Alapon

ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা কি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সুদ খায়...?



১. কোরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী ইসলামী অর্থনীতিতে সুদ নিষিদ্ধ হয়েছে এবং খেলাফত এর শাসন ব্যবস্থা এবং ইসলামী সাম্রাজ্যে ১৩০০ বছর ধরে সুদের কোন প্র্যাকটিস ছিল না। কিন্তু বর্তমান অর্থনীতিতে প্রত্যেকটি স্তরে সুদ রয়েছে। তাহলে সুদবিহীন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কীভাবে প্রচলন করা যায় ? এ সম্পর্কে পূর্বেই বলা হয়েছে এটি করা সম্ভব, তবে যথেষ্ট সম্পদ, মেধা, জ্ঞান, গবেষণা এবং পরিশ্রমের প্রয়োজন।

২. যা একবার হয়েছে, তা পুনরায় করা সম্ভব। একসময় প্রায় ১৩০০ বছর পৃথিবীর অর্ধেক স্থানে সুদবিহীন অর্থনীতি কার্যকর ছিল। ইয়াহুদীরা যেখানে খৃস্টান বিশ্বে সুদকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়, সেই সময়ে মুসলিম বিশ্বে সুদ ছিল না, যা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু রাজ্য হারা মুসলিমরা যখন জ্ঞান বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়ল, বিজাতীয় শিক্ষা গ্রহণ করল, বিজাতীয় শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবিরা অন্ধভাবে পাশ্চাত্যের অনুকরণ করা শুরু করল, রাষ্ট্রনায়করা ইউরোপ ও আমেরিকা বা রাশিয়ার তল্পিবাহক হলো, খৃস্টান পাদ্রীদের মত আলেম সমাজের সৃষ্টি হলো যারা মনে করে ধর্মীয় বিষয়ে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে কিন্তু অন্য কোন বিষয়ে তারা থাকবে না এবং সর্বোপরি জনগণ হলো ভোগবাদী তখনই মুৃসলিম সমাজে সুদ, মদ, ব্যভিচার, ঘুষ সবই বৈধ হওয়া শুরু হলো।

তবে আশার কথা হলো অন্ধকার যুগ হতে মুসলিমরা আবারও আলোর পথে ফিরে আসছে। কারণ তাদের কাছে যে জ্যোতির্ময় গ্রন্থ আল কোরআন এবং রাসুল (সাঃ) সুন্নাহ রয়েছে, তা ইসলামী স্কলার দ্বারা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হচ্ছে। সেই সাথে ইসলামী স্বর্ণযুগের লেখা বইগুলোও বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছে। ফলে বিভিন্ন ভাষাভাষী মুসলিম তরুণ-তরুণীরা ইসলামকে জানতে পারছে এবং সেই মোতাবেক জীবন পরিচালনা করার চেষ্টা করছে।

এরই ধারাবাহিকতকা অনুযায়ী ১৯৭৫ সালে দুবাই ইসলামী ব্যাংক, মিশরের মিটগামার ব্যাংক, সৌদি আরবে আল রাজী ব্যাংক (শরীয়াহ ভিত্তিক) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ইসলামী শরীয়াহ এর উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। এজন্যই বলা হয়েছে, পৃথিবীর অর্থনীতি একসময় সুদমুক্ত ছিল, আবারও একসময় সুদমুক্ত হবে।

৩. অনেকের ম‌নে প্রশ্ন সৃষ্টি হয় সুদমুক্ত ব্যাংকিং কীভাবে জনগণের অর্থ সংগ্রহ করবে ? সুদি ব্যাংকিং সুদের লোভ দেখিয়ে জনগণের অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। সেখানে ইসলামী ব্যাংকিং-এ যেখানে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে কীভাবে জনগণ তাদের অতিরিক্ত সম্পদ রাখবে ?

