Alapon

রোহিঙ্গা শিশুদের প্রতি আরো নজর দিতে হবে



মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নৃশংস সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে রক্ষা পেতে তিন বছর আগে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা, এদের মধ্যে প্রায় ৫ লাখ শিশু, তাদের সবকিছু ত্যাগ করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ২৫ আগস্ট তাদের নিজ দেশ থেকে জোরপূর্বক নির্বাসনের তৃতীয় বর্ষপূর্তি হচ্ছে।

তিন বছরে অনেক মাইলফলক অতিক্রম করেছে। ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে ৭৫ হাজারের বেশি শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। এসব শিশু প্রথম যে মাটিতে পা ফেলেছে, সেটিকে তারা নিজেদের বলে ডাকতে পারে না, যারা প্রথম যে শব্দটি বলেছে, তা তাদের ভাষায় বিদেশী।

মিয়ানমার সম্পর্কে তারা যা কিছু শিখেছে, সবই দ্বিতীয় মাধ্যমে, তথা তাদের মা-বাবার কাছ থেকে। এসব শিশু কক্সবাজারের ঘিঞ্চি এলাকার জীবনই কেবল চেনে।

তবে এটি একটি কাহিনীর অর্ধেক অংশ মাত্র। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারেও ৩০ হাজারের বেশি শিশু (বেশির ভাগই রোহিঙ্গা ও কিছু কামান) ২০১২ সাল থেকে ২১টি ক্যাম্পে জন্মগ্রহণ করেছে। এসব পরিবার অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত ও নির্যাতনে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

এসব ক্যাম্পের কয়েকটি এখন বন্ধ করে দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে এসব লোকের ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছুই এখন পর্যন্ত না বলায় সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে।

যে পরিবেশে এক লাখের বেশি শিশু বসবাস করছে তা তাদেরকে রক্ষা করা ও পরিশেষে তাদের বাড়ি হিসেবে অভিহিত করার স্থানে তাদের ভবিষ্যত নির্ধারণ করার দায়িত্বটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতাকেই প্রতিফলিত করছে।

রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল বিষয় হলো এসব শিশুকে তাদের বাড়ি ফেরানো তথা তাদের উদ্বাস্তু জীবনের অবসান করা। তারা যে বৈষম্য, সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে তার অবসান ঘটানো।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই কক্সবাজার ও রাখাইন রাজ্যে মানবিক প্রয়াস অব্যাহত রাখার জন্য তহবিল প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য সুযোগ, সুবিধা না দিয়ে রোহিঙ্গা শিশুদের সম্পর্কে ইতিবাচক কথা বলার কোনো মানে হয় না।

এই সমাধানের আরেকটি অংশ হলো রোহিঙ্গাদের ওপর করা অপরাধের ন্যায়বিচার। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের লজ্জাজনক নিষ্ক্রিয়তার ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীরা স্বাধীনভাবে থাকতে পারছে।

আমরা যখন রোহিঙ্গা শিশুদের সাথে কথা বলি, তখন তারা আমাদের বলে যে তারা বাড়ি যেতে চায়, তারা স্কুলে যেতে চায়, তাদের বন্ধু ও পরিবারের সাথে সাক্ষাত করতে চায়, তারা তাদের ও তাদের প্রিয়জনদেরকে নিরাপদ দেখতে চায়।

আমরা শিশুদেরকে বড় স্বপ্ন দেখতে শিক্ষা দেই। কিন্তু যে শিশু উদ্বাস্তু শিবির ছাড়া তার জীবনের আর কিছুই জানে না, তাদের অনেকের আশা ও স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যাবে। আর যারা এর জন্য দায়ী তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় না আনতে পারলে রোহিঙ্গা শিশুদের স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে।

কোভিড-১৯ মহামারি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রকটভাবে সমাধান খুঁজে পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। কারণ রোহিঙ্গা শিশুরা সারা জীবনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে পারে না। কক্সবাজার ও রাখাইন রাজ্য- উভয় স্থানে লকডাউন জারি করা হয়েছে করোনাভাইরাস বিস্তার প্রতিরোধ করার জন্য। এতে তাদের অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে, তাদের দৈনন্দিন জীবনের অতি জরুরি পরিষেবায় তা প্রভাব বিস্তার করছে।

বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে সঙ্ঘাতের কারণে রাখাইন রাজ্যের অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে। আর তা শিশু ও তাদের পরিবারগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর অবসানের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।

সহিংসতা ও এই মহামারি থেকে শিশু ও তাদের পরিবারগুলোকে রক্ষার জন্য সেভ দি চিলড্রেন সীমান্তের উভয় পাড়ে কাজ করে যাচ্ছে। কক্সবাজারে করোনাভাইরাস চিকিৎসা করার এক কেন্দ্রও পরিচালনা করছে।

বর্তমান স্থিতিবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়, টেকসইও নয়। বিশ্বনেতাদের, বিশেষ করে যারা মিয়ানমারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখছে, তাদেরকে অবশ্যই এ সঙ্কট দ্রুত সমাধানের জন্য কাজ করতে হবে। আমরা বছরের পর বছর পার হতে দিতে পারি না, এই শিশুদের পুরো শৈশব ক্যাম্পে কাটাতে বাধ্য করতে পারি না।

আমরা রোহিঙ্গা শিশুদের অধিকার আদায়ের জন্য আমাদের কথা বলেই যাব। এই প্রয়োজন না মেটা পর্যন্ত আমরা আমাদের কাজ করা অব্যাহত রাখব। আর জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ, আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে নাজুক শিশুদের সুরক্ষার তাদের দায়িত্ব পালন না করবে তত দিন তা করে যাওয়া দরকার।

পঠিত : ১০১০ বার

মন্তব্য: ০