Alapon

মানবতা আর বিবেকের হাহাকার . . . .

বাবা দুটি টাকা হবে। টাকা দিয়ে বললাম কিছু খাবেন? অস্ফুট স্বরে ভাত খাব বাবা! ৫ জনের চায়ের দাম মিটিয়ে বুড়িমাকে নিয়ে গেলাম হোটেলে। কি খাবেন? ডিম টিম হলেই হবে বাবা। ডিম না থাকায় রুই মাছ দিয়েই খেলেন। আমি বেচারা সামনে বসে বুড়িমাকে দেখছি আর জানলাম তার ইতিহাস।

ছকিনা বেগম। ৭০ এর কাছাকাছি বয়স। দুনিয়াতে একমাত্র ৭ বছরের নাতি ছাড়া আর কেহ নাই। বাসার ঠিকানা মতিঝিল সিটি সেন্টারের পিছনে। খোলা আকাশের নিচে তার প্রিয় দেশ। অতিতের বাড়ি এখন নদিতে সলিল সমাধি ঘটেছে।

ভাত খাওয়া শেষ। অদ্ভুদ্ভাবে হাত উঠিয়ে দুয়া করলেন বিড়বিড় করে। তারপর কি যেন দুয়া পড়লেন। অবশেষে রাতের খাবারের জন্য যখন ২০ টাকা হাতে দিয়ে বিদায় চাইলাম, তখন বলল, বাবা ! তোমার নাম কি? মুহাম্মাদ.... আমি তার কথার স্বরে মিলিয়ে বললাম মুহাম্মাদ আলম।

বুড়িমাকে বিদায় দিয়ে ভাবছিলাম ! আল্লাহ আমাকে কত ভাল রেখেছি। আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু কি করতে পারছি তাদের জন্য? একটু ভাল ব্যবহারও তো আমাদের করতে কষ্ট হয়। গরিব অসহায় মানুষকে তুই থেকে তুমি পর্যন্ত বলতে পারিনা। অথচ রাসুল বলেছেন, যদি তুমি তোমার হৃদয় নরম করতে চাও তাহলে দরিদ্রকে খাবার খাওয়াও এবং এতিমের মাথা মুছে দাও। আর আমরা ???

কে জানে খোল আকাশের নিচে কত মানুষ আছে এভাবে? গরিবের চোখে চোখ রাখতে পারিনা। বড্ড মায়া হয়। এ পর্যন্ত অনেক কে দেখেছি কান্না করতে। অজান্তেই অশ্রু বেরিয়েছে। নিরবে হাত তুলে দোয়া করেছি। কেউ স্বামী হারা, বাপ-মা হারা, কেউ আদরের ছেলেমেয়ে হারা, কারো অাবার কেউ নেই পৃথিবীতে।

পরিসংখ্যান কি বলেঃ
২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক জানায়, ৫ ডলারের নিচে থাকা বিশ্ব দরিদ্র মমানুষের সংখ্যা ৪০০ কোটি। গোটা বিশ্বে ৩ বেলা না খেতে পারা মানুষের সংখ্যা ১০০ কোটিরও বেশি। ২০১৬ সালের প্রথম আলো জানায়, দেশে অতিদরিদ্রের সংখ্যা ৩ কোটি ৮৫ লাখ। দেশে ৩ কোটি মানুষ ৩ বেলা খেতে পারে না। পুষ্টিমান অনুযায়ী খেতে পারেনা ৮ কোটি মানুষ। অথচ অক্সফার্ম চ্যারিটির মতে, বিশ্বে ১ শতাংশ মানুষ সম্পদ দিয়ে নিয়ন্ত্রন করে বাকি ৯৯ শতাংশ মানুষকে। সম্পদ আর কারে কয়??

মানুষ কি বুঝতে পারেনা একটা নিরব হাহাকার চলে সমাজের অভ্যন্তরে? তাইতো নজরুল ভাই বলেছেন, হে দরিদ্র তুমি মোরে কিরেছো মহান। আমরা কতজন পারি তাদের মুখে হাসি ফুটাতে? তাদের দুখের সাথে নিজেদের দুখকে ভাগ করে নিতে। আসলেই পারি কি? একটু প্রশ্ন রাখি বিবেকের কাছে??

সমাজের প্রতি প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে অাছে অযশ্র গরীব অসহায় মানুষ। আমরা দাবি করি আমরা মুসলমান । কিন্তু আমরা জানি কি গরীব ও এতিম সম্পর্কে ইসলাম কি বলে??  

কোরআন বলে:
‘নিশ্চয়ই যারা অন্যায়ভাবে এতিমের ধন-সম্পদ ভোগ করে,তারা নিজেদের পাকস্থলীকে অগ্নি দ্বারা পূর্ণ করে এবং অতিসত্বর তারা অগ্নিতেই প্রবেশ করবে।‘ (সূরা আন-নিসা, আয়াত-১০)
 
‘আর এতিমদের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখবে, যে পর্যন্ত না তারা বিয়ের বয়সে পৌঁছে। যদি তাদের মধ্যে বুদ্ধি-বিবেচনা দেখা যায়, তাহলে তাদের সম্পদ তাদের হাতে অর্পণ করতে পারবে। এতিমের সম্পদ প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করো না অথবা তারা বড় হয়ে যাবে মনে করে তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলো না। যখন তাদের কাছে তাদের সম্পদ তাদের হাতে হস্তান্তর করবে তখন সাক্ষী রাখবে। অবশ্যই আল্লাহ হিসাব নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।‘ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬)

