Alapon

অনুধাবন...


ব্যস্ত নগরীর কোলাহল থেমে গেছে।নিস্তব্ধতার চাদর মুড়িয়ে বিষাদময় রাতটি যেন নষ্ট ঘড়ির কাঁটাগুলোর মত থমকে আছে। কি বিশাল রাত!কি দীর্ঘ তার সময়!নিরন্তর বয়ে চলা নদীর মত যদি আজকের রাতটাও কেটে যেত!

নির্ঘুম এই দীর্ঘ রজনী যে অতিদ্রুত শেষ হবার নয় তা তো আয়ান চৌধূরী ভাল করেই জানেন।১৫বছর আগে উনি ছিলেন এমন একটা বিভীষিকাময় নির্ঘুমে রাতের সঙ্গী।সেই রাতের তিক্ত অভিজ্ঞতা ওনার মস্তিষ্ক নিজ দায়িত্বে খুব যত্ন করে স্মৃতির পাতায় সাজিয়ে রেখেছে।আজকে আবার সেইসব স্মৃতিরা মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠেছে।

আগেরকার সেইসব কথা মনে পড়তেই তিনি প্রতিবারের মতো এবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।এসব নষ্ট স্মৃতিগুলো যেন তাঁকে প্রতিনিয়ত ক্ষুধার্ত শকুনের মতো চিঁড়ে চিঁড়ে খায়।
টাকার লোভ,সৌন্দর্যের মোহ আর মিথ্যার বাহুডোরে নিজেকে আবদ্ধ করে সুখ পেতে চাইলেই কি সুখ পাওয়া যায়? নিজের আত্মিক সুখের জন্য মিথ্যার পুকুরে উনি বুদ্ধির বর্শা নিক্ষেপ করেছিলেন।তাতেও সুখ মেলেনি।বরং সহস্র ছলনার বেশ ধরে যত পাপ করেছেন তার ফল দিতে হয়েছে প্রিয় কিছুর বিচ্ছেদের বিনিময়ে।বাহ্যিক সুখ থাকলেও অন্তরের শান্তির লেশমাত্রও আয়ান চৌধূরীর ছিল না।

একমাত্র আদরের রাজকন্যা,৫বছর বয়স থেকেই যাকে নিজের কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন,যার কথা ভেবে ২য় বিয়ের কথা চিন্তাও করেননি সেই এনাকে আজ কিছু নরপিশাচ ধর্ষণ করে হত্যা করেছে।ছিন্ন-ভিন্ন রক্তাক্ত শরীরে এনার লাশ ঢাকার অদূরে অজপাড়া গাঁয়ের এক জঙ্গলে খুঁজে পাওয়া গেছে।

মেয়ের এমন ছিন্ন-ভিন্ন শরীর দেখে নিজেকে সামলাতে না পেরে শত জনতার ভীড়ে ঢুকরে কেঁদে উঠেছিলেন তিনি।কয়েকবার সেন্স ও হারিয়েছিলেন।অস্ফুট স্বরে শুধু বলেছিলেন,"আপন বলতে আমার আর কেউ থাকল না রে মা।"

এনার মা এনার জন্মের পাঁচ বছর পর পরকীয়া করে অন্য একজনের হাত ধরে পাড়ি জমায় নতুন জীবনের সন্ধানে।জীবনের একমাত্র সত্যিকার ভালবাসা হারিয়ে কেবল তখনই আমার বোধগম্য হয়েছে ভালবাসা হারানোর যন্ত্রণাটা আসলে কি!!হৃদয় হয়ে ওঠে উত্তপ্ত মরুভূমি।বিরহের বিষাক্ত কাঁটার আঁচড়ে অন্তরে চলে অঙ্কনের প্রতিযোগিতা।

আয়ান চৌধূরী বলেই চলছেন...
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি যখন সেই যন্ত্রণা ভোলার পথে।ঠিক তখনই যেন এক দমকা হাওয়ায় আমার সব শেষ হয়ে গেল।এ কোন পাপের ফল তা আমার এখন বোধগম্য হচ্ছে।