(ক) ইসলামী অর্থনীতিতে সুদ নিষিদ্ধ। তাই এখানে কোন সুদি ব্যাংক থাকবে না। তাহলে যাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আছে, সম্পদের নিরাপত্তার জন্য তারা কোথায় সম্পদ রাখবে ? হয় ঘরে অথবা ব্যাংকে আমানত হিসেবে সম্পদ রাখতে হবে। ব্যাংকে আমানত হিসেবে সম্পদ রাখা হলে ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী ব্যাংক সেই সম্পদ বিনিয়োগে ব্যবহার করতে পারবে না। ফলে এই সম্পদ ব্যাংকে অলস পড়ে থাকবে এবং নতুন কোন সম্পদ সৃষ্টি করতে পারবে না।

খ) ধরুন একজন ব্যক্তি ব্যাংকে ১ কোটি টাকা আমানত হিসেবে রাখল। যেহেতু সে সম্পদ আমানত হিসেবে রেখেছে, সেহেতু এই সম্পদ নিরাপত্তাসহ রাখার জন্য ব্যাংককে বছর শেষে একটি সার্ভিস চার্জ প্রদান করতে হবে। কিন্তু বছর শেষে ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী তার ১ কোটি টাকা সম্পদ হতে ২.৫% যাকাত কর্তন করা হলে তার সম্পদের পরিমাণ হবে ৯৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। পরের বছর ৯৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার উপর ২.৫% যাকাত আদায় করা হলে তার সম্পদের পরিমাণ হবে ৯৫ লক্ষ ৬ হাজার ২ শত ৫০ টাকা। এভাবে দুবছরেই যাকাত বাবদ তার সম্পদের পরিমাণ (২,৫০,০০০ + ২,৪৩,৭৫০) = ৪,৯৩,৭৫০/- টাকা কমে যাচ্ছে এবং পর্যায়ক্রমে মোট সম্পদের ২.৫% যাকাত বাবদ আদায় করা হলে তা কমতেই থাকবে।

(গ) আল্লাহপাকের যাকাত এর বিধান প্রতিবছর ঐ ১ কোটি টাকা সম্পদধারী ব্যক্তির সম্পদের পরিমাণ কমিয়ে দেবে। তখন ঐ ব্যক্তি তার সম্পদকে বৃদ্ধি করার জন্য এটিকে গতিশীল করতে বাধ্য হবে। অর্থাৎ এখন ব্যক্তি নিজেই চাইবে তার সম্পদকে গতিশীল করার জন্য। আর সব অর্থনীতিবিদ স্বীকার করেছেন সম্পদ গতিশীল হলেই অতিরিক্ত সম্পদের সৃষ্টি হয়। আপনি ১ কোটি টাকা ব্যাংকে অলস ফেলে না রেখে একটি কারখানা করুন। সেখানে কিছু লোকের কর্মসংস্থান হবে, পণ্য উৎপাদিত হবে এবং সমাজের আয়ের পরিমাণ তথা সম্পদের পরিমাণ বাড়বে। এজন্যই আল্লাহপাক কোরআনে বলেছেন “যে যাকাত তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে দিয়ে থাকো, তা প্রদানকারী আসলে নিজের সম্পদ বৃদ্ধি করে” সূরা রূম-৩৯। কোরআনের এই আয়াতটি সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ হতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, যাকাত সম্পদ অলস ফেলে রাখতে দেয় না। কারণ সম্পদ অলস ফেলে রাখলে যাকাত প্রতিবছর ঐ সম্পদের পরিমাণ কমিয়ে দেবে। তাই যাকাত বাধ্য করে সম্পদকে গতিশীল করতে। এজন্যই মহাজ্ঞানী আল্লাহপাক সুদ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি যাকাত আদায় করাকে বাধ্যতামূলক করেছেন এবং যাকাত সম্পদকে গতিশীল করে সমাজের মোট সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

