Alapon

মানবসম্পদ উন্নয়নই দেশ ও সমাজের রক্ষাকবচ...



তুর্কি সুলতান ওরহান গাজি সামরিক বাহিনী নিয়ে দূর দূরান্তে যুদ্ধের ময়দানে থাকাকালীন সময়ে স্ত্রী নিলুফা খাতুনকে তার স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন। স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিলুফা খাতুনও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পুরো রাজ্য, তার প্রশাসনিক ও সামজিক দিক সামাল দিতেন।

সেই যুগে একজন নারী হয়েও চারিদিকে তো বটেই, এমনকি, ভেতরে বাইরে, প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য, জানা অজানা শত্রুপরিবেষ্ঠিত অবস্থায় থেকেও রাজ্য সামাল দিতে যে কতোটা দক্ষতা, ধৈর্য, সমসাময়িক রাজনীতির গতি প্রকৃতি, বিচক্ষণতা ও সাহসের প্রয়োজন হতো, সেটা বুঝতে হলে আরও গভীর ভাবতে হবে।

বিশেষ করে, প্রতিবেশি বাইজান্টাইন সা¤্রাজ্যতো বটেই, এমনকি, প্রতিদ্বন্দি তুর্কি ও মোঙ্গল গোষ্ঠী উদাহরণস্বরুপ; কারামানি আমির মুহাম্মদ বে, মাসুদ ইবনে কাসির, তাতার হালাকু খাঁনের গভর্নর মঈনূদ্দীন ও তার বাহিনী) এবং মামলুক সুলতান বাইবার্স ও তার অধস্তনেরা’সহ নানা গোষ্ঠী সেলজুক তুর্কিদের উৎখাত করে ক্ষমতা দখলে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, সেরকম একটা প্রতিকূল সময়ে!

ইতিহাসের এ অধ্যায়গুলো পড়তে গেলে থামতেই হয়। একজন অনুসন্ধিৎসু পাঠককে এগুলো নিয়ে ভাবতে হয়। ঐতিহাসিক এ ঘটনা কয়েকটা বিষয় আমাদের সামনে তুলে ধরে। তার মধ্যে প্রথমটি হলো, সেই যুগে, অর্থাৎ মধ্যযুগের এই স্তরে এসে মুসলিম সমাজে একজন নারীর সামাজিক অবস্থান কতোটা সংহত ও পরিপক্ক ছিল, সেটা।

নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক এমন অবস্থান অবশ্যই সমসাময়িক সমাজে পুরুষের দৃষ্টিভংগীকেও স্পষ্ট করে তোলে। তারা নারীকে কতোটা সম্মানজনক আসন দিয়েছিলেন সেটাও প্রশ্নাতিতভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। বিশেষ করে, খৃষ্টবাদের দ্বিতীয় প্রধান প্রাশাসনিক, আদর্শিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের বুকের উপরে। কারণ, ঐ সময় খৃষ্টসমাজে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা মানবিতিহিসের সবচেয়ে অধপতিত অবস্থায় নিপতিত ছিল।

আরও একটা ঐতিহাসিক তথ্য আমাদেরকে পুরো বিষয়টি ভাবতে বাধ্য করে। সেটা হলো, ওরহান গাজীর স্ত্রী নিলুফার খাতুন নিজেও ছিলেন গ্রিক বংশোদ্ভূত নারী, অর্থোডক্স খৃষ্টপরিবারে তার জন্ম। পরবর্তিতে তিনি একজন যুদ্ধবন্দী হিসেবে ওরহান গাজীর হাতে ধৃত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সুলতান তাকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দেন। তারই গর্ভে জন্ম নেন সুলতান প্রথম মুরাদ।

এই নিলুফার খাতুন যখন রাজ্যের রাজনৈতিক ও প্রাশাসনিক বিষয় থেকে শুরু করে দৈনন্দিন সব কাজ-কর্ম স্বামীর পক্ষে সামাল দিচ্ছেন, তখন স্বামী ওরহান গাজী রাণীর বাবা ভাই কিংবা স্বজাতি খৃষ্টান বাইজান্টাইন কোন বাহিনীর বিরুদ্ধে দূর দূরান্তে যুদ্ধে লিপ্ত!
কল্পনা করা যায় বিষয়টা! যুদ্ধবন্দী থেকে রাণীর মর্যাদায় উঠে আসা স্ত্রীর উপরে অগাধ বিশ্বাস, তার কর্তৃত্ব ও পারঙ্গমতা, সক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তার উপরে অবিচল আস্থা না থাকলে যুদ্ধে নিয়োজিত একজন স্বামীর পক্ষে কখনোই এমন কঠিন স্বিদ্ধািন্ত নেওয়া সম্ভব ছিল না। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ তুর্কি ও মুসলিম জনসংখ্যাধ্যুষিত সমাজের পক্ষেও সেটা মেনে নেয়া সম্ভবপর ছিল না।