অনেকের চোখের জল,দীর্ঘনিশ্বাস আর অভিশাপে আমার সাজানো সুখের বালিঘরে আজ কোনো বালুকণার চিহ্ন পর্যন্ত নেই।

_________এসব ভাবছে আর নিকোটিনের ধোঁয়া শূন্যে মিলাচ্ছে। নিদারুণ যন্ত্রণারা যেন বিষকন্যা হয়ে তাঁর বুকে একের পর এক ছোবল মারছে।

এনার লাশ কবরে রেখে আজ এতদিন বাদে নিজের সাথে ঘটা তিক্ত ঘটনাগুলো তাঁর স্মৃতিপটে জাজ্বল্যমান।বিবেক তাঁকে আজ অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।
হাজারো প্রশ্ন তার মাথায় সাপের ফণা হয়ে জেঁকে বসেছে।প্রত্যেকে যেন সুর মিলিয়ে বলছে আমরা এর বিহিত চাই,আমরা এর উত্তর চাই।

অতীত বইয়ের কুর্মের শিরোনাম:
*লিরা সুইসাইড করেছে শুধু আমারই জন্য,সাথে করে নিয়ে গেছে আরও একটি শুভ্র নিষ্পাপ জীবন;যাকে আমি অস্বীকার করেছিলাম।

*পরিপূর্ণ পর্দা করা নিষ্পাপ তাসনিম ধর্ষিতা হয়েছিল আমার প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার অপরাধে।শুনেছি কোন এক হেদায়েত প্রাপ্ত ডাক্তার ওকে বিয়ে করে নিয়েছিল সেইসময়,ওরা ভাল আছে এখন।

*নিয়নের গায়ে এখন ডিভোর্সী ট্যাগ লাগানো শুধুই আমার জন্য।ওর বরের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে ওর নামে আজেবাজে কথা লাগিয়েছিলাম।আবার ওর সাথে আমার রিলেশন থাকাকালীন কিছু ছবিও দেখিয়েছিলাম।তাতেই ওর বর ওকে ডিভোর্স দেয় এক ফুটফুটে বাচ্চা সহ।

শুনেছি নিয়নের ডিভোর্সের পর একটা জব হয়ে গিয়েছিল।তাই নিয়েই মা-ছেলে আলাদা থাকতো।ওর ছেলেটাও নিশ্চয়ই বড় হয়ে গিয়েছে।

এদের এহেন অবস্থা দেখে আমি পৈশাচিক আনন্দ পেতাম।ওদের আত্ম-চিৎকারকে সুর বানিয়ে আমার মন যেন পেখম মেলে ধরা ময়ূরের মত খুশিতে নৃত্য করত।

*আর সবথেকে বেশি সাফার করেছে অহনা।ও এখন পাগল।শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়।
মধ্যবিত্ত পরিবারের এক অসাধারণ মেধাবী মেয়ে ছিল।তবে সৌন্দর্য বলতে যা বোঝায় তা ওর মধ্যে বিন্দুমাত্রও ছিলনা।কিন্তু ওর মনটা ছিল ভীষণ বড় আর সাদা দাঁতে অমায়িক সুন্দর ছিল তার মুখের হাসি।আর এত মিষ্টি কন্ঠস্বর ছিল যা শুনলে যে কেউ মুগ্ধ হবে।আমিও হয়েছিলাম ক্ষণিকের জন্য।

জাস্ট টাইম পাস করার জন্য ওকে আমার প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছিলাম।যদিও ওকে রাজি করতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।তবুও আমি পেরেছিলাম।

আমার মত স্মার্ট,ড্যাসিং,সুদর্শন ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খেত গোটা স্কুলের অধিকাংশ মেয়েই।এছাড়াও আমি ছিলাম মিশুক,সাহায্যকারী।আর যে কাউকে মুগ্ধ করার অসাধারণ গুন ছিল আমার।আমার কথার মাধ্যমে আমি যে কাউকেই খুব সহজেই বশ করে ফেলতাম।আর এসব গুনের সমন্বয়েই আমি ছিলাম অন্যদের থেকে কিছুটা আলাদা।যে কেউ ই আমাকে সরল ভেবে বিশ্বাস করে ফেলতো।