(ঘ) যেহেতু যাকাত সম্পদকে গতিশীল করতে বাধ্য করে, সেহেতু সম্পদকে গতিশীল করার জন্য আমাদের উদাহরণে ১ কোটি টাকা সম্পদের মালিক যদি নিজে ব্যবসা করার ক্ষমতা বা যোগ্যতা না রাখেন, তবে তিনি কোন কোম্পানির প্রাথমিক শেয়ার ক্রয় করবেন। আর যদি কোন কোম্পানির প্রাথমিক শেয়ার ক্রয় না করেন, তবে ব্যাংকে মুদারাবা পদ্ধতিতে ১ কোটি টাকা জমা রাখবেন। মুদারাবা হলো ব্যবসা কাজে একজন মূলধন সরবরাহকারী হবে এবং অপরজন তার মেধা ও শ্রম প্রদান করবে। এক্ষেত্রে মূলধন সরবরাহকারীকে সাহিব-আল-মাল এবং ব্যবসা পরিচালনাকারীকে মুদারিব বলা হয়। ইসলামী ব্যাংকিং এ মুদারাবা পদ্ধতিতে গ্রাহকের টাকা জমা রাখলে গ্রাহক হবেন সাহিব-আল-মাল এবং ব্যাংক হবে মুদারিব। ব্যবসায় যদি মুনাফা হয়, তবে চুক্তি অনুযায়ী সাহিব-আল-মাল এবং মুদারিব (ব্যাংক) উভয়ের মধ্যে মুনাফা বন্টিত হবে। কিন্তু ক্ষতি হলে সাহিব-আল-মাল এর মূলধন কমে যাবে এবং মুদারিব তার শ্রম ও মেধার কোন মূল্য পাবে না। যদি মুদারিবের চুক্তি লংঘন এবং অবহেলার কারণে ক্ষতি হয়, তবে ক্ষতির ভার মুদারিবকে বহন করতে হবে। আবার বিনিয়োগ করার সময় ব্যাংক সাহিব-আল-মাল অর্থাৎ মূলধনের যোগানদাতা হয় এবং বিনিয়োগের জন্য ঋণগ্রহণকারী মুদারিব হয়ে থাকেন। দুর্ভাগ্যজনক সত্য যে, শিক্ষার হার কম থাকায় এবং শিক্ষিত শ্রেণি যারা আছেন, তাদের জানার ইচ্ছে খুবই কম থাকায় ইসলামী ব্যাংকিং এর মুদারাবা কার্যক্রম সম্পর্কে সবার মধ্যে স্পষ্ট ধারণা নেই।

(ঙ) এছাড়া ইসলামী ব্যাংকসমুহ ‘আল ওয়াদীয়াহ’ পদ্ধতিতে জনগণের টাকা ব্যাংকে জমা রাখে। এক্ষেত্রে টাকা জমাকারী কোন ধরনের ঝুঁকি গ্রহণ করতে চান না, অর্থাৎ তিনি মুনাফা বা ক্ষতি কোনটাই গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নন, কিন্তু ব্যাংককে তার টাকা ব্যবহারের অনুমতি দেন। ‘আল ওয়াদীয়াহ’ পদ্ধতিতে জমাকৃত টাকা হতে ব্যাংক মুনাফা অর্জন করলে সেই মুনাফর কোন অংশ জমাকারী পাবেন না। আবার ব্যাংকের ক্ষতি হলেও জামাকারীর কোন ক্ষতি হবে না। জমাকারী শুধুমাত্র তার জমাকৃত টাকা উত্তোলন করতে সক্ষম হন। সাধারণত ব্যবসায়ীরা এই পদ্ধতিতে ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন। যুবায়ের ইবনে আওয়াম (রাঃ), ইমাম আবু হানীফা (র.) এই পদ্ধতিতে জনগণের টাকা নিজেদের কাছে রেখে তাদের সম্পদের নিরাপত্তা দিতেন এবং তাদের অনুমতি নিয়ে তাদেরকে কোন ধরনের ঝুঁকি বা অনিশ্চয়তায় না ফেলে ব্যবসা করতেন।

