Alapon

আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী...



২০১৩ সালের ৫ই মের শাপলা ঘটনা দিয়েই আমার রাজনৈতিক লেখালেখির শুরু, আমার অন্তরাত্মার পুনর্জাগনর। এর আগে 'আই ডোন্ট কেয়ার এবাউট পলিটিক্স' গোত্রের একজন ছিলাম আমি। চুপচাপ বিরক্ত নিয়ে শাহবাগের বিচার না মেনে ফাঁসী চাওয়া দেখে যাচ্ছিলাম আর এক জেনারেশানের বিবেক আর বিচারবোধের মৃত্যু অবলোকন করছিলাম। ভেবেছিলাম দেশ শেষ, যেই দেশের মানুষ এভাবে আদালত আর বিচার বিভাগের শেষকৃত্যে এবং মানুষের ফাঁসিতে খুশির চোটে নাচানাচি করে মিষ্টি খায় সেই দেশে বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ বাস করে না। সেই দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

সেই মুহূর্তে ৫ই মে তে শাহাবাগের কাউন্টারে হেফাজতের আগমন ছিল যেন আমার জন্য 'ওয়েট এ মিনিট, দেয়ার ইজ মোর ' মোমেন্ট। তাদের সব দাবীর সাথে একমত না হলেও তারাও যে একটা হেভী ওয়েট ফোর্স সেটা দেখে খুব খুশি হয়েছিলাম। চেয়েছিলাম কেউ আসুক, শাহাবাগ থামাক, আর এসেছিল হেফাজতীরা। সে রাতে হেফাজতিরা গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিল বটে, কিন্তু অদৃশ্য শক্তিতে শাহাবাগ থেমে গিয়েছিল। সেই থেকে শাহাবাগ আর মাথা তুলতে পারেনি। সেই কৃতিত্ব হেফাজতের। আর হেফাজতের কর্মী-ছাত্র থেকে শুরু করে জনগন সেই ৪-৫ তারিখে শাহাবাগে এসেছিল শফি হুজুরের ডাকেই।

কিন্তু শেখ হাসিনার ৫ ই মে এর হেভী হ্যান্ডেড এপ্রোচ, নিরীহ হেফাজতীদের মৃত্যু, আল্লামা শফী হুজুরের এবাউট টার্ন, সংসদে শেখ হাসিনার 'রঙ মেখে শুয়ে থাকার ' মিথ্যাচার, শফি হুজুরের ছেলে আনাস মাদানীর লোভের দাপটে হেফাযতের ভিন্ন পথে হাটা, যেই আওয়ামী সরকারের আদেশে নিরীহ হেফাজতিদের একদিন প্রাণ হারাতে হয়েছিল, সেই আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার সাথে একই মঞ্চে বসে অনুষ্ঠান পালন, আমাকে বিশেষ ভাবে ব্যাথিত করেছিল।

ব্যাথিত করেছিল এই কারনে যে শফি হুজুর ভিন্ন মাত্রার মানুষ ছিলেন। শেষ বয়সে এসে ওনার সে উচ্চ মাত্রায় কালিমা লাগতে দেখে কষ্ট পেয়েছিলাম। বুজুর্গ মানুষ, আলেম মানুষ তাই কখনও ওপেন ভাবে নিজের মনের কথা বলি নাই। কিন্তু ছেলেমেয়ের কাছে বাবামা যে কতোটা অসহায় হতে পারে তার উদাহরণ আল্লামা শফি হুজুর । আমরা সাধারন মানুষের এই দশা হতে পারে, কিন্তু দুর্দান্ত শফি হুজুরের এই দশা দেখে বুকে কাপন ধরেছিল।

