Alapon

উইলিয়াম হেনরি কুইলিয়াম থেকে আব্দুল্লাহ কুইলিয়ামে রূপান্তর হওয়ার গল্প...


"Les prières sont la clé du paradis" বাক্যটিতে কি বলা হয়েছে আপনি কি ধরতে পেরেছেন? আমরা অনেকেই হয়তো উচ্চারণের সময় পুরো বাক্যটির দিকে ঠিক ভাবে লক্ষ্যও করিনি।

যারা নিজ মাতৃভাষা ব্যতিত অন্য ভাষায় পারদর্শী নই তাদের ক্ষেত্রে,

প্রথম দৃষ্টিতে দেখেই ব্রেইন সিগনাল দিবে, এটি একটি নতুন/অপরিচিত বাক্য। এরপর এটির অনুবাদ না জানার কারনে ব্রেইন এবার সিগনাল দিবে এটি অপ্রয়োজনীয়ও বাক্য! সুতরাং একটা সময় গিয়ে ব্রেইন বাক্যটিকে ভুলিয়ে দিবে।

অথচ এই বাক্যটি যদি সরাসরি এভাবে উপস্থাপন না করে, এর অনুবাদ সাথে দিয়ে দেয়া হতো অথবা ব্যবহারিক ভাবে উপস্থাপন করা হতো তাহলে সহজেই বোধগম্য হতো তাদের জন্য যারা এই বাক্যের সাথে পুরোপুরি অপরিচিত।

নতুন এবং চমৎকার কিছু বুঝতে পাড়ায় তখন ব্রেইন স্বইচ্ছায় এটিকে নিজের সেইলে লক করে রাখতো।

যেমনটা হয়তো হবে এখন আমাদের ক্ষেত্রে,

"Les prières sont la clé du paradis" এটি একটি ফ্রেঞ্চ ভাষা যার অর্থ "নামায জান্নাতের চাবি।"

বাংলা অনুবাদ দেখে ব্রেইন এখন শান্ত। একটা সিধান্তে পৌঁছাতে পেরেছে যে

নাহ! এর অর্থ তো খুবই সুন্দর। অথচ এক মিনিট পুর্বেও এটি নিরর্থক লেগেছিলো।

এটাই মানব সাইকোলজি। এই মানব সাইকোলজি বড়ই অদ্ভুত!

নিজ থেকে জানার ইচ্ছা খুব কম মানুষের মধ্যেই থাকে। বেশিভাগ ক্ষেত্রেই মানবজাতি অনুপ্রেরণা পেয়েই নতুন বিষয় জানতে এবং বুঝতে চেষ্টা করে। আর সে নতুন বিষয় যদি হয় মন-মুগ্ধকর তাহলে তো আর কথাই নেই, ধরে নিন আপনার ব্রেইন একদম প্রস্তুত বিষয়টাকে নিজের মধ্যে জায়গা করে দিতে।

মানব সাইকোলজির ব্যাপারকে সাথে নিয়েই এখন মূল কথায় আসা যাক।

"ইসলাম একটি ধর্মের নাম", "মুসলিম একটি জাতি"। যেকোন নন মুসলিমের মৌলিক ভাবনা এটাই।

অন্য ধর্মাবলম্বীর লোকেরা আমাদের ইসলামকে চিনেনা, তারা এর অর্থও জানে না, তবে যানে ইসলাম বলে কিছু একটা আছে। তারা সৃষ্টিকর্তাকে চিনেনা, তবে এটা ঠিকই জানে মুসলিমরা একজনকেই নিজেদের রব্ব হিসেবে মানে।

তাদের এই প্রাথমিক ধারণার উৎস টা আসলে কি? তারা কি কুরআন থেকে জেনেছে? নাকি হাদিসের বই পরে বুঝেছে যে, আসলে এরা মুসলিম, ইসলাম এদের ধর্ম এবং আল্লাহ তাদের একমাত্র রব্ব?!

না! এর কোনোটিই তাদের জানার উৎস নয়।

অমুসলিমরা শুধু চিনে আমাদেরকেই অর্থাৎ এই সত্য ইসলামকে বহনকারী মুসলিমদের।

তারা লক্ষ্য করে আমাদের চালচলন, ব্যবহার, বিশ্বাস, এবং এক আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠা।

কোনো অমুসলিম যখন দেখবে হাজারো ঝড়-ঝাপটার মাঝেও মুসলিম ব্যাক্তি তার নামায ছেড়ে দিচ্ছে না বরং এর মাধ্যমেই সকল সমস্যার সমাধান খুজছে! এতেই তাদের মনের কড়া নড়ে, আকৃষ্ট হয়।


তাদের মনে প্রশ্ন জাগে, জানতে চায় ইসলামের মধ্যে এমন কি আছে যা তাদের এত্তো মনশক্তি যোগায়?!