(চ) বিশ্বের প্রতিটি ইসলামী ব্যাংকিং ‘মুদারাবা’ এবং ‘আল ওয়াদীয়াহ’ পদ্ধতিতে জনগণের নিকট হতে তহবিল সংগ্রহ করে থাকে। অথচ কিছু শিক্ষিত লোক ইসলামী অর্থনীতির কোন ধরনের জ্ঞান ছাড়াই বলে দেন, ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা ঘুরিয়ে সুদ খায়। আবার সমাজে আলেম নামধারী কিছু ব্যক্তি আছেন, যারা নামাজে হাত বুকে বাধঁবেন না নাভীর নীচে বাাঁধবেন, জোরে আমীন বলবেন, না আস্তে আমীন বলবেন, এর আকীদা আছে, না নাই এগুলো নিয়ে বিতর্কে ব্যাস্ত থাকেন, মসজিদ আলাদা করেন, তারাই সুদী ব্যাংকে টাকা রেখে বলেন ইসলামী ব্যংকসমূহ ঘুরিয়ে সুদ খায় ! অথচ পৃথিবীর সমস্ত ইসলামী ব্যাংকের শরীয়াহ বোর্ড আছে এবং যারা শরীয়াহ বোর্ডে প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাদের ধারে-কাছে যাওয়ার যোগ্যতা এসমস্ত নামধারী আলেমদের নেই।

৪. ‘ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা ঘুরিয়ে সুদ খায়’ - বক্তব্যটি কতটুকু সঠিক? এ বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। আলোচনার পূর্বে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে বর্তমান জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতি সুদের ভিত্তিতে প্রচলিত আছে। এ অবস্থায় ইসলামী স্কলাররা সুদবিহীন অর্থনীতি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হিসেবে ইসলামী ব্যাংক নিয়ে যে কার্যক্রম শুরু করেছেন, তা বাস্তবায়ন করা খুব সহজ কাজ নয়। চারিদিকে সুদভিত্তিক লেনদেন থাকার কারণে ইসলামী ব্যাংক সমুহের কিছু লেনদেন সন্দেহযুক্ত লেনদেনের মধ্যে পড়তে পারে, তা ইসলামী স্কলাররা স্বীকার করেন। ইসলামী ব্যাংকিং প্রসারের সাথে সাথে একপর্যায়ে এটি ১০০% শরীয়াহভিত্তিক লেনদেনে পৌঁছাবে। কিন্তু নিন্দুকেরা সেই সময়ের অপেক্ষা না করেই ইসলামী ব্যাংকের যে দূর্বলতাগুলো রয়েছে সেগুলো জনসমক্ষে হাইলাইট করে বলছে, ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা ঘুরিয়ে সুদ খায়!

(ক) প্রথম কথা হলো ইসলামী ব্যাংকে জনগণ ‘সাহিব আল মাল’ হিসেবে সম্পদ রাখে এবং ব্যাংক ‘মুদারিব’ হিসেবে সেই সম্পদকে কাজে লাগায়। এখানে ব্যাংকের সাথে জনগণের লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে চুক্তি হয়। জনগণ যখন প্রচলিত সুদী ব্যাংকে সম্পদ জমা রাখেন সেখানে কি ব্যাংকের সাথে জনগণের লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে চুক্তি হয় ? নিঃসন্দেহে না। সোজা বলে দেয়া হয়, আপনি বছর শেষে ৮% সুদ পাবেন। তাহলে আপনারাই বলুন জনগণের সাথে প্রচলিত সুদী ব্যাংক এবং ইসলামী ব্যাংকের চুক্তি, কোনটি শরীয়াহ সম্মত ? ধরে নেয়া হলো ইসলামী ব্যাংক শরীয়াহ এর কথা বলে ঘুরিয়ে সুদী ব্যবসা করে এবং সুদের একটি অংশ তার সাথে চুক্তিবদ্ধ জনগণকে প্রদান করে। ইসলামী ব্যাংকের এই জালিয়াতির কারণে কিয়ামতের ময়দানে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, শরীয়াহ বোর্ডের আলেমরা এবং ব্যাংক কর্মকর্তারা দায়ী থাকবেন। কিন্তু জনগণ তো দায়ী থাকবেন না, কারণ তাদের ধোকা দেয়া হয়েছে। কিন্তু যে জনগণ সুদী ব্যাংকের সাথে স্বজ্ঞানে নির্দিষ্ট সুদের ভিত্তিতে টাকা জমা রাখে, তবে সেই জনগণ আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবে ? অবশ্য আপনি যদি পরকাল বিশ্বাস না করেন, তবে আপনার জন্য সুদী ব্যাংক হলো আদর্শ ব্যাংক!

