Alapon

পবিত্র কোরআনে ভাষা বোঝা কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ...?



কোরআন পড়েছি বহুবার। কিন্তু তেমন কিছুই বুঝি নি, ভেতরে ডুব দিতে পারি নি কখনো। যখন এক নীরব মুহূর্তে কোরআনের গভীরে ডুবে গেলাম, আয়াতগুলো যেন কথা বলতে শুরু করল। শিহরিত, চমকিত হলাম। এক জীবনে যা চাই, তার সবই সাজানো রয়েছে কোরআনের পরতে পরতে। সুস্থ সুন্দর সুখী পরিতৃপ্ত জীবনের জন্যে যা প্রয়োজন, পাতায় পাতায় রয়েছে তারই দিক-নির্দেশনা।

সবকিছু মিলিয়েই জীবন। তাই সমস্যা শরীরের হোক বা মনের, যৌন জীবনের জট হোক বা অর্থনৈতিক জটিলতা, পণ্যের আসক্তি হোক বা প্রবৃত্তির দাসত্ব, ব্যক্তির অসততা হোক বা সামাজিক অবিচার, পার্থিব সুখ হোক অথবা পরকালীন পরিত্রাণ, সব একই সূত্রে গাঁথা। একটাকে আরেকটা থেকে আলাদা করা যায় না। কোরআন এই চিরায়ত সত্যকেই প্রকাশ করেছে সুস্পষ্টভাবে।

‘পড়ো! তোমার সৃষ্টিকর্তা প্রভুর নামে। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন নিষিক্ত ডিম্ব থেকে। পড়ো! তোমার প্রতিপালক মহান দয়ালু! তিনি মানুষকে জ্ঞান দিয়েছেন কলমের। আর মানুষকে শিখিয়েছেন, যা সে জানত না।’ সূরা আলাক-এর এই পঙক্তিমালা দিয়েই কোরআন নাজিলের সূচনা।

শুরুতেই কোরআন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে পড়তে ও জানতে। কোরআন অজ্ঞতাকে অভিহিত করেছে মহাপাপ রূপে। মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে জ্ঞানের পথে, মুক্তবুদ্ধির পথে। এমনকি বিশ্বাসের স্তরে পৌঁছার জন্যেও মানুষের সহজাত বিচারবুদ্ধির প্রয়োগকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে কোরআন। বৈষয়িক ও আত্মিক জীবনকেও একই সূত্রে গেঁথেছে কোরআন। সুস্পষ্টভাবেই বলেছে, আল্লাহর বিধান অনুসরণ করো। দুনিয়া ও আখেরাতে তুমি সম্মানিত হবে।

কোরআনের প্রথম আয়াত নাজিলের ২৩ তম বছরে নাজিল হওয়া সূরা বাকারার ২৮১ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা সেই দিন সম্পর্কে সচেতন হও, যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর কাছে ফিরিয়ে আনা হবে এবং তারপর প্রত্যেককেই তার কর্মফল পুরোপুরি প্রদান করা হবে। কারো ওপর কোনো অন্যায় করা হবে না।’ প্রথম পঙক্তিমালায় যেভাবে মানুষের জন্ম প্রক্রিয়ার নিরহংকার অবস্থার বিবরণ দেয়া হয়েছে, শেষ দিকের পঙক্তিমালায় একইভাবে বলা হয়েছে, কর্মের স্বাধীনতা দেয়া হলেও মানুষ জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়। তার কর্মের যথাযথ ফল সে পাবে।

কোরআনের প্রথম আয়াত নাজিল হয় ৬১০ সালে আর শেষ আয়াত ৬৩২ সালে। ধাপে ধাপে খণ্ডে খণ্ডে দীর্ঘ ২৩ বছরে পরিপূর্ণতা পায় কোরআন। প্রথম আয়াত নাজিল হওয়ার পরই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এর আকর্ষণী ক্ষমতা। অবিদ্যা বা জাহেলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষগুলো আলোর সন্ধান পায়। সেই আলোয় বদলাতে শুরু করে তারা।

