Alapon

প্রশান্তি

১. আজ তাদের আড্ডার দিন। আড্ডাটা আজ নিবিড় সবুজে ঘেরা শ্যামপুর ওয়াসায়। বিকেল হলেই এখানে হাজারো মানুষের আনোগোনা। ছোট বড়ো সকল বয়সী মানুষেরই পদচারণায় মুখরিত থাকে জায়গাটা। মানুষ আসে এখানে বাতাসের আদর গায়ে মাখিয়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহটাকে একটু সতেজ করতে। শিফুরাও আসলো তিন বান্ধবী মিলে। তারা তিন প্যাকেট বাদাম নিয়ে বসে পড়লো সবুজ সতেজ ঘাসের ডগায়। আড্ডার ফাঁকে নানান রকম গল্প উঠে এলো। নিপুর মনে দারুণ কিছু কষ্ট কিছু ক্ষোভ জমে আছে। বোঝাই যাচ্ছে।

নিপু কথাচ্ছলে শিফুকে বলে উঠলো, আচ্ছা তুই এরকম ক্ষ্যাত মার্কা চলাচল করিস ক্যান এখনো? কালো কালো বস্তার মতো কী সব গায়ে দিয়ে রাখিস! লাইফ তো একটা, তাকে এভাবে রসকষহীন কাঠখোট্টা করে বসে থেকে কোনো লাভ আছে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপানো বিধিনিষেধ আচার-প্রথা আর ভয় তোকে আজও ছাড়লো না? কী লাভ এতে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপানো সব নিয়ম পদ্ধতি ছুঁড়ে ফেলে দে না এবার! পুরুষ জাতটাই তো খারাপ! নিজের স্বার্থে এরা সব করে! দেখিস না যাকেই ভালোবাসি সে-ই ধোঁকা দেয়! সে-ই স্বার্থ হাসিল করে কেটে পড়ে....

শিফু এবার মনে মনে পাইছি পাইছি বলে লাফিয়ে ওঠে! আর বলে শোন নিপু মূল পয়েন্টই এটা! তুই নিজে আল্লাহর বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে তোর সামান্য নফসের খায়েশ মেটাতে সবই তো করলি, আর এখন এতো কথা, এতো ক্ষোভ প্রকাশ করছোস পুরুষদের পাশাপাশি আমার দ্বীনি জীবনপদ্ধতির ওপরও! আচ্ছা শরীয়তি দৃষ্টিভঙ্গী বাদ দিয়ে দ্যাখ তো, তোর প্রথম ব্রেকআপটা তো তুই নিজের স্বার্থেই করলি, নিলয় ছেলেটাকে তুই দূরে ঠেলে তাসিনের প্রপোজে রাজি হয়ে গেলি! এরপর দ্যাখ, তাসিনেরও তো আরো একটা মেয়েকে ভালো লাগাটা স্বাভাবিক। তোর চেয়ে চোখ ধাঁধানো আরেকটা রূপের আড়ৎ পেয়ে সে কোনো তোয়াক্কা না করে তোকে দূরে ঠেলে চলে গেলো আরেকজনের সঙ্গে। এভাবে দ্যাখ তুই নিজেও তো নাফসের দাসত্ব আর গোলামিই করে গেলি, আর সেও তোর কর্মপন্থায়ই অবলম্বন করলো! অথচ মুখস্থ কিছু বুলি ঝাড়লি আমার কাছে, পুরুষ তান্ত্রিকতা ধর্মান্ধতা ইত্যাদি বলে।

তুই আমাকে জিজ্ঞেস করছিস ক্ষ্যাত মার্কা চলাচল করি ক্যান? লাইফ তো একটা তাকে তাকে এনজয় করলেই তো পারি। হ্যাঁ আসোলেই পারি, আমার জীবন একটা বলেই তো তাকে আল্লাহর পথে চালানের চেষ্টা করছি। বিশ্বাস কর, তুই কথিত আধুনিক স্মার্ট জীবন পদ্ধতিতে চলাচল করে যে সুখ-শান্তি না পেয়েছিস আর পাচ্ছিস তারচে ঢের শান্তি আমি পাচ্ছি!

