Alapon

#বীর_সেনানীদের_গল্প : |||আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু|||



ছিলেন শায়িরুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু, আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালামের কবি। ওনার ব্যক্তিগত কাতিব। তিনি আকাবার প্রথম শপথের ছয় জনের একজন ছিলেন। আকাবার তৃতীয় শপথের ৭০ জনের সাথে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বনু আল-হারিসার দায়িত্বশীল মনোনীত হন। এবং তিনি মদিনায় ইসলাম প্রসার-প্রচারকার্য পরিচালনা করেন। রাসুলে আকরাম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিকদাদ ইবন আসওয়াদ আল-কিন্দীর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সাথে তাঁর ভ্রাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। ছিলেন মুত'আর যুদ্ধের গর্বিত তিনজন শহীদ সেনাপতির অন্যতম। জিহাদের ময়দানে মুজাহিদদের নেতৃত্ব দিয়ে কুফফারদের সঙে সম্মুখ-সমরে লড়াই করতে করতে শাহদাতের অমীয় সুধা পান করে ফিরদৌসের সবুজ আঙিনায় গিয়ে হাজির হন।

নবিজী সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ভালোবাসার টানে তিনি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লাম যেদিন মদিনায় আগমন করেন সেদিন তিনি তার গোত্রের লোকজনকে নিয়ে ওনার উটের পথে দাঁড়ান বাধার প্রাচীর হয়ে। আর বিনীত সরে তাদের কাছে অবতরণের আবেদন জানান। আবার আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশের প্রেক্ষিতে সরেও যায়। শুধু তা নয় রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লামের সকল আদেশেই তিনি পালন কতেন অক্ষরে অক্ষরে।

বদর-উহুদ, খন্দক, হুদাইবিয়া, খাইবার, প্রত্যেকটি জিহাদের বীরবিক্রমে সিংহগর্জনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। বাইয়াতুর রেদওয়ান এবং হুদাই বিয়ার সন্ধির ছিলো প্রত্যক্ষদর্শী-উপস্থিত!


মু'মিনদের প্রতি তিনি যেমন ছিলেন রহমদিল তদ্রূপ কুফফারদের জন্য ছিলেন বজ্রকঠিন! নবীজি সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লাম বদর যুদ্ধের সমাপনীর পর বন্দী হওয়া কাফির কুরাইশদের সম্পর্কে সাহাবীদের মতামত জানতে চাইলে তিনি তাদেরকে অসংখ্য জ্বালানী কাঠে পরিপূর্ণ একটি উপত্যকায় জড়ো করে সেটার মধ্যে ফেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলার মতো বজ্রকঠিন দুঃসাহসিক আগ্রহ প্রকাশ করেন!

জিহাদের ময়দানে তিনি নিজেই যে বীরবিক্রমে লড়াই চালিয়ে যেতেন তা নয় শুধু। তাঁর কবিতাও জিহাদের ময়দানে মুজাহিদদের জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণা হিশেবে কাজ করতো। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লাম আবৃতি করতেন তাঁর কবিতা। খন্দক যুদ্ধের সময় রাসূলে কারীম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রচিত কবিতা বার বার আবৃত্তি করেছিলেন। কী সৌভাগ্যের অধিকারী তিনি! যে মুখে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার পবিত্র কালামের বাণী শুনতো আসহাবে রাসুল, সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লাম। সেই মহাপবিত্র মুখেই আবৃত্ত হতো তাঁর রচিত কবিতা। তা-ও জিহাদের ময়দানে। মুজাহিদদের সম্মুখে!

শুধু সেরা কবি আর সমরবিদই নয় তিনি, ছিলেন আল্লাহর রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লামের বিশ্বস্ত অনুচর এবং বুদ্ধিমান কুটনৈতিকও। বনু কুরাইজার নেতা কাব ইবনে আসাদের বিশ্বাস ঘাতকতা ও উসাইর ইবনে রাজিম এবং তার ষড়যন্ত্রের তথ্য তিনিই অবহিত করেন আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট। ইবনে রাজিমকে তিনিই হত্যা করে জাহান্নামের অতল গহ্বরে প্রবেশের পথ সুগম করে দ্যান।

