Alapon

একটি দুঃস্বপ্ন ফুরাবার অপেক্ষায়...


কবরস্থানের দিকে হাটা দিলাম। আজ পুরো এক বছর হয়ে গেল লুবাবা মারা গেছে। অথচ আমার মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের ঘটনা! মধ্যরাত, আকাশে মস্ত বড় পূর্ণিমার চাঁদ, মৃদু ঠান্ডা বাতাস বইছে, এমন একটা সময়ে আমি কবরস্থানে দাড়িয়ে আছি। অন্য কোনো সময় হলে আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতাম! কিন্তু আজ কেন জানি ভয় করছে না!

লুবাবার সাথে আমার পরিচয়টা নাটক সিনেমার মত বিশেষ কোনো ঘটনা ছিল না। একদিন শুক্রবার বিলে আব্বার সঙ্গে হাটতে বেরিয়েছিলাম। আমি আব্বার সবচেয়ে কাছের বন্ধু! আব্বাও আমার ভালো বন্ধু। তাই বন্ধের দিনগুলো দুই বন্ধু মিলে হাটতে বেরুই আর গুজুর গুজুর করে গল্প করি।

হাটাহাটি আর গুজুর গুজুর গল্প শেষে আমরা যখন বাসায় ফিরছিলাম তখন দেখি, একটা কালো মেয়ে নীল পাড়ের শাড়ি পরে গুটি গুটি পায়ে হেটে যাচ্ছে। কোনো কালো মানুষ এতো সুন্দর হয়, ওই মেয়েকে না দেখলে আমি হয়ত বিশ্বাসই করতাম না। পরে জেনেছি, এই কালো মেয়েটির নামই লুবাবা!

লুবাবা শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে হিজাব পরেছিল, আর ওর হাতে ছিল একগুচ্ছ কাঁচের চুরি। আমি মুগ্ধ হয়ে লুবাবার দিকে তাকিয়ে আছি। আব্বা মৃদু কাশি দিয়ে বলল, ইসলাম নারীকে একবার দেখার কথা বলেছে। একবার দেখেই চোখ নামি নিতে হবে। কিন্তু তুই তো প্রথমবার তাকানোর পর চোখ নামিয়ে নিবি কিরে, তোর অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে, তোর ওই কিম্ভূত দর্শন দিয়ে ওকে বশ করে ফেলবি!

আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে আব্বার দিকে চেয়ে বললাম, বশ করার কোনো ক্ষমতা যদি আমার থাকত, তাহলে অবশ্যই করতাম।
আব্বা বললেন, ওভাবে তাকাবি না! ধ্বংস হয়ে যাবি।
আমি বললাম, ধ্বংসের আর কিছু বাকি নেই। বিবাহ করলে আমি এই মেয়েকেই করব। না হলে চিরকুমার থাকব।
তারপর খোঁজ খবর নিয়ে বাড়ির মুরুব্বিদের দিয়ে লুবাবার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই। কিন্তু প্রস্তাব পাঠানোর সাথে সাথেই ওরা আমার প্রস্তাব নাকচ করে দিল।
এই কথা শুনে আমি কেমন যেন হয়ে গেলাম। সেদিন রাতেই আমি লুবাবাদের বাড়িতে গিয়ে ওর বাবার মুখোমুখি হলাম।
প্রশ্ন করলাম, আমার কোন দোষটার কারণে আপনারা প্রস্তাবটা বাতিল করে দিলেন, দয়া করে একটু বলবেন!
ভদ্রলোক আমার কথা শুনে ভীষণ বিব্রত হলেন। তিনি আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আসলে তোমার কোনো দোষের কারণে আমরা প্রস্তাবটা বাতিল করিনি। সত্যি বলতে লুবাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত। আর সব জেনেশুনে আমরা তো তোমার জীবনটা নষ্ট হতে দিতে পারি না।’

এই কথা শোনা মাত্র আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! এতো সুন্দর একটা মেয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত!

লুবাবার বাবার সামনে ওমন কালবোকা হয়ে কতক্ষণ বসে ছিলাম, ঠিক জানি না। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ক্যান্সারের কারণে কি ডাক্তার ওকে বিয়ে দিতে নিষেধ করেছে?
লুবাবার বাবা বলল, না! এমন কিছু না।

তখন বললাম, তাহলে আপনারা প্রস্তুতি নিন, আমি লুবাবাকে বিয়ে করব। আমার পরিবারকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার। কিন্তু সিদ্ধান্ত ফাইনাল। লুবাবাকে আমিই বিয়ে করব।
তারপর...তারপর বহু ঝামেলার পর আমি সত্যিই সত্যি লুবাবাকে বিয়ে করলাম।

বাসর রাতে নাকি বউকে উপহার দিতে হয়! কিন্তু আমি লুবাবাকে কী উপহার দিবো বুঝতে পারছিলাম না। বাসর ঘরে ঠুকে আমি লুবাবার হাতে একটা বকুল ফুলের মালা তুলে দিলাম! তারপর বললাম, বকুল ফুল আমার ভীষণ পছন্দ। আমি আমার জীবনে কখনো কাউকে বকুল ফুলের মালা উপহার দেইনি। আজ তোমাকে দিলাম।

সে বকুল ফুলের মালাটা গালের সাথে চেপে ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল! আর এই কান্নাটা যে সুখের কান্না তা বুঝতে আমার মোটেও কষ্ট হয়নি।

এরপর আমাদের সুখের সংসার শুরু হল। অবশ্য সুখ বেশি দিন স্থায়ী হল না। সংসারের মাত্র ১ বছর ৩ মাস ১৩ দিনের মাথায় লুবাবা পরপারে পাড়ি জমাল। যদিও আমি জানতাম, লুবাবা যেকোনো দিন মারা যেতে পারে, আর নিজেকে সেভাবে প্রস্তুতও রেখেছিলাম। কিন্তু ও মারা যাওয়ার সাথে সাথে আমার পুরো পৃথিবী যেন অন্ধকার হয়ে গেল। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। সব কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছিল! শুরু বার বার মনে হচ্ছিল, আমি হয়ত দুঃস্বপ্ন দেখছি। ঘুম ভেঙ্গে গেলেই আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই আর ঠিক হয়নি...

পঠিত : ৪৫১ বার

মন্তব্য: ০