোগী হচ্ছি আমরা।

কাউকে বিয়ে করে পরিবর্তন করে নিতে পারবো এমন আত্মবিশ্বাস আমার নেই। তাই আমি ভুল কাউকে বিয়ে করে তাকে শুধরে নেওয়ার মতো দুঃসাহস দেখাচ্ছি না। দয়া করে কাউকে এই ঝুঁকি নিতে উৎসাহ দিবেন না। কারণ কিছু হলে তখন "যা হয়েছে তার জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়" বলে লেজ গুটিয়ে দৌড় দেওয়া মানুষদের মধ্যে আপনারা অন্যতম!

[বি.দ্র: লেখাটার মূলভাব হলো সমাজের একটা ভুল ধারণা ক্লিয়ার করা। এটা কোনো বিতর্ক করার টপিক নয়। তাই মূলভাব না বুঝে অযথা কমেন্ট করা হতে বিরত থাকুন।]

পঠিত : ৪৬১ বার

মন্তব্য: ০