(খ) সব ব্যাংকের প্রধান ব্যাংক হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা প্রতিটি ব্যাংককে মেনে চলতে হয়। আপনি যদি ইসলামী ব্যাংকিং এর অনুমোদন নেন, তবে আপনি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ এর ইসলামী উইং এর নীতিমালার বাইরে যেতে পারবেন না। তাহলে ইসলামী ব্যাংক যদি ঘুরিয়ে সুদ খায়, তবে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ কী করে থাকে ? তাদের চোখে কি এটি ধরা পড়ে না ? বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি তরল সম্পদ ইসলামী ব্যাংকে থাকে। অন্যান্য ব্যাংকে তারল্য ঘাটতি থাকে। ইসলামী ব্যাংক যদি ঘুরিয়ে সুদ খেত, তবে অন্যান্য ব্যাংক এই অভিযোগ বাংলাদেশে ব্যাংক এ প্রদান করে ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারত। কিন্তু দেখা যায় পুরো উল্টো চিত্র। প্রতিটি সুদী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং এর জন্য তাদের আলাদা উইং খুলছে! আজকে সোনালী, জনতা ইত্যাদি ব্যাংকের ইসলামী উইং রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের এই বিজয় দেখে অনেকেরই মাথা খারাপ। আশা করা যায় একসময় বাংলাদেশের প্রতিটি সুদী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং এ চলে আসবে এবং এ সমস্ত ব্যাংকে যারা চাকুরি করবে, তারা মনে প্রশান্তি নিয়ে চাকুরি করতে পারবে।

