Alapon

বদমেজাজি প্রজন্ম ও পরিশোধিত চিনির অভিশাপ...



ব্যাপকভাবে চিনির ব্যবহার শুরু হয়েছে সত্তর এর দশক থেকে। আমাদের ছোটকালে বাজারের রেস্টুরেন্ট গুলোতে দু'ধরনের 'চা' পাওয়া যেত। একটি গুড়ের চা, দাম পাঁচ পয়সা; অন্যটি চিনির চা, দাম দশ পয়সা। বাজারে আলাদা করে গুড়ের দোকান বসত। মহিলাদের গৃহস্থালি ও মেহমান দারীর জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ ছিল গুড়। সকল ধরনের পিঠা তৈরি হত গুড় দিয়ে। গুড় মিশ্রিত দই খেতে দারুণ উপাদেয়।

মিঠাতে রোগ-বালাই তেমন ছিলনা। মিঠা যখন চিনিতে পরিবর্তন হল, তখন থেকেই সভ্যতার পরিবর্তন শুরু হল। Refeind Sugar তথা পরিশোধিত চিনি বলতে সাদামাঠা ভাবে আমরা বুঝে থাকি যে, এটা থেকে খারাপ জিনিষ বিদায় করে ভাল জিনিষ টুকুই রাখা হয়েছে! যদি তাই ভাবা হয় তবে বলতে হয় উল্টোটা বুঝা হয়েছে। মূলত গুড়ের মধ্যে অনেকগুলো উত্তম উপাদান থাকে, সে সবের অধিকাংশই ঝেঁটায়ে বিদায় করে, দানাদার চিনির কণার উপরে স্বচ্ছ আবরণ পড়ানোর নামই রিফাইন্ড চিনি। মিঠার উপাদান বাদ দেবার কারণে চিনির মিষ্টি মিঠার চেয়ে বেশী। চিনির নাস্তা দীর্ঘদিন রাখা যায় কিন্তু ঝাল জাতীয় নাস্তার ক্ষেত্রে এটা সম্ভব নয়। স্থায়িত্বের কারণে চিনির কদর বেড়েছে। বর্তমানে চিনির ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে, চিনি সংক্রান্ত নাস্তারও বিস্তার ঘটছে। শিল্পকারখানায় উৎপাদিত চিনি যদি পুরোটাই হজম করতে না পারে, তাহলে অতিরিক্ত চিনি, চর্বি আকারে কলিজায় জমাট বাঁধে। দেহ রোগাক্রান্ত হতে থাকে, মানুষ মুঠিয়ে যায়। এর ফলে মানুষের হায়াত দ্রুতগতিতে কমতে থাকে। চিনি ডায়াবেটিসের জন্য ক্ষতিকর সবাই জানে। পিত্ত সমস্যা, বুক ধড়পড় করা, খাওয়ার পরও শক্তি না পাওয়া, বুকের ভিতরে পিনের আঘাতের মত অনুভূতি, নিঃশ্বাসে সতেজতা না থাকা, বদহজম হওয়া সহ বহু রোগের অনুঘটক এই চিনি! সেটা কতজন মানুষ জানে। চিনির বাজার বিস্তারের কারণে বর্তমানে শিশু-বুড়ো সবার রোগ-বালাইও বেড়েছে।