ঠিক যখন-ই এরকম কৌতহলি প্রশ্ন নিয়ে কোনো অমুসলিম বান্দা আল্লাহর দরবারে হাজির হয়, তখনই হয়তো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা তার হেদায়েতের চাদরে বান্দাকে জড়িয়ে নেন।

এমনটাই ঘটেছিল বিটিশ কালের সর্ব প্রথম নওমুসলিম "উইলিয়াম হেনরি কুইলিয়ামে" এর সাথে। যার জীবনীতে তাকালে লক্ষ্য করা যায় অনুপ্রেরণা এবং সত্যের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার চমৎকার মেলবন্ধন।

"উইলিয়াম হেনরি কুইলিয়াম" প্রথম ব্রিটিশ নওমুসলিম। তিনিই খিস্ট্রিয়ান থেকে ইসলাম গ্রহনকারী প্রথম ব্রিটিশ নাগরিক । তিনি পেশায় ছিলেন একজন দক্ষ আইনজীবী।

উইলিয়াম হেনরি কুইলিয়াম জীবনে প্রথম বারের মতো ইসলামের সাথে পরিচিত হোন মুসলিমদের দেখেই। অলৌকিক কিছুই ঘটেনি সেদিন শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলেন আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসীদের বাস্তব রূপ।

ঘটনার সুত্রপাত হয়েছিল তার স্বাস্থের অবনতির সাথে,

উইলিয়াম হেনরি কুইলিয়াম তার ডাক্তারের পরামর্শে ১৮৮৭ সালে চিকিৎসার জন্য জাহাজে করে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে মরক্কো গমন করছিলেন। জাহাজে থাকাকালীন সময় তিনি পরিচিত হোন একদল ইসলাম প্রচারকারী হাজী সাহেবানদের সাথে।

হাজী সাহেবানদের ব্যবহার এবং নামাযের প্রতি তাদের একাগ্রতা তাকে এতটাই মুগ্ধ করে যে, সে সেই নামাযরত হাজী সাহেবানদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে ইসলামের ব্যাপারে আরও জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেন।

তিনি সেই নামাযরত হাজীদের প্রসঙ্গে বলেন,

"উত্তাল ডেউ এবং প্রবল বাতাসে জাহাজটি দুলছিল, এমনকি ডুবে যাওয়ার আশংকা ছিলো। কিন্তু এর কোনোটিরই আতংক তাদের চেহারায় আমি দেখতে পাইনি। আমি তাদের এভাবে নামায পড়তে দেখে ভীষণ অবাক হই। তাদের চেহারায় যে প্রশান্তির ছাপ ছিল তা স্রষ্টার প্রতি তাদের অটুট বিশ্বাস আর আনুগত্যের প্রমাণ।"

পরবর্তীতে ইসলামের প্রতি আরো জানতে চাওয়ার আগ্রহের ফলশ্রুতিতে,

তিনি সে সময়ে মরোক্কোতে আরো কিছুদিন অবস্থান করেন এবং ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করেন।

এবং অবশেষে ১৮৮৭ সালে ৩১ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন আব্দুল্লাহ কুইলিয়াম।

তাঁর এই নতুন বিশ্বাসকে বর্ণনা দিয়ে বলেন,

"ব্যক্তিগতভাবে আমি অনুভব করেছি যে এটি আমার বিশ্বাসের সাথে বিরোধী নয়। তাই ইসলাম গ্রহণ করা আমার কাছে খুবই যুক্তিসংগত ব্যাপার মনে হয়েছে।"

প্রথম ব্রিটিশ নওমুসলিম আব্দুল্লাহ কুইলিয়াম ইসলামকে গ্রহণ করার পর থেকেই শুরু করেন দাওয়াতি কার্যক্রম।

স্বজাতীদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাচানোই যেনো তৎকালীন সময় নিজের জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন।

১৮৮৯ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে এসে তিনি একজন প্রচারক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এবং এর ফলস্বরূপ তিনি যুক্তরাজ্য জুড়ে প্রায় ৬০০শত জনেরও বেশি বিধর্মীদের কাছে ইসলাম ধর্মের সত্যতা প্রকাশ করে। এবং তাদের ইসলাম গ্রহণে ব্যাপক ভুমিকা রাখেন।