চরম শত্রুদের সঙ্গেও তিনি জুলুম করতেন না। কোনো লোভনীয় প্রস্তাব কিংবা লালসায়ও করতেন না মাথা নত। হন নি আদর্শচ্যুত। ন্যায় বিচারের এক অনন্য দৃষ্টান্তও ছিলেন। আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লাম ওনাকে খাইবারে খেজুর পরিমাপক হিশেবে নিয়োগ করলে তাঁকে ঘুষের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে তাঁর জবাব ছিলো, "তোমরা কি আমাকে হারাম খাওয়াতে চাও? আমি আমার প্রিয় ব্যক্তির পক্ষ থেকে এসেছি এখানে। আমার নিকট তোমরা বানর ও শুকর থেকেও ঘৃণিত। তোমাদের প্রতি ঘৃণা এবং তাঁর প্রতি ভালোবাসা তোমাদের ওপর কোন রকম জুলুমের দিকে নিয়ে যাবে না আমাকে।"

আল্লাহর ভয়ে বিগলিত ছিলো তার হৃদয় কানন।
ইসলামের এতো এতো খিদমতগারি হয়েও তিনি পুলসিরাত পার হবার চিন্তায় কতোটা মশগুল ছিলেন, মূত'আর যুদ্ধে যাবার সময় তার যে কথা যে চিন্তাধারা তা ফুটে উঠে। মানুষেরা জিহাদের ময়দানে যাবার সময় ওনাদের বিদায় দেয়ার প্রক্কালে বলেন ''তোমরা নিরাপদে থাকো এবং কামিয়াব হয়ে ফিরে এসো। তিনি তখন কাঁদতে লাগলেন। মানুষেরা ওনাকে যখন প্রশ্ন করলো কাঁদার কী আছে? তখন তার জবাব ছিলো --দুনিয়ার প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে আমি কাঁদছিনা। তিনি সূরা মারিইয়ামের ৭১ নং আয়াত পাঠ করেন। তারপর তিনি বলেন, আমি কি সেই পুলসিরাত পার হতে পারবো? তখন সকলে তাকে সমস্বরে সান্ত্বনা দিয়ে বলল আল্লাহ তোমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে আবার মিলিত করবেন।

নিজ স্ত্রীর প্রতি দরদ ভালোবাসার আবেগ প্রকাশেও ছিলেন অনন্য দৃষ্টান্তের অধিকারী তিনি। মাঝেমাঝে প্রিয়তমা প্রেয়সী স্ত্রীর কোলেও মাথা রেখে শুয়ে খাকতেন। ওই যে কান্না করা, এটা তিনি নিজ স্ত্রীর কোলে শুয়েও হঠাৎ হুহু করে কেঁদে উঠতেন। স্ত্রীর কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি এই জবাবটা-ই দিতেন। মানে সুরা মারইয়ামের ৭১ নাম্বার আয়াতটা তিলাওয়াত করতেন। আর বলতেন জানি না আমি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবো কিনা!

বিখ্যাত সাহাবী আবু দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন ওনার চাচাতো ভাই। ওনার প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়েই তিনি ইসলামের আলোয় আলোকিত হন।

মানুষের বিবাদ মিমাংসায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়।
বিখ্যাত সাহাবি কবি হাসসান বিন সাবিত আর সাফওয়ান ইবনে মুয়াত্তালের মাঝে মারামারি তিনিই থামিয়ে দ্যান এবং তাদের রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে আসেন।

এই তিনিই ইসলামের পূর্বেও যেমন মর্যদাবান ছিলো, শিক্ষিত ছিলো তদ্রূপ ইসলামে আসার পরেও ছিলেন মর্যদাবান। আর কবি হাসসান বিন সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সমমানের কবিই ছিলেন তিনি।

ইসলামের পূর্বে তার কবিতার মাঝে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ আর ঠাট্টা মশকরায় পরিপূর্ণ থাকলেও ইসলামে প্রবেশের পর তার কবিতায় ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতো আল্লাহ প্রেমের বন্দনা। দ্বীন প্রচারের প্রেরণা আর কুফফারদের মোকাবিলায় এক অদম্য তাওহীদি শব্দের কারিগরী!

মদীনার খাযরাজ গোত্রের বনী আল-হারিস শাখার সন্তান তিনি। হ্যাঁ, তিনি আর কেউ নন। তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।

তাঁর সম্পর্কেই আল্লাহর নবী বলেন, ''আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা কতোই না ভালো মানুষ!"

আহা, কী সৌভাগ্যবান এক প্রজন্মের মানুষ ওনারা। যাদের শ্রেষ্ঠত্বের আর ভালোত্বের সার্টিফিকেট তিনিই দিলেন, যার সার্টিফিকেট দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা।


#বীর_সেনানীদের_গল্প

|||আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু|||
~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৮৬১ বার

মন্তব্য: ০