ধনীরা অন্য সাধারণ ব্যক্তিদের জীবনাচরণে চেয়ে একটু ভিন্নতা চায়। তাই এই জীবন-পদ্ধতি থেকে চিনিও বাদ যায়নি। বর্তমানের বাজারে বের হয়েছে 'রিফাইন্ড সুগার'! না, না, এটা আহামরি তেমন কিছু নয়। সাধারণ চিনির চেয়ে রিফাইন্ড চিনির দানা গুলো মিহি, ঝুরঝুরে, সমান আকৃতির এবং দেখতে উজ্জ্বল ও চকচকে। রিফাইন্ড চিনির দানাগুলো সাধারণ চিনির পাশে রাখলে পরিষ্কার তারতম্য বুঝা যায়। দেখতে একটু অভিজাত ভাব ফুটে উঠে। হাল আমলে লবণকেও এভাবে রিফাইন্ড করা হয়। সেটার নাম রিফাইন্ড লবণ। সাধারণ চিনি ও লবণকে আলাদা একটি পদ্ধতির মাধ্যমে যেহেতু রিফাইন্ড করতে হয়, সে কারণে এটার বাজার মূল্য একটু বেশী। ভুল বুঝবেন না, গুনের কারণে এর দর বাড়েনা নিতান্ত আভিজাত্য ও ধনাঢ্যতার পরিচয় দিতেই এর দামটা একটু বেশী। এসব দানাদার বস্তুকে রিফাইন্ড করতে গিয়ে, যে উপাদানটির ব্যবহার হয়, সেটার প্রভাবে মানুষের চরিত্র বদলে যায়। অনেকেই তাজ্জব হবেন, অনেকে হাসবেন এই বলে যে, খাদ্যের সাথে চরিত্রের কি সম্পর্ক!

এত সুন্দর করে চিনি ও লবণের উপর যে মসৃণ পোশাক পড়ানো হয় সেটা আহামরি কিছু নয়। এটা খুবই পাতলা চর্বির প্রলেপ মাত্র। চর্বির গায়ে আলোর উপস্থিতির কারণে এটাকে উজ্জ্বল চকচকে দেখায়। এই চর্বির উপস্থিতির কারণেই দানাগুলো একে অপরের থেকে পৃথক থাকে। কখনও জমাট বাঁধে না! উল্লেখ্য এসব চর্বির কাঁচামাল হল প্রাণী দেহ। সবচেয়ে বেশী মাত্রার চর্বি উৎপাদন করে শুকর। তাই ব্যবসায়ীদের কাছে প্রাণীজ চর্বির মধ্যে শুকুরের চর্বিই সবচেয়ে বেশী সহজলভ্য, সস্তা ও মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে সোজা। মাধ্যম হিসেবে সোজা কথাটি একটি বিশ্লেষণ সাপেক্ষ। ইউরোপে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ টন চর্বিকে কিভাবে গায়েব করবে সেটা নিয়ে তাদের বড় মাথাব্যথা ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকেই ইউরোপিয়ান দেশগুলো চর্বিকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেটা গবেষণা করার জন্য মিলিয়ন ডলার খরচ করতে থাকে। পৃথিবীতে চর্বি সংক্রান্ত গবেষণাই প্রচুর। বহু থিসিস রচিত হয়েছে। অতঃপর বহু বছর পরে তারা একাজে সফল হয়। এই চর্বিকে তারা বহু কাজে লাগানোর বুদ্ধি শিখেছে। বেকারি, কনফেকশনারী, আইসক্রিম, প্রসাধনী, ভোজ্য তৈল সহ নানা আইটেমের জন্য নানা ঘনত্বে এসব চর্বি বাজারজাত করে। সেসব প্রক্রিয়াজাত চর্বির একটির উপাদান হল এই "রিফাইন্ড সুগার"।

ইসলাম ধর্মে শুকুরের চর্বি হারাম। তাছাড়া আল্লাহর নামে জবেহ না হলে গরু-ছাগল, ভেড়ার চর্বিও হারাম। হারাম খেলে ইমান নষ্ট হয়। ইচ্ছাকৃত হউক আর অনিচ্ছায় হউক, ইমান হারা মানুষের চরিত্রেও পরিবর্তন হতে থাকে। ব্যবসায়ীরা সদা অর্থের পিছনে ব্যস্ত সময় ব্যয় করে। কার ঈমান, কোন সওদাগরের তেলের ড্রামে নষ্ট হল সেটা তাদের তাদের দেখার বিষয় নয়। সাদা-কালো হোলেষ্টাইন ফ্রিজিয়ান গরুর দেহে প্রায় ৪০ লিটার রক্ত থাকে। আমাদের দেশীয় গরুর দেহে তো ২৫ লিটার হবেই। ব্যবসায়ীরা প্রাণী দেহের এই রক্তের লোভটাও ত্যাগ করতে পারে না। তারা গরুকে জবাই না করে মাস্তুল দিয়ে প্রাণীর মাথায় আঘাত করে মেরে ফেলে। এতে করে সমুদয় রক্ত মৃত প্রাণীর মাংস পেশীতে আটকে যায়। যার ফলে মুল গোস্তের সাথে দেহে আটকে পড়া রক্তের ওজন মিলে অন্যূন আরো বিশ কেজি ওজন যোগ হয়। আমরা বলছিলাম চর্বির কথা। কিন্তু গোশতের উদাহরণ টানা হল এই কারণে যে, ব্যবসায়ীরা শুধু নিজেদের লাভের হিস্যার কথাটাই বেশী বুঝে অন্যের স্বাস্থ্য ও অন্তরের বিষয় নিয়ে ভাবাব মানুষ নন। সরকারকেই ব্যবসায়ীদের রেশ টানতে হয়। যদিও আমাদের দেশে এসব কারসাজি এখনও চালু হয়নি।