পিতৃপুরুষের হাজার বছরের সংস্কার ও ধর্মান্ধতার বৃত্ত ভেঙে তারা লাভ করে মুক্ত বিশ্বাস ও সঠিক জীবনদৃষ্টি। এরপর নিজের মুক্তির জন্যে, মানুষের মুক্তির জন্যে কোনো ত্যাগ স্বীকারেই পিছপা হয় নি তারা। অবিদ্যা হিংসা সন্ত্রাস রক্তপাত শোষণ জুলুম আর নারীনির্যাতনে নিমজ্জিত মানুষেরাই পরিণত হয় সত্য ও ন্যায়ের মূর্ত প্রতীকে। দলীয়, গোত্রীয় ও উপজাতীয় হানাহানিতে লিপ্ত বিক্ষিপ্ত সম্প্রদায়গুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরিণত হয় এক দুর্দমনীয় আদর্শিক জাতিসত্তায়।

প্রথম আয়াত নাজিল হওয়ার ৫০ বছরের মধ্যে কোরআনের অনুসারীরা তদানীন্তন পরাশক্তি রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যকে নিশ্চিহ্ন করে পরিণত হয় তখনকার একমাত্র পরাশক্তিতে।

ইতিহাস সাক্ষী! কোরআন ছাড়া আর কোনো গ্রন্থই প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে মানুষের হৃদয়ে এত আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে নি, এত দ্রুত মানুষকে এমনভাবে বদলে দিতে পারে নি। কোরআন সরাসরি যাদের সামনে নাজিল হয়েছিল তারাই শুধু আলোকিত হন নি; ধর্মান্ধতা ও পাশবিকতার পরিবর্তে ধর্ম, মানবিকতা ও মুক্তবুদ্ধির এই স্রোত প্রবাহিত হয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্মে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। ধর্ম, মানবিকতা ও মুক্তবুদ্ধির এই স্রোত ইতিহাসের মধ্যযুগে সৃষ্টি করেছিল এক আলোকোজ্জ্বল সভ্যতা।

কোরআনের অনুসারীরা যখন শিল্প সাহিত্য জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় অবগাহন করছিল তখন ইউরোপ ডুবে ছিল অজ্ঞতা ও ধর্মান্ধতার অন্ধকার যুগে। প্রাচ্যের এই আলোকোজ্জ্বল সভ্যতা থেকেই ইউরোপের দেশে দেশে কোরআনের মানবিকতা ও মুক্তবুদ্ধির বাণী পৌঁছাতে থাকে বিভিন্নভাবে। ইউরোপে সূচনা হয় রেনেসাঁ বা মুক্তবুদ্ধির জাগরণ। নতুনভাবে শুরু হয় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা। এগোতে থাকে বিজ্ঞান। তাই নিঃসংশয়ে বলা যায়, কোরআন যে মানবিকতা, জ্ঞানচর্চা ও মুক্তবুদ্ধির শিক্ষা দিয়েছে তারই ফল্গুধারায় লালিত হয়ে বিশ্ব প্রবেশ করেছে বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যুগে।

প্রতিটি মানুষ বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই একটি মৌলিক প্রশ্নের জবাব জানতে চায়। তা হলো, দুনিয়ায় আমি কীভাবে ভালো থাকব? মৃত্যুর পর কোনো জীবন আছে কি? থাকলে সেখানে কীভাবে ভালো থাকব? চৌদ্দ শ বছর ধরে কোরআন থেকে যত বেশি সংখ্যক মানুষ এই প্রশ্নের বোধগম্য জবাব পেয়েছে, আর কোনো গ্রন্থ থেকে সে তা পায় নি। কোরআন তাই কোটি কোটি মানুষের কাছে অনুভূত হয়েছে পরম করুণাময়ের করুণার এক উজ্জ্বল নিদর্শনরূপে।