আমি যখন বোরকা-হিজাব পরে বের হই, সে হিজাবের ভেতর যখন গরমের তাপে গাম ঝরে গড়িয়ে পড়ে, সে ঘামে আমার দেহ যখন ভিজে জুবজুব হয়ে যায় তখন আমার কাছে এই ভেবে স্বর্গ-সুখ মনে আসে যে, আমি আমার রব্বুল আলামীন আল্লাহর আদেশ পালন করে যাচ্ছি, সে আদেশ পালনের মাঝে যতোটুকু কষ্ট অনুভব হয়, যতোটা ঘাম আমার ঝরে তাতে মনে হয় আমার প্রতিটা ঘামের ফোঁটায় ফোঁটায় জাহান্নামের উত্তপ্ত লেলিহান শিখা যেনো নিস্প্রভ হয়ে যায়, নির্বাপিত হয়ে যায়। প্রতিটা ঘামের ফোঁটার সাথে সাথে মনে হয় যেনো আমার থেকে জাহান্নামের উন্মাদ আগুন কয়েক ক্রোশ দূরে চলে যায়! সে-ই যে অনুভূতি, সে অনুভূতির মাঝে যে প্রশান্তি আসে অন্তরে, বিশ্বাস কর তুই সারাজীবন জিন্স টফস পরে, নিজের মনে যা চেয়েছে তা করেও সে প্রশান্তির সামান্য ছোঁয়াও ছুঁতে পারিস নি!

নিপু ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে শিফুর দিকে। ক্যামন একটা ধাক্কা খেলো মনে হয়!

লিমা বলে উঠল, থাক আর কথা বাড়িয়ে তর্ক করে কী লাভ! যার যার বুঝ তার তার কাছে। যার যেমন ভালো লাগে সে তেমনই চলবে। এটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়ে আদৌ কোনো ফায়দা আছে কী!

শিফু বললো তা বটে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা মানুষকে সত্য কোনটা মিথ্যে কোনটা তা যুগে যুগে নবিদের(সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। এখন যার ইচ্ছে সে সত্য আসার পরেও সত্যকে, দ্বীনকে তার বিধানকে এড়িয়ে গিয়ে ভুলটাকে আঁকড়ে ধরলে ধরতে পারে। কিন্তু যে দ্বীনের বিধান মানতে চায়, তাকে কেনো বাঁধা দেয়া হবে? তাকে কেনো কটুকথা বলা হবে? কেনো আঁড়চোখে দেখা হবে, বলতো লিমা?

লিমা মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় শিফুর কথায়! বলে ওঠে -ঠিক রে শিফু, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লাই তো আল-কুরআনে বলেছেন যে, দুনিয়ার জীবনটা তো খেল-তামাশা ছাড়া কিছুই না।[০১] অথচ আমরা এই খেল তামাশার জিন্দেগীতে বিমোহিত হয়ে বিশ্বনিখিলের মালিক আমাদের রব্ব আল্লাহ আজযা ওযাললাকে ভুলতে বসেছি। তাঁর বিধিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে যাচ্ছি, অনবরত! আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে অবজ্ঞা করে আমরা শান্তি খুঁজি এসবের মধ্যেই। অথচ প্রকৃত প্রশান্তি আল্লাহর স্মরণেই নিহিত! [০২]

তদের কথাগুলো এই মুহূর্তে চুপচাপ শুনতে লাগলো নিপু। মনে হয় সে তাদের সংলাপের বিচারক হিসেবে দেখে দেখে জাজ করছে কার কথায় কতোটা সৌন্দর্য আছে কতোটা যুক্তি আছে!

শেষ বিকেলে সূর্যের তেজটা পুরিয়ে এসেছে একেবারে। পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে তেজ হারানো প্রখর সেই সূর্যটা। ঝিরঝিরে হিমেল হাওয়া শরীরে আদর বুলিয়ে দিচ্ছে। পাখিরা নীড়ে ফিরছে। সেই সুন্দর বিমুগ্ধ বিকেলটা উপভোগ করে শিফুরাও ফিরছে নিজেদের নীড়ে। আপন গন্তব্যে....