ইমান-আকিদা, হারাম-হালালের বিষয় গুলো শতভাগ নিজের দায়িত্বের রাখতে হয়। এটা বাজারের উপরে তুলে দিলে সমূহ বিপদ হবে। পকেটে টাকার গরম থাকলে তারা রিফাইন্ড চিনি কিংবা লবণ কিনবেন। এভাবে তিনি ইমানের হাওলা করবেন বাজারের বস্তায়! ওদিকে ভেজিটেবল অয়েলের ভিতরে, লাখ লাখ টন শুকরের চর্বি ঢুকিয়ে সেটাকে ভোজ্য তৈল হিসেবে বাজারে ছাড়ছে। লাখো মানুষ সেটা কিনে খাচ্ছে, এটা কয়জনে খবর রাখে? অনেকেই হয়ত ভাববে, এভাবে কি দিন চালানো সম্ভব! উত্তর আগেই রয়েছে, ঈমান বাঁচাতে হলে নিজের দায়িত্বে বাঁচাতে হবে। আমার ছোটকালে সরিষা-দানার বস্তা নিয়ে তেলীর বাড়ীতে যেতাম। তাঁরা যত্নের সাথে তেল বের করে দিত, সেটা দিয়ে আমার আম্মা কয়েক মাস চালিয়ে দিতেন। বাঁচতে চাইলে আবারো এভাবে জীবন চালাতে হবে।

ইসলামী স্কলারেরা গবেষণার মাধ্যমে এই কথায় নিশ্চিত হয়েছে যে, শুকরের উপাদান শিশুদের শরীরে ঢুকে পড়ার কারণে, বর্তমান যুগের শিশুরা অনেক বেশী বদমেজাজি ও উগ্র হয়ে উঠেছে। কেউ হয়ত ইচ্ছাকৃত ভাবে শুকুরের চর্বি খায়না কিন্তু না জেনে হারাম খেলেও তার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মানুষ মুক্ত থাকে না। না জেনে বিষ খেলে যেমন বিষের ক্রিয়া বন্ধ থাকেনা একই ভাবে শুকরের হারাম চর্বিও মানব চরিত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাই চোখ বন্ধ করে আধুনিক উপাদানকে সেরা মনে করার কোন কারণ নেই। শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে, কোন জিনিষে অভ্যস্ত হওয়াও বিচক্ষণ মানুষের কাজ হতে পারেনা। শিশুদের বদ-মেজাজের অন্যতম কারণ বাজারের লবণ-চিনি দায়ী এভাবে বুঝাতে চাচ্ছি না কিন্তু শিক্ষিত মানুষদেরকে হারাম থেকে বাঁচার জন্য অনেক বেশী সতর্ক হওয়া জরুরী। লবণ-চিনি তো সামান্য ব্যাপার! শুকরের চর্বি নিত্য ব্যবহার্য কত জিনিষে আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে চলছি তা জানলে চোখ কপালে উঠবে।

- Nazrul Islam Tipu

পঠিত : ৪৯৮ বার

মন্তব্য: ০