সেই শফি হুজুর মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেই হেফাজতের ছাত্র আন্দলনের চাপে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। ছেলে আনাস মাদানী হয় স্থায়ী ভাবে বরখাস্ত। তিনি আরও কিছুদিন বেচে থাকলে হেফাজতের উপর থেকে মাদানী গ্রুপের কালো ছায়া নীরবে আস্তে আস্তে হয়তো সরে যেতে পারত। এখন ওনার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নতুন ভাবে মাদানী গং বিরোধ করার চেষ্টা করছে যা খুবই দুঃখ জনক। একেবারে শেষ মুহূর্তে ওনার বিরুদ্ধে ছাত্রকুলের এই বিরোধ ওনাকে ব্যাথিত করেছিল, হয়ত এই চাপ ওনার পক্ষে নেয়া খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল, কিন্তু তাহলে এই বয়সে এমন বৃহৎ প্রতিষ্ঠান চালানও ওনার জন্য কঠিন ছিল, ওনার পদত্যাগ চাওয়াটা আমার কাছে যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু তারা চেয়েছিল ওনাকে পদে রেখে তাদের আখের গুছিয়ে নিতে।

আরেকটা ব্যাপার, শাহাবাগীরা যেসব কাজের পক্ষ নেয় বুঝতে হবে সেখানে রাজনীতির কালো ছায়া পড়েছে, ইসলাম বিরোধী কাজ ভালো ভাবে এগুচ্ছে। আনাস মাদানী তাই তাদের এতো পছন্দ, শফি হুজুরকে ক্ষমতায় রেখে হেফাজতকে দুর্বল করা তাদের জন্য জরুরী ছিল। কিন্তু আজ শফি হুজুরের অন্তর্ধানে তাদের সেই খেলা বিঘ্ন হয়েছে। তাতেই তারা ব্যাথিত। অবশ্য পূর্ণ উদ্যমে নতুন করে আবার তারা খেলার ছক কাটেত বসে গেছে। কেবল শেখ হাসিনা এখন আর পুরাপুরি ভারতের আচলের তলায় নাই বলে হয়ত এই মুহূর্তে কিছুটা সময় পাচ্ছে। আমাদের কাছে শাহাবাগিদের পক্ষ-বিপক্ষ হচ্ছে লিটমাস টেস্ট। শাহাবাগীরা হচ্ছে ঘোর ইসলাম বিরোধী, তারা যার পক্ষ নেয় বুঝতে হবে তিনি অজান্তে হলেও দেশে ইসলামের ক্ষতি করছেন।

তারপরেও শফি হুজুরের অবদান বাংলাদেশে অনেক। হেফাজতের যেই প্রতিষ্ঠান উনি গড়ে গেছেন, যেখান থেকে বাংলাদেশে অনেক বড় বড় আলেম শিক্ষা গ্রহন করে দেশে ইসলামিক ধারা বজায় রেখেছে সেই কৃতিত্বের বিরাট অংশীদার আল্লামা শফি। দেশের অন্যান্য নামকরা রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন যা করতে পারে নি, যেখানে তারা বনেছে তাদের নেতাদের হাতিয়ার, সেখানে হেফাজতের ছাত্রদের আমরা দেখতে পাচ্ছি ভিন্ন রুপে। তাদের নিজেদের সর্বময় নেতার পদত্যাগ দাবী করার মতন সাহস আছে, তার ছেলের বহিষ্কার করার মতন বুকের পাটা আছে। আমরা এই যে হেফাজতের ছাত্রদের মাঝে বিবেক অক্ষুণ্ণ রেখে ইন্ডিপেন্ডেন্ট চিন্তা করার শক্তি দেখতে পাচ্ছি তার কৃতিত্বের অংশীদার শফি হুজুর। ইন দিস সেন্স উই ক্যান কল হেফাজতিজ আর ভেরী প্রগ্রেসিভ। তারা তাদের নেতার পা চাটে না দেখে ভালো লাগল। সব ছাত্র সংগঠনগুলোর এরুপ হওয়া উচিৎ ছিল।

১০৫ বছর বয়সে আল্লামা শফি হুজুর ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহ ওনার সব ভুল ত্রুটি মাফ করে দিয়ে ওনাকে যেন বেহেশত নসীব করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

"আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী"।

- সাবিনা আহমেদ

পঠিত : ৯৯৪ বার

মন্তব্য: ০