(গ) আপনি সুদী ব্যাংকে ১ বছরের জন্য টাকা রাখলেন। ব্যাংক আপনাকে ৮% সুদ দেবে বলেছে। আপনি আরও কিছু টাকা ইসলামী ব্যাংকে রাখার জন্য গেলেন। তারা বলল বছর শেষে আপনাকে প্রায় ৭% মুনাফা দেবে। আপনি সাথে সাথে আবিষ্কার করে ফেললেন, ইসলামী ব্যাংক সুদকে মুনাফা নাম দিয়ে ঘুরিয়ে সুদ দেয় এবং সুদের হার প্রচলিত সুদী ব্যাংকের সুদের হার হতে কম! আপনার আবিষ্কারের মধ্যে অনেক ত্রুটি রয়েছে। ত্রুটিগুলো হলো -
(I) টাকা রাখার সময় ব্যাংকের সাথে যে লিখিত চুক্তি হয়েছে, সেটি আপনি ভালো করে পড়ে দেখেননি। শুধু স্বাক্ষর করেছেন। একবারও দেখেননি আপনি মুদারাবার ভিত্তিতে টাকা জমা দিচ্ছেন। আর দেখলেও মুদারাবা শব্দের অর্থের আপনি হয়ত জানেন না। যার ফলে কোন ধরনের জ্ঞান ছাড়াই আপনি আপনার মতামত প্রকাশ করে ফেললেন।
(II) আপনি একেবারে সহজ পদ্ধতিতে ব্যাংক কর্মকর্তাকে বললেন, বছর শেষে কত টাকা পাব ? ব্যাংকে যে কাজের চাপ, সেখানে ব্যাংক কর্মকর্তা আপনাকে ইসলামী শরীয়াহ বুঝানোর দায়িত্ব গ্রহণ করবে না। সে সোজা বলে দেবে প্রায় ৭%। আর আপনি ‘প্রায়’ শব্দটি বাদ দিয়ে বললেন ৭%। অর্থাৎ ৭% নিশ্চিত হয়ে গেল। কিন্তু প্রায় ৭% হলে বছর শেষে ৭.৫ বা ৬% বা ৬.৫% হতে পারে। ইসলামী ব্যাংক যে মুনাফা করে থাকে, তার ৬৬% হতে ৬৮% জমাকারীদের নিকট বন্টন করে। ধরুন ব্যাংকের মুনাফা হলো ১০০ টাকা। এক্ষেত্রে ব্যাংকে টাকা জমাকারীরা পাবে ৬৬ (৬৬% ধরলে) টাকা। যদি জমাকারীদের টাকা ১০০০ টাকা হয়, তবে প্রতি ১০০ টাকাতে মুনাফা পাওয়া যাবে ৬.৬ টাকা অর্থাৎ মুনাফার হার ৬.৬% (বাস্তব হিসেবে বিভিন্ন Weight দেয়ার কারণে হিসেবের মধ্যে জটিলতা আছে)। সোজা কথা ইসলামী ব্যাংকিং আপনাকে একটি আনুমানিক মুনাফা বলে দেবে এবং বছর শেষে হিসাব-নিকাশ শেষ করে আপনাকে আপনার প্রকৃত প্রাপ্য দেয়া হবে।
(III) আরও একটি শক্ত অভিযোগ হলো, যারা ৩ মাস বা ৬ মাস মেয়াদী টাকা জমা রাখেন, তারা-তো নির্দিষ্ট মেয়াদের পর টাকা উঠিয়ে নেন। তাদেরকে ব্যাংক ৬% মুনাফা (ধরে নেয়া হলো) কীভাবে দেয় ? কারণ ব্যাংক হিসাব-নিকাশ করে বছর শেষে। এ প্রশ্নের উত্তর হলো হিসাব-নিকাশ বছর শেষে করে দেখা গেল যে, মুনাফা ৭% হয়েছে, তখন ব্যাংক অতিরিক্ত পাওনা জমাকারীর যদি অন্যকোন জমার হিসাব থাকে তবে সেখানে অথবা তার স্থায়ী ঠিকানায় Pay Order করে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু যদি বছর শেষে মুনাফা ৫% হয়, তবে ঐ ১% ব্যাংক তার নিজের ক্ষতি হিসেবে মেনে নেবে। কিন্তু ৩ মাস বা ৬ মাস মেয়াদ পুনঃ নবায়ন হয়, তবে সেই টাকা জমাকারীর হিসাব হতে সমন্বয় করা হয়। অবশ্য ব্যাংকের এই কার্যক্রমটি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (IBBL) এ শক্তভাবে মেনে চলা হয়।

