Alapon

শহীদ তিতুমীর এক অকুতোভয় বীর

পলাশী যুদ্ধের পঁচিশ বছর পর এবং উনবিংশ শতকের পঞ্চম দশকের সমগ্র ভারতব্যাপী আযাদী সংগ্রামের (১৮৫৭) পঁচাত্তর বছর পূর্বে ২৭ই জানুয়ারি ১৭৮২ খৃষ্টাব্দে সৈয়দ মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগণা জেলার চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মীর হাসান আলী এবং মাতার নাম আবেদা রোকাইয়া খাতুন।

তিতুমীরের প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তার গ্রামের বিদ্যালয়ে। পরবর্তীকালে তিনি স্থানীয় একটি মাদ্রাসাতে লেখাপড়া করেন। ১৮ বছর বয়সে তিতুমীর কোরানে হাফেজ হন এবং হাদিস বিষয়ে পাণ্ডিত্য লাভ করেন। একই সাথে তিনি বাংলা, আরবি ও ফার্সি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন একজন দক্ষ কুস্তিগীর।

অনেক উচ্ছ বংশীয় ও ধর্ম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করলেও তিনি সাধারন জীবন-যাপন করতেন। তিনি ছিলন সমাজের নির্যাতিত, নিপিড়ীত মানুষের অভিভাবক। সবসময় জুলুমবাজদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তিনি। কথা বলতেন শোষিত মানুষের অধিকার নিয়ে। আল্লাহর দ্বীন এবং রাসূল সাঃ এর আদর্শকে মজবুত করে আকড়ে ধরতে তিনি সবসময় মুসলমানদের উদ্ধুদ্ধ করতেন। বোঝাতেন মুসলমানদের ক্ষমতা আর দ্বীন কায়েমে জিহাদের প্রয়োজনীয়তা।

১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কায় হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে যান। তিনি সেখানে স্বাধীনতার অন্যতম পথপ্রদর্শক সৈয়দ আহমেদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ও ওয়াহাবী মতবাদে অনুপ্রাণিত হন। সেখান থেকে এসে (১৮২৭) তিতুমীর তার গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সাথে নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি এবং তার অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে 'তাহ্‌বান্দ' নামে এক ধরনের বস্ত্র পরিধান শুরু করেন। তিতুমীর হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক মুসলমানদের উপর বৈষম্যমূলকভাবে আরোপিত 'দাঁড়ির খাজনা' এবং মসজিদের করের তীব্র বিরোধিতা করেন।

প্রতিবাদী এই বীরকে সহ্য হয়নি স্থানীয় জমিদার আর নীলকরদের। ফলে তিতুমীর ও তার অনুসারীদের সাথে স্থানীয় জমিদার ও নীলকর সাহেবদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হতে থাকে। আগেই তিতুমীর পালোয়ান হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং পূর্বে জমিদারের লাঠিয়াল হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তিনি তার অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলেন।

মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে নিয়ে তিতুমীর এ আন্দোলন শুরু করলেও তার অনুসারীর সংখ্যা একসময় বেড়ে ৫,০০০ গিয়ে পৌঁছায়। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়।

তিতুমীর এর অভিজ্ঞতার ঝুলিও কম সমৃদ্ধ ছিল না। তিতুমীর বুঝতে পারেন যে, নীলকর এই ইংরেজ সরকারে আর জুলুমবাজ এই জমিদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে প্রয়োজন সমর প্রস্তুতি ও উপযুক্ত সেনা-প্রশিক্ষণ। সেনাবাহিনীর আত্নরক্ষার প্রয়োজনে তিনি একটি দুর্গ নির্মানের প্রয়োজনীতা গভীরভাবে অনুভব করেন। সময় এবং অর্থাভাবে তিনি আপাতিত ছিলেন। ফলে, কলিকাতার নিকটবর্তী নারিকেলবাড়িয়া নামক স্থানে একটি বাশের কেল্লা বা দুর্গ নির্মান করেন। ইতিহাসে এ কেল্লাই তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা নামে পরিচিত।

এর কিছুদিন পরেই, নীলকর আর জমিদারদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিতুমীর বর্তমান চব্বিশ পরগনা, নদীয়া এবং ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী এবং ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের হাতে বেশ কয়েকবার পরাজয় বরণ করে। তন্মধ্যে বারাসতের বিদ্রোহ অন্যতম। উইলিয়াম হান্টার বলেন, ঐ বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষকসেনা তিতুমীরের পক্ষে যুদ্ধ করেন।

অবশেষে ১৮৩১ সালের ১৩ নভেম্বর ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তিতুমীর স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেন, "ভাই সব, একটু পরেই ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে। লড়াইতে হার-জিত আছেই, এতে আমাদের ভয় পেলে চলবে না। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যদা অনেক। তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এ দেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে । আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এই পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে।১৯ শে নভেম্বর কর্নেল হার্ডিং-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তার অনুসারীদের আক্রমণ করে। তাদের সাধারণ তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তার সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারেন নি। ১৯শে নভেম্বর তিতুমীর ও তার চল্লিশ জন সহচর শহীদ হন। তার বাহিনীর প্রধান মাসুম খাঁ বা গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বাশেঁর কেল্লা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

মুসলমান জাতি অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে ধর্মীয় ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে যে কতোটা নিচে নেমে গিয়েছিল তা কল্পনাতীত। তার সাথে, মাথা ছাড়া দিয়ে উঠেছিল নীলকরদের অন্যায়-অবিচার আর হিন্দু জমিদারদের নিপীড়ন। ফলে, মুসলমানরা ক্রমশই দমিয়ে যেতে থাকে। ফলে সমাজে নেমে এসেছিল হিন্দুত্ববাদীদের ভয়াল আগ্রাসন। মুসলমানদের ঈমান হারানো ছিল তখন মেকি বিষয়।

শহীদ তিতুমীর এ সকল জুলুম-নির্যাতন বন্ধ করার পাশাপাশি চেয়েছিলেন অন্ধকারে নিপতিত এ সমাজটাকেও সংস্কার করতে। তিনি হয়ত তার জায়গায় সম্পূর্ণ সফল হতে পারেননি তবে একেবারে ব্যার্থও হন নি। কারন, তার ঈমানী শক্তি ছিল আকাশচুম্বী। আর এ শক্তি দিয়েই তিনি আজীবন লড়ে গিয়েছেন ব্রিটিশ বিরোধী হয়ে।

শহীদ তিতুমীর এর সেই সোনালী অতীত চিরকাল দীপ্তিশিখার মতো জ্বলে থাকবে মুসলমানদের দ্বীন কায়েম আর শোষনের বিরুদ্ধে জেগে ঊঠার প্রেরনা হয়ে। তিনিই দেখিয়ে গিয়েছিলন যে, মুসলমানরা বীরের জাতি, মাথা নুয়াবার জাতি নয়।

মহান রব অকুতোভয় এ বীরকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুক।

__________________________________

শহীদ তিতুমীর " এক অকুতোভয় বীর,,
হোসাইন শাহাদাৎ

পঠিত : ৫৫৪ বার

মন্তব্য: ০