Alapon

আমার বিবাহ!

আজ বিয়ের রাত। নতুন বউকে আমার ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। একটু পরেই সে ঘরে যেতে হবে। ভাবতে গেলেই হাত-পা সব ঠান্ডা হয়ে আসছে। একবার এক নাটকে দেখেছিলাম, ‘বর সাহেব ভয়ের চোটে ‘বালাগাল উলা বি কামালিহি কাসাফাদদু জা বিজামালিহি’...’ পড়তেছে! আজকে আমার অবস্থাও সেরকমই হবে মনে হচ্ছে।


নতুন বর। বিরাট লজ্জা শরমের কথা। তাই আপন বাড়িতেও গলা ছেড়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলতে পারছি না। একমাত্র ছোটভাইটাকে কাছে ডেকে বললাম, ‘সোনা ভাই আমার! ফ্রিজ থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আয়তো।’
আবার অবস্থা দেখে সে সাপনের কপাটি দাঁত বের করে বলল, ‘ভাইয়া তোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, একটু পর তুই পুলসিরাত পার হতে যাবি। একটু এদিক-ওদিক হলেই খেল খতম। তোর অবস্থান হয় হাবিয়া অথবা লাযা দোযখে হতে যাচ্ছে।’ এসব বলেই খিলখিলিয়ে হাসি...


আজ প্রথম নিজের রুমে ঢুকতে সংকচ কাজ করছে। বুকটা ‍দুরুদুরু করে কাঁপছে। তার উপর ভিতরের মানুষটার সাথে আমার তেমন কোন পরিচয় নেই। কই থেকে কিভাবে শুরু করব; আল্লাহ জানে। বিসমিল্লাহ বলে রুমে ঢুকে পড়লাম...


সব বাসর ঘর যেমন হয় আমাদের বাসর ঘরটাও তেমনি। নতুন কিছু করে নিজেকে সবার থেকে আলাদা প্রমাণ করবার সামান্যতম প্রচেষ্টাও করিনি। ফুলে ঘেরা ঘাটটার কাছে গিয়ে ছোট করে সালাম দিয়ে বললাম, ‘এইখানে বসি?’
সে মাথা দুলিয়ে ইশারায় বুঝাল, ‘জ্বি আপনি বসতে পারেন।’
বসতে বসতে নিজের বুকের ধুকধুকানি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। তারপর মনে মনে ‘বিসমিল্লাহ... বলে কথা বলতে শুরু করলাম....


‘আপনার সঙ্গে বিয়ে হবার আগে আপনার পরিবার নিশ্চয় আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছে। আশে পাশের দশ জন মানুষ যখন বলেছে, ‘ছেলেটা ভালো’। তখনই আপনার বাবা-মা আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। আর সেসব মানুষ আমার কি দেখে ভালো বলেছে জানেন?
তারা আমাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া দেখে সেকারণেই ভালো বলেছে। কিন্তু জানেন কি , মুনাফিকের সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাইও পাক্কা নামাযি ছিল। বরঞ্জ তাকে বেশিরভাগ সময় মাসজিদের প্রথম কাতারেই দেখা যেত। তাই শুধু নামায পড়লেই কেউ ভালো হয়ে যায় না। অনেক রাত হয়ে গেছে। এইবার ঘুমিয়ে পড়ুন...’


এরপর আরো আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আসল সংসার শুরু করতে দিন দশেক লেগে গেল। এরপর আমিও কর্মজীবনে যোগ দিলাম আর আমার নতুন বউও তার সংসারটাকে বুঝে নিতে শুরু করল। সেইদিন অফিস থেকে ফেরার সময় দেখলাম, একটা কম বয়সী মেয়ে দুই হাতে বেলী ফুল আর বকুল ফুলের মালা নিয়ে ঘুরছে। তারা মূল টার্গেট গাড়িতে বসে থাকা অভিজাত শ্রেণীর মানুষগুলো। আমার মত মধ্যবিত্ত বাইক ওয়ালার কাছে ওরা আসে না। তাই অগত্যা ডাক দিয়ে বেলী এবং বকুল ফুলের দু’টি মালা কিনে ফেলললাম।


কলিংবেজ বাজানোর ১০ সেকেন্ড না হতেই দরজাটা খুলে গেল। বউ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ চলে গেল আমার হাতে ধরে রাখা ফুলগুলোর দিকে। তার এই চোখের দৃষ্টিতে লজ্জায় আমার নাক ঘামতে শুরু করল। তারপর আমতা আমতা করে বললাম, ‘রাস্তায় ছোট একটা মেয়ে বিক্রি করতেছিল। কি মনে করে যেন কিনে ফেললাম।’ তারপর হড়হড় করে রুমের দিকে হাটা ধরলাম।


এভাবে কেটে গেল অনেকদিন। শুক্রবার ছুটির দিন। মাগরিবের নামায শেষে দু’জনের জন্য আইসক্রিমের কোন কিনে বাসায় ফিরলাম। বারান্দায় বসে দুজনে যখন আইসক্রিম খাচ্ছিলাম তখন সে বলল, ‘আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?’
আমার বুকটা ধক করে উঠল। আল্লাহ জানে আবার কিনা কি বলে!
গম্ভীর কন্ঠে বললাম, ‘হুম বল’।
‘সেদিন বাসর ঘরে ঐসব বলেছিলেন কেন?’


আমি বলতে শুরু করলাম। দেখ, ‘আমাদের দেশের মেয়েরা বিরাট একটি স্বপ্ন নিয়ে তার বৈবাহিক জীবন শুরু করে। তার বরের সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ একটি কাল্পনিক ধারণা নিয়ে সংসার শুরু করে। সে মনে মনে বিশ্বাস করে, তার বর সবার থেকে আলাদা। তার বর অন্য আট-দশ জনের মত নয়। কিন্তু সংসার জীবনের কয়েকমাস অতিবাহিত হবার পরই তার সেই ভুল ভেঙ্গে যায়। তার বরের মানবিক দুর্বলতাগুলো তার সামনে উন্মুক্ত হয়ে যায়। তখনই সে হতাশ হয়ে পড়ে আর ঠিক এসময়ই নতুন সংসারে ঝগড়ার অবতারনা ঘটে।


আমি তোমাকে ওসব বলেছি, যেন তুমিও একই ভুল না কর। আমরা কেউই ফেরেশতা নই, মানুষ। তাই অন্য আর আট-দশ জনের মত মানবিক দুর্বলতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কল্পনাবিলাসী সেসব বউদের জন্য এসব দুর্বলতা মেনে নেওয়া বেশ কঠিন হয়ে যায়। তোমার ক্ষেত্রে যেন এইসব কিছু না হয় তাই ঐদিন ওসব কথা বলেছি।’


আমরা মানুষ হিসেবে একটু বেশিই কল্পনাবিলাসী। আর আমাদের বাঙালী রমনীরা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই পতিভক্ত। আর এই পতিভক্তির কারণেই তারা নিজেদের বরকে মহাপুরুষ ভেবে সংসার শুরু করে। কিন্তু সংসারের কিছুদিন পরই বুঝতে পারে সেতো মহাপুরুষ নয় মানবিক দুর্বলতা সম্পন্ন অতি সাধারণ মানুষ।

পঠিত : ১৩১৯ বার

মন্তব্য: ০