তবে আমি জানতাম যে আমি একটা মাকাল ফল।মিথ্যার সাথে সখ্যতা গড়ে বাস্তব জীবনে অভিনয় করতে আমি বেশ ভালই পারদর্শী ছিলাম।আমার ভীতরটা যে কেউ সহজে পড়তে পারত না।এজন্য অসংখ্য প্রেম করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।

অহনা আমাকে পেয়ে যেন চাঁদ হাতে পেয়েছে এমন একটা অবস্থা।ধীরে ধীরে সে আমাকে আবিষ্কার করল যে আমি আসলে প্রকৃত পক্ষে কেমন!!কিন্তু বেশি দেরি হয়ে গিয়েছিল।
ওর উইকপয়েন্ট টা আমি জানতাম।ঐ উইকপয়েন্ট এ বার বার আঘাত করে ওকে মানসিক ভারসাম্যহীন করে তুলে ছিলাম এই আমি,অায়ান চৌধূরী।যার ফল এই মেয়েটা সারাজীবন কুমারী থেকেই ভোগ করছে।

পাপের রোমন্থন :
আরও কতশত পাপ করেছি,যার কোনো ক্ষমা নেই।আমি যে কত খারাপ মানুষ এটা একমাত্র আমিই জানি।আমার শাস্তি হবে না তো কার শাস্তি হবে?আমার মেয়েটা নিষ্পাপ হয়েও ও আমার পাপের সাগরে নিজেকে জলাঞ্জলি দিল!ভাবতেই বুঝতে পারলাম কত বড় অধম বাবা ছিলাম আমি।

অনুধাবন:
অন্ধকার বারান্দায় বসে যখন নিজের পাপের চপেটাঘাত খাচ্ছি তখনই ফজরের আজানের সুমধুর সুর কানে ভেসে আসলো।এই প্রথমবার বোধহয় আমি মনোযোগ দিয়ে আজান শুনলাম।

মুয়াজ্জিন যখন বললেন,"হাইয়া 'আলাস সালাহ্,হাইয়া 'আলাল ফালাহ্।অর্থাৎ সালাতের জন্য এসো,কল্যাণের জন্য এসো।"তখন আমার মনে হলো কল্যাণ বুঝি এইখানেই।
কিন্তু পরক্ষণে আবার মনে হলো,আমার মত পাপী যাবে মসজিদে নামাজ পড়তে?আল্লাহ কি আমাকে মাফ করবেন?তখন মনে পড়ল হলে থাকতে আমার রুমমেট আয়াজের পঠিত কুরআনের সেই আয়াতটি-
"কিন্তু যারা তওবা করে আর নিজেদের সংশোধন করে ও আল্লাহর আয়াতকে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে,এরাই তো তারা যাদের আমি ক্ষমা করি,আর আমি ক্ষমাকারী পরম দয়ালু।"(২:১৬০)

তারমানে জীবনের এই অধঃপতনের ঘন কুয়াশা ঘেরা আঁধারেও আশার আলোর সন্ধান কি আল্লাহ আমাকে পাইয়ে দিলেন?আমাকে?এই অধমকে?এত পাপ করার পরেও?আল্লাহু আকবার!