এমন একটা আবহে ইতিহাসের সঠিক পাঠ নিতে হলে আমাদেরকে ঐ সমাজে সমকালীন সামাজিক মনস্তÍত্ত বা সোস্যাল সাইকোলোজিকে আরও একটু গভীরভাবে বুঝতে হবে। সমকালীন সামাজিক মনস্তত্তের স্পষ্ট একটা চিত্র আমরা দেখতে পাই প্রখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতুার লেখায়।

ইবনে বতুতা তুরস্ক সফর করার সময় সুলতান ওরহান গাজী’র (সুলতান প্রথম মুরাদের বাবা) শাসনামলে (চতুর্দশ শতাব্দির তৃতিয় ও চতুর্থ দশক) তুর্কি সমাজে বিদ্যমান সামাজিক দায়িত্ব ও ভাতৃত্ববোধের কিছু চিত্তাকর্ষক দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিলেন নিজের জীবনইে। তিনি লিখেছেন; ‘পুরো রুম, তথা, তুর্কিদের পুরো রাজত্বজুড়েই তাদের উপস্থিতি রয়েছে, প্রতিটি গ্রামেই। অপরিচিতজনদের প্রতি এরকম বদান্যতা আর আতিথেয়তা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যাবে না। তাদের দেশে আগত কোন বিদেশি অপরিচিতজনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তাদের সফরকে বাধাবিঘœহীন রাখা, আশ্রয়, খাদ্য পথ্য, রসদ সরবরাহ’সহ সবধরনের প্রয়োজনে মেটাতে ‘ফিতিয়ান’দের মতো এতোটা তৎপর আর কেউ নয়।
এরা হলো (অর্থাৎ ফিতিয়ান) অত্যন্ত স্বৎ ও সাহসী একদল যুবক। তাদের একজন নেতাও থাকেন, যাকে তারা ‘আখি’ বলে ডাকে। এই ‘আখি’র নেতৃত্বে তারা বিভিন্ন স্থানে তাঁবু খাটিয়ে সরাইখানা বানায়।

সারাদিন নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকে জনপদ জুড়ে। সন্ধা হতেই সকলে নিজ নিজ আয় রোজগার দিয়ে সরাইখানগুলোতে খাদ্য দ্রব্য, ফলমূল, বাতি, বাতির তেল’সহ রসদ ক্রয় করে এনে জড়ো হয়। যদি ঐ দিনে শহরে নতুন কোন অতিথির আগমণ ঘটে, তবে তারা নবাগত অতিথিকে সাদরে গ্রহণ করে তার পেছনে সেগুলো ব্যয় করে। অতিথি তার পরবর্তি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা না দেওয়া পর্যন্ত তার সকল প্রয়োজনই মেটাতে থাকে।
যদি নতুন কোন অতিথির আগমণ না ঘটে, তবে তারা সন্ধার নামাজ শেষে নিজেরাই সেগুলো খায়, এরপরে কিছুক্ষণ নেজে গেয়ে বিদায় নেয়। পরের দিন আবারও একইভাবে জনপদে ছড়িয়ে পড়ে আয় রোজগার’সহ নতুন কোন অতিথির সন্ধানে। আমি পৃথিবীর কোথাও এরকম কোন প্রথা দেখিনি’ (সুত্র: Storm on Horseback- The Seljuk Warriors of Turkey. John Freely পৃ: ১৩২)।

এতো ছিল সাধারণ জনমানসচিত্র। আর রাজ্যের কর্ণধারের জীবন কেমন ছিল? তার একটা চিত্র পাওয়া যায় ইবনে বতুতার আরও একটা বিররণে। সুলতান ওসমান গাজী সন্মন্ধ্যে লিখেছেন; ‘সুলতান ছিলেন ধনী ও সামরিক দিক বিচারে অত্যন্ত শক্তিশালী। রাজ্যজুড়ে তার শতাধিক দূর্গ রয়েছে, তিনি সারাটা বৎসর এইসব দূর্গ ও সৈন্যদের পরিদর্শন করে বেড়ান। বলা হয়, সুলতান জীবনে কোন এক শহরে একমাসের বেশি থাকেন নি। সব সময় ছুটে বেড়িয়েছেন শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদে’ (সুত্র: ঐ, পৃ: ১৩৩)।
যে সমাজ এতোটা মানবিক ভাতৃত্ববোধ ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন, সেই সমাজকে কি কেউ রুখতে পারে তার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌছুতে?

বস্তুত একটি দেশের সবচেয়ে বড়ো নিরাপত্তা হলো নাগরিকদের মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন। বড় বড় দালানকোঠা, ইমারত, সৌধ দেশ ও সমাজের নিরাপত্তা দিতে পারে না। পারলে তাজমহল কিংবা ময়ুর সিংহাসন, লালকেল্লা কিংবা কুতুব মিনার ভারতের, আয্ জাহরা প্রাসাদ আন্দালুসে মুসলিম শাসকদের নিরাপত্তা দিতে পারতো।

- ziaul huq

পঠিত : ৯২৯ বার

মন্তব্য: ০