কোরআন নিঃসন্দেহে আল্লাহর কালাম। নাজিল হয়েছে আরবি ভাষায়। এর শব্দবিন্যাস, এর ছন্দ, এর সৌন্দর্য, এর ব্যঞ্জনা, এর অন্তর্নিহিত শক্তি, এর গভীরতা অতুলনীয়। তাই আজ পর্যন্ত এর একটি ছোট্ট সূরার সমকক্ষ সূরা কেউ রচনা করতে পারে নি। কোরআন যেহেতু আল্লাহ সরাসরি আরবি ভাষায় নাজিল করেছেন, তাই অন্য কোনো ভাষায় এর মহিমাকে অক্ষুণ্ন রেখে অনুবাদ করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

তবে আন্তরিকতা নিয়ে এর মর্মবাণী অনুধাবন করতে চাইলে যে-কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষেই তা সম্ভব। কারণ ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকল মানুষের হেদায়েতের জন্যেই কোরআন নাজিল হয়েছে। তাই কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহতে সমর্পিত একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আত্মনিমগ্ন হয়ে ধ্যানের স্তরে তাঁর কালামের মর্মবাণী উপলব্ধি করেছি আর বিস্মিত, চমকিত হয়েছি।

আপ্লুত হয়েছি কোরআনের বাণীর চির নতুনত্বকে উপলব্ধি করে। দেখেছি বর্তমান যুগের প্রতিটি যন্ত্রণা ও প্রতিটি জিজ্ঞাসার জবাব এক চমৎকার গাঁথুনিতে গাঁথা আছে। স্পষ্টত অনুভব করেছি চৌদ্দ শ বছর আগে অধঃপতিত অবিদ্যার অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষগুলো এই কোরআনের বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন ও তা অনুসরণ করে নিজেদেরকে পৃথিবীর সেরা মানুষে রূপান্তরিত করেছিলেন, আলোকোজ্জ্বল সভ্যতার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

একইভাবে যে-কোনো বঞ্চিত, অবহেলিত বা অধঃপতিত মানুষ যদি কোরআনের মর্মবাণীকে অনুধাবন করতে পারে, অনুসরণ করতে পারে, তাহলে সে-ও পরিণত হবে যথার্থ মানুষে, সফল মানুষে, আলোকিত মানুষে। আর এই মানুষেরাই হবে ভবিষ্যৎ আলোকোজ্জ্বল সভ্যতার নির্মাতা। সমাজ মুক্তি পাবে অবিদ্যা লালসা বঞ্চনা শোষণ ও পণ্যদাসত্বের শৃঙ্খল থেকে। বর্তমানের প্রেক্ষাপটে কোরআনের গুরুত্ব অনুধাবন করার পর এর মর্মবাণী মায়ের ভাষায় প্রকাশ করার জন্যেই এই ক্ষুদ্র উদ্যোগ।

কোরআন শতাব্দীর পর শতাব্দী জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কোটি কোটি মানুষের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিয়েছে, তাদের বদলে দিয়েছে ভেতর থেকে, খুলে দিয়েছে তাদের সম্ভাবনার দ্বার, দিয়েছে প্রশান্ত ও পরিতৃপ্ত জীবন। তাই আল্লাহর কালামের মর্মবাণীতে আন্তরিকভাবে নিমগ্ন হোন, বার বার পড়ুন, ডুবে যান শব্দের গভীরে, বাক্যের গভীরে। কোরআনই কথা বলবে আপনার সাথে, আপনিও বদলাতে শুরু করবেন ভেতর থেকে। ধর্মে মানবিকতায় জ্ঞানে অভিজ্ঞানে হবেন এক আলোকিত মানুষ। প্রথম যুগের কোরআন অনুসারীদের মতো আপনিও দুনিয়ায় সফল ও সম্মানিত হবেন। আর আখেরাতের সম্মান তো শুধু স্রষ্টায় সমর্পিত সৎকর্মশীল মানুষদের জন্যেই। পরম করুণাময়ের করুণায় তারাই থাকবেন অনন্ত আনন্দলোকে।

- Fakhrul

পঠিত : ৫৭১ বার

মন্তব্য: ০