তার দাওয়াতি কাজের ফলে অনেক উচ্চশিক্ষিত এবং সমাজের প্রভাবশালী ব্যাক্তিত্ত্ব ইসলাম গ্রহণ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন ব্যাক্তিবর্গ হলেন, স্ট্যালেব্রীজ এর মেয়র রিশেড পি. স্ট্যানলী, প্রফেসর নাসরুল্লাহ ওয়ারেন, প্রফেসর হাশেম উইল্ড।

জাপানের প্রথম মুসলিম ব্যাক্তিটিও তার মেহনতের ফসল।

এছাড়াও আব্দুল্লাহ কুইলিয়ামের কৃতিত্বের মধ্যে অন্যতম দুটি নিদর্শন হচ্ছে ইসলামের বিস্তার ঘটাতে নিজ লিখায় বই প্রকাশ এবং মসজিদ নির্মাণ।

১৮৮৯ সালে ব্রিটেনের লিভারপুল শহরে সর্বপ্রথম মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদটির নাম শাহজাহান মসজিদ। সেই সুবাদে সময়টিকে অনেকে "ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর" হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন।

এবং সেই সাথে একই বছরেই তিনি ইসলাম প্রচার ও ইসলামের মূলনীতি সংক্রান্ত পুস্তক " দ্য ফেইথ অব ইসলাম " রচনা করেন। অল্প সময়ের ব্যবধানেই বইটি বিরাট সারা তুলে। আব্দুল্লাহ কুইলিয়াম রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে ইসলামের সত্যতা প্রকাশের জন্য "দ্য ফেইথ অব ইসলাম" বইটি উপহার করেন। পরবর্তীতে রানী ভিক্টোরিয়া বইটি পড়ে এতোটাই মুগ্ধ হয় যে তিনি তার পরিবারের সদস্যদের জন্য আরো ছয় কপি বই সরবরাহের জন্য আদেশ দিয়েছিলেন ।

আব্দুল্লাহ কুইলিয়ামের এমন কীর্তির জন্য ।উসমানী খলিফা সুলতান আবদুল হামিদ (২য়) তাকে ব্রিটেনের ‘শাইখ-আল-ইসলাম’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এছাড়াও, আমিরে আফগানিস্তান তাকে 'শাইখ-আল-মুসলিম' উপাধিতে ভূষিত করেন এবং লিভারপুলের পারসিয়ান উপ-উপদেষ্টা পদে নিয়োগদান করেন।

তার পেশাগত জীবনে তিনি সুবিধাবঞ্চিতদের অধিকার সম্পর্কে দৃঢ় ভাবে কাজ করতেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার নিয়ে তিনি বেশ সোচ্চার ছিলেন। তেমনই এক বিবাহ বিচ্ছেদের সাহায্য করতে গিয়ে তার ওকালতি পেশা হুমকির মুখে পড়ে। এবং এক সময় তাকে নিজের জন্মস্থান লিভারপুল ত্যাগ করে কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তানবুল) গমন করতে হয়। এবং পরবর্তীতে তিনি হেনরি মুস্তাফা লিওন নাম নিয়ে যুক্তরাজ্যে ফিরে আসেন।

আব্দুল্লাহ কুইলিয়ামের খ্রিষ্টান থেকে নওমুসলিম হবার এই চমৎকার যাত্রার সমাপ্তি হয় তার মৃত্যুর সাথে। ১৯৩২ সালের ২৩ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং সে মাসের ২৮ তারিখে তাকে লন্ডনের ওকিংয়ের ব্রুকউড গোরস্তানে সমাহিত করা হয়।

একদল হাজীসাহেবানদের নামায পরতে দেখে মুগ্ধ হয়ে যদি একজন খ্রিষ্টান ইসলাম গ্রহণ করে এবং এই ইসলামকে প্রচার করতেই নিজের বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়। তাহলে কল্পনা করে দেখুন আমরা নামধারী মুসলিমরা যদি তাদের আকীদা, সারিঈয়া

পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মেনে চলি তাহলে এর প্রভাব কতোটা বিশাল হবে।

শেষ করতে চাই রাশিয়ার একজন বিখ্যাত মার্শাল আর্টিস্ট "খাবিব নুরমাগমেদভ" উনার এক সুন্দর উক্তি দিয়ে,

__"Non muslims don’t read the Quran, they don’t read the Hadith, they read you. So be a good ambassador of islam! Let them see the Quran and Sunnah in you"

- CLtd

পঠিত : ৪৩৭ বার

মন্তব্য: ০