‘তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, কী তারা ব্যয় করবে? বলে দাও যে বস্তুই তোমরা ব্যয় করো, তা হবে বাবা-মায়ের জন্য, আত্মীয়-আপনজনদের জন্য, এতিম-অনাথদের জন্য, অসহায়দের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। আর তোমরা যেকোনো সৎ কাজ করবে, নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত ভালোভাবেই আল্লাহর জানা রয়েছে।’ (সূরা-বাকারা, আয়াত : ২১৫)।

সুতরাং আপনি এতিমের প্রতি কঠোর হবেন না।’ (সূরা-আদ দুহা, আয়াত : ৯)। ‘আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচার দিবসকে মিথ্যা বলে? সে সেই ব্যক্তি, যে এতিমকে গলাধাক্কা দেয়।’ (সূরা-আল মাউন, আয়াত : ২)। কুরআনের এ আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায়, এতিমের হক রক্ষা করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।


হাদিস বলেঃ
হাদিসে রাসুল সা. বলেন, মুসলিমদের ওই বাড়িই সর্বোত্তম যে বাড়িতে এতিম রয়েছে এবং তার সাথে ভালো ব্যবহার করা হয়। সবচেয়ে নিকৃষ্ট ওই বাড়ি যে বাড়িতে এতিম আছে, অথচ তার সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয়। অত:পর তিনি তার আঙ্গুলির মাধ্যমে বললেন, আমি এবং এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এমনভাবে অবস্থান করব। [ইবনে মাজাহ]

এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তার অন্তর কঠিন মর্মে অভিযোগ করলেন। নবী সা. তাকে বললেন, যদি তুমি তোমার হৃদয় নরম করতে চাও তাহলে দরিদ্রকে খাবার খাওয়াও এবং এতিমের মাথা মুছে দাও। (মুসনাদে আহমাদ) অপর হাদিসে রাসুল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো ছেলে অথবা মেয়ে এতিমের মাথায় একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে হাত বুলিয়ে দেয়, মাথার যত চুল দিয়ে তার হাতটি অতিক্রম করবে তার তত সওয়াব অর্জিত হবে। আর এতিমের প্রতি সে যদি ভাল ব্যবহার করে তাহলে এই দুই আঙ্গুলের ন্যায় সে এবং আমি জান্নাতে অবস্থান করব। রাসূলুল্লাহ তাঁর দুই আঙ্গুলকে মিলিয়ে দেখালেন। (মুসনাদে আহমদ)

আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিজেও একজন এতিম ছিলেন। তাই তিনি এতিমের দুঃখ-কষ্ট অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পেরেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এতিমদের মাথায় শুধু আল্লাহর উদ্দেশ্যে হাত বুলায়, তবে যেসব চুলের ওপর দিয়ে হাত বুলিয়েছে তার প্রত্যেকটি চুলের বিনিময়ে কয়েকটি করে নেকি লাভ করবে।

এমনি আরো অনেক হাদিস ও কোরআন পাওয়া যাবে যেখানে এতিম ,গরিবের হক সম্পর্কে ইসলাম স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছে। আমরা কি আসলেই গরিবের হক কিংবা তাদেরকে ভালবাসতে পারছি???? প্রশ্ন বিবেকের কাছে? প্রশ্ন মুসলিম নামধারী মানুষের কাছে? একটু আত্নপর্যালোচনা করার সময় কি আমাদের হবে????

সম্পদ ব্যায়ে করনীয়ঃ
যাদের সম্পদ আছে তারা আবার অনেকে জানেনা সম্পদ ব্যায় কোথায় করতে হবে? না জেনে অনেক ভীন্ন খাতে খরচ করে। এতে বরং লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশী হয়। সম্পদ কোথায় ব্যয় করতে হবে? এ সম্পর্কে কোরআন বলে,

সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ করবে; বরং বড় সৎকাজ হলো এই ঈমান আনবে আল্লাহর ওপর, কিয়ামত দিবসের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর এবং সব নবী-রাসূলের ওপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্মীয়স্বজন, এতিম-মিসকিন, মুসাফির-ভিুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্যধারণকারী, তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী আর তারাই পরহেজগার।’ (সূরা-বাকারা, আয়াত-১৭৭)।

প্রত্যাশা রাখিঃ
আমাদের বিবেককে জাগ্রত করি। একটা নতুন স্বপ্ন বুনি নিজের আঙ্গিনায়। সে স্বপ্ন সাজাই ভালবাসার অমীয় সুধায়। নিজের মনুষ্যত্ব পরিবর্তন করি সমাজ বদলে যাবে। স্কলার রুমি বলতেন, when i was cleaver, i want to change world. Now i am wisdom, i want to change myself. আসুন ব্যাক্তি পরাবর্তনের মাধ্যমে একটা সুন্দর সমাজ উপহার দিই। তৈরী হোক একটা নতুন সমাজ। আমরা বিশ্বাব করি একটি ভয়ংকর নতুন সমাজের। আর পত্যাশা করি ইংরেজ কবির মত, a terrible beauty will come and must come. একটা ভয়ংকর সুন্দরের জন্ম হবে এবং হবেই  .... । সে প্রত্যাশায় . .

আমার ব্যাক্তিগত সাইট: http://www.swapnerghuri.com

পঠিত : ১৫৪৭ বার

মন্তব্য: ০