এই ইসলামেই পরম শান্তি,সকল দুনিয়াবী কষ্টের অবসানও এখানে,আলহামদুলিল্লাহ!!অফুরন্ত সুখের পরশ যেন এখনই আমার হৃদমাঝারে প্রবাহিত হচ্ছে।
আর দেরী নয়।এখনই সময় আমার পাপ স্বীকার করে অশ্রুসিক্ত নয়নে আমার মালিকের দরবারে আমি কড়া নাড়ব।তিনি নিশ্চয়ই আমার জীবনের ঊষর মরুতে শান্তির ফুল ফোটাবেন।

আয়ান চৌধূরী আজ মন থেকে নামাজ কায়েম করছেন।সিজদায় গিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে নিজের সকল কুকর্মের কথা স্বীকার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।নামাজ শেষ করে নিজেকে বেশ হালকা লাগছে ওনার।

কি মনে করে যেন সকালে ব্রেকফাস্ট না করেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন।নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে আনন্দপুর গ্রামের রাস্তায় পাড়ি জমালেন।গাড়ি গিয়ে থামল একটা ভাঙ্গা বাড়ির খড়ের পালার সামনে।

উঠোনে বেশ কয়েকজন টুপি-পাঞ্জাবি পড়া লোকের সমাবেশ।একজন বয়স্ক মহিলা কাঁদছে।ওনার পাশেই বিশাল এক কাঁঠাল গাছের সঙ্গে পায়ে শিকল বেঁধে রাখা এক অবলা।যার পরনে নোংরা মলিন কাপড়,চুলগুলো এলোমেলো।

আয়ান চৌধূরী গাড়ি থেকে নামছে,সকলের দৃষ্টি তাঁর দিকে নিবদ্ধ। উনি সমাবেশে এসে শুনলেন অহনার বাবা আজ মারা গিয়েছেন।ওনার স্ত্রী আর পাগল মেয়ের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না অহনার একমাত্র ভাই-ভাবী।______এই নিয়ে গ্রাম্য সালিশ চলছে।
আয়ান সকলের কথা শুনে বললো,আমি অহনাকে বিয়ে করে অহনা ও তার মায়ের দায়িত্ব নিতে চাই।আপাতত আমি ওকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ডক্টরকে দেখিয়ে ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী ওর ট্রিটমেন্ট করাব।তারপর সুস্থ হলেও ওকে আমি বিয়ে করব,অসুস্থ থাকলেও ওর সব দায়িত্ব আমার।আপনাদের কোনো আপত্তি আছে কি?

গ্রামের কারো কোনো মাথাব্যথা নেই ওদের নিয়ে আর ভাই-ভাবী তো ওদের আপদ মনে করে।চলে গেলেই সকলেরই ভাল।তাই ওনার প্রশ্নের উত্তরে গ্রামের সকলেই একসাথে বললো,নাহ তাদের কোনো আপত্তি নেই।তারপর উনি ওনার বাসার ঠিকানা সকলকে দিয়ে অহনা ও তার মা কে নিয়ে ঢাকায় চলে আসলেন।

দুই বছর পর:

অহনা মোটামুটি সুস্থ।আয়ান চৌধূরী তাঁর দেয়া কথানুসারে অহনাকে বিয়ে করেছেন।অহনার মাও ওনাদের সঙ্গে থাকেন।স্টাইলিং-ড্যাসিং আয়ান চৌধূরীর মুখে এখন নবীর সুন্নাত দেখা যায়,নিজের করা সকল অপকর্মের জন্য সকলের কাছে গিয়ে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চেয়েছেন।শুধু তাই নয়,উনি এখন নবীর সুন্নাত অনুসারে জীবন অতিবাহিত করছেন।নিজ স্ত্রীকে নিয়ে রাতের শেষ প্রহরে তাহাজ্জুদও আদায় করেন প্রতিনিয়ত।এভাবেই চলছে উনাদের সুখী দাম্পত্য জীবন।

স্ত্রী পরিপূর্ণ সুস্থ হলে তিনি নিয়ত করেছেন পরের বছর আল্লাহ নসীবে রাখলে উভয়ই হজ্জ পালন করবেন,ইনশা-আল্লাহ্।

আল্লাহর কথা সত্য।তিনি বলেছেন: "আল্লাহ দারুসসালাম[শান্তির আবাস]এর দিকে ডাক দেন আর যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন।"(সূরা ইউনুস:২৫)

পঠিত : ৬৬৮ বার

মন্তব্য: ০