৫. আরও একটি অভিযোগ হলো ইসলামী ব্যাংক লাভ-লোকসানের কথা বলে, কিন্তু কখনও লোকসান দেয় না। একটু পূর্বেই বলা হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা সুদী ব্যাংকের সুদের মত নিশ্চিত নয়। বছর শেষে এটি বাড়তে পারে, আবার কমতেও পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো ইসলামী ব্যাংক একবারও কেন লোকসান দিল না ? এখানে আরও একটি প্রশ্ন করা যায়, যারা স্কয়ার বা বেক্সিমকো এর প্রাথমিক শেয়ার ক্রয় করেছেন, সেই প্রাথমিক শেয়ারের ডিভিডেন্ড কী কখনও ঋণাত্মক (ক্ষতি) হয়েছে ? অর্থাৎ কোম্পানিগুলো কী কখনও ক্ষতি দেখিয়ে আপনার প্রাইমারি শেয়ারের মূল্য কমিয়ে দিয়েছে ?
উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর হলো কোম্পানির যেমন সামগ্রীক ক্ষতি নেই, তেমনি ইসলামী ব্যাংকেরও কোন সামগ্রীক ক্ষতি নেই। ধরুন ইসলামী ব্যাংক ১০০০ টি খাতে বিনিয়োগ করল। এর মধ্যে ৪০ টি খাতে সে ক্ষতি স্বীকার করল, কিন্তু বাকী ৯৬০টি খাতে সে মুনাফা করল। এখন আপনারাই বলুন সামগ্রীকভাবে ব্যাংকের লাভ হবে না ক্ষতি হবে ? অর্থনীতিতে যখন মহামন্দা দেখা দিবে তখন যদি ব্যাংক দেউলিয়া হয়, তবে ইসলামী ব্যাংকে টাকা জমাকারীসহ সবাই যার যার অনুপাতে ক্ষতি স্বীকর করবেন। কিন্তু সুদী ব্যাংকে টাকা জমাকারীদের সুদসহ সমস্ত টাকার পরিশোধ করে শেয়ার হোল্ডাররা ক্ষতির সমস্ত দায় গ্রহণ করবেন। ২০১৯ সালে ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ লিমিটেড (IBBL) এর ব্যালান্স শীট ভাল করে দেখুন। দেখবেন ২০১৯ সালে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার এবং সিকিউরিটি বাবদ বিশাল ক্ষতি হয়েছে।

৬. ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং প্রচলিত সুদী ব্যাংকের কোন কোন বিনিয়োগ কার্যক্রম প্রায় একই দেখে আপনি মন্তব্য করলেন দুটি ব্যাংকের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ধরুন দুটি ফ্লাটে দুটি পরিবার থাকে। তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। কিন্তু প্রথম ফ্লাটের পরিবারের কর্তা ও কর্তী এর মধ্যে বিয়ে হয়নি, কিন্তু অপর ফ্লাটে কর্তা ও কর্তীদের মধ্যে বিধি মোতাবেক বিয়ে হয়েছে। দুটি পরিবার সম্পর্কে আপনি কী মন্তব্য করবেন? কারণ দুটি পরিবারই একই পদ্ধতিতে সন্তান দুটি অর্জন করেছে! আপনার মন্তব্যগুলো নিম্নরূপ হবে -
(I) আপনি যদি কোন ধর্মের অনুসারী হন, তবে বলবেন ১ম ফ্লাটের পরিবারটি অবৈধ, এটি সমাজে অনৈতিকতা সৃষ্টি করবে এবং সমাজকে ধ্বংস করবে। ২য় ফ্লাটের পরিবারটি সমাজ গঠনের জন্য প্রয়োজন।
(II) আপনি যদি কোন ধর্মের অনুসারী না হন অর্থাৎ নাস্তিক হন তবে বলবেন ১ম ও ২য় পরিবারের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, তারা পারস্পরিক সম্মতির ভিতরে একই কাজ করেছে।

তাহলে দেখুন একই কাজের ফলাফলে ভিন্ন মত এসেছে। আর এই ভিন্নমতের সৃষ্টি হওয়ার পিছনে কারণ হলো নৈতিক জ্ঞান ও নৈতিকতাহীন জ্ঞান। জ্ঞানের ভিতর যখন নৈতিকতা হারিয়ে যাবে, তখন যেখানে আমরা একই ফলাফল দেখছি, সেই একই ফলাফলের একটি সমাজ গঠন করে এবং অপরটি সমাজ ধ্বংস করে। কম হউক আর বেশি হউক নৈতিক জ্ঞান আসে ধর্ম হতে। আপনি যদি ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে চান, তবে ইসলামী দর্শন (কোরআন-সুন্নাহ) জেনে আপনাকে মন্তব্য করতে হবে।

লেখকঃ আকমল হোসাইন

পঠিত : ১১৬২ বার

মন্তব্য: ০