২. নিপুর কাছে কেমন অস্বস্তি লাগছে। তাসিনকে আজ একটু বেশিই মনে পড়ছে। কী করি নি ছেলেটার জন্য। যা চেয়েছে সবই তো দিয়েছি। তবুও ছেলেটা আমাকে এভাবে ধোঁকা দিতে পারলো!!

আবার নিলয়ের কথা বেশ মনে পড়ছে! ছেলেটা তো আমার জন্য অনেক করেছে। আমার মন পেতে সে সবই করেছে। করতে প্রস্তুত ছিলো, কিন্তু আমি তো ওকে ঠকিয়ে তাসিনের কাছে গেলাম, সেই তাসিন আজ আমাকেই ঠকালে। আবেগের অশ্রু টলটল করে আঁখিদ্বয়ে। চোখের কোণ বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছে বালিশের ওপর। বুকটা ক্যামন চিনচিন করছে। কিচ্ছু ভাললাগছে না আর! আচ্ছা নিলয়ের কাছে গেলে সে কি আমায় আবার গ্রহণ করবে? আমাকে কি সে ফিরিয়ে দিবে? এই তো ক'দিন আগেই তো দেখলাম সে আগাগোড়া হুজুর বনে গেলো! তা হলে তো সে-ও আমাকে আর তার হৃদয়ের কন্দরে ঠাঁই দেবে না! ভাবতেই কষ্টের কষাঘাতে কলজেটা মিসমার হয়ে যাচ্ছে যেনো নিপুর .....

আচ্ছা আজকে লিমা আর শিফু কী যেনো বললো, আল্লাহর স্মরণেই নাকি সকল প্রশান্তি! ভ্যাপসা গরমের মাঝেও কুচকুচে কালো বোরকা গায়ে নিকাব সমেত ঘামিয়ে থাকতেও নাকি শিফুর কাছে ভাললাগে! সে নাকি এভাবেই স্বর্গীয় সুখের আবেশে ভেসে বেড়ায়! আচ্ছা আমার নিজেকে কি তাহলে আমি আল্লাহর কাছে সঁপে দিলে সেরকম সুখ পাওয়া যাবে? আমাকে কী আল্লাহ ফিরিয়ে দেবে? আমাকে কি তিনি কাছে টেনে নিবে না? আচ্ছা তিনি তো বলছে আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো, [০৩] তিনি আমার ডাকেও সাড়া দেবেন? নিপুর গলা ধরে আসে! কিছুই আর ভাবনায় আসছে না.....

ব্যথাভরা সেই ভাঙা বুকে নিপু শোয়া থেকে ওঠে গেলো। অজুর জন্য পানির ট্যাপটা ছেড়ে দিয়েছে।
পানির ছোঁয়ায় যেনো আজকে সকল কষ্ট তার উবে যাওয়ার উপক্রম। মনটা কেমন হালকা হালকা লাগছে। জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত। রুকুসিজদাহ্। সব কিছুই যেনো অন্য রকম লাগছে। মনের কোণে প্রশান্তির হিন্দোল বয়ে যায় যেনো.....

তা হলে কি শিফুও সবসময় এই অনুভূতিই পেয়ে আসছে মনে? এই যে শান্তি সুখের এক পশলা বৃষ্টি নামছে আমার মনে। আমার শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া হৃদয়-বন্দরে, এই বৃষ্টি কি তাহলে শিফুর মনে ও ঝরে সবসময়? সর্বদা? সর্ব অবস্থায়? আসোলেই তো সত্য যে, রব্বের স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়! এই প্রশান্তিই তো এতোদিন শিফু পেয়ে আসছে। তা হলে কেনো আমি নিজেকে এই যে অনাবিল এক প্রশান্তি, সেই প্রশান্তি থেকে বঞ্চিত করলাম নিজেকে, নিজের আত্মাকে?


রেফারেন্স
-----------
[১] আল-কুরআন-২৯/৬৪
[২]আল-কুরআন-১৩/২৮
[৩]আল-কুরআন-৪০/৬০

||প্রশান্তি||
-রেদওয়ান রাওয়াহা
৩১.০৭.২০

পঠিত : ৬০৯ বার

মন্তব্য: ০