Alapon

ভাষা আন্দোলন ও এর ঘটনা প্রবাহ


ছবি : ভাষা আন্দোলনের সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলা বিরোধীদের পোস্টার। সূত্র : ডেইলি স্টার

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশ তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ তখন একটি প্রদেশ হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা যে হিন্দি হবে, সে সিদ্ধান্ত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আগেই ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে আলোচনা চলাকালে এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। এর মধ্যেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়ে যায়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরুতে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। এর প্রতিবাদ করেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তদানীন্তন পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগই ছিল পূর্ববঙ্গের অধিবাসী এবং তাদের মাতৃভাষা বাংলা। এটাই ছিল ড. শহীদুল্লাহর একমাত্র যুক্তি।

অন্যপক্ষে অবিভক্ত উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হিন্দুদের হিন্দি-প্রীতির বিপরীতে মুসলমানদের উর্দুর প্রতি একটা সহজাত দুর্বলতা ছিল। তা ছাড়া উপমহাদেশীয় মুসলমানদের প্রাচীনপন্থি ও আধুনিকপন্থি উভয় ধরনের শীর্ষ শিক্ষাকেন্দ্র যথাক্রমে দেওবন্দ ও আলীগড় উর্দু অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় উর্দুর প্রতি প্রাচীন ও আধুনিক উভয়পন্থী উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে একটা সমীহ বোধ ছিল। উর্দু ছিল সকল মুসলিমের কাছে বোধগম্য একমাত্র ভাষা। যদিও পাকিস্তানে বাঙালি বেশি তবে বাঙালি ছাড়া আর কেউ বাংলা ভাষায় অভ্যস্ত ছিল না। সুতরাং উর্দু রাষ্ট্রভাষা না হলে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী সমস্যায় পড়ে যাবে।

শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বহু অভিজাত ও শিক্ষিত মুসলমান পরিবারে উর্দুতে কথাবার্তা বলা একটা আভিজাত্যের পরিচায়ক বলে মনে করা হতো। অন্যদিকে ঢাকা মহানগরীর আদি অধিবাসীদের মধ্যে উর্দু-বাংলা মিশ্রিত এক ভাষা বহুল প্রচলিত থাকায় তারাও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনকে সুনজরে দেখেননি বরং মুশরিকদের ষড়যন্ত্র হিসেবেই গণ্য করেছে। এসব কারণে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন মোটেই গণদাবি বা জনপ্রিয় আন্দোলন ছিল না। ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা পরে হলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগ থেকেই এ নিয়ে আলোচনা, বাদ-প্রতিবাদ, লেখালেখি শুরু হয়। এসব বাদ-প্রতিবাদ ও লেখালেখিতে বাংলার পক্ষে অংশগ্রহণ করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রাবন্ধিক আবদুল হক, কবি ফররুখ আহমদ প্রমুখ।

উর্দু কারো মাতৃভাষা ছিল না। এটি একটি লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা। লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা মানে হল আন্তঃযোগাযোগীয় ভাষা। যেটি কয়েকটি ভাষার সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের (যেমন সিলেট, নোয়াখালী, বরিশাল, রংপুর ও চট্টগ্রাম) মানুষ যখন একটা অফিসে বাংলা একাডেমীর ঠিক করে দেয়া কলকাতার সাথে মিল রেখে তৈরি করা 'প্রমিত' বাংলায় কথা বলে, তখন কিন্তু সেখানে এক প্রকার লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কাই ব্যবহার করে। এখানেও মাতৃভাষার উপরে একটা লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা চাপানো হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় সংহতির জন্য এটাই জরুরি।

হিন্দি নামটি ফার্সি থেকে এসেছে। পারস্যের অধিবাসীরা ভারতীয় লোক ও তাদের ভাষাকে হিন্দি নামে ডাকতো। ইতিহাসবিদেরা তাই মনে করেন। ৮ম-১০ম শতকের দিকে ভারতে মুসলিম আক্রমণের সময় উত্তর ভারতের খাড়ি বোলি কথ্য ভাষা থেকে হিন্দির উৎপত্তি ঘটে। খাড়ি বোলি ছিল দিল্লি এলাকার ভাষা, এবং বহিরাগত মুসলিম শাসকেরা সাধারণ জনগণের সাথে যোগাযোগের জন্য এই ভাষাই ব্যবহার করতেন। এই খাড়ি বোলি ভাষার একটি রূপ ধীরে ধীরে ফার্সি ও আরবি ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ ধার করলে উর্দু নামের এক সাহিত্যিক ভাষার উদ্ভব ঘটে।

উর্দু শব্দটি তুর্কি "ওর্দু" শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ "শিবির" বা "ক্যাম্প"। অন্যদিকে সাধারণ জনগণের মুখের ভাষায় আরবি-ফার্সির তেমন প্রভাব পড়েনি, বরং তারা সংস্কৃত ভাষা থেকে শব্দ ও সাহিত্যিক রীতি ধার করতে শুরু করে এবং এভাবে হিন্দি ভাষার জন্ম হয়। সেই হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে উপমহাদেশের মুসলিমরা উর্দু আর অন্যরা হিন্দি ভাষায় কথা বলতো। পাকিস্তানের সেসময় সংখ্যাগরিষ্ঠ মাতৃভাষাগুলো ছিল বাংলা, পাঞ্জাবী, বেলুচ, সিন্ধি, পশতু ইত্যাদি। এর মধ্যে উর্দুই ছিল বোধগম্যতার দিক দিয়ে কমন যা হিন্দীর অনুরূপ। তাই এই ভাষাই মুসলিমদের ভাষা হয়ে ওঠে।

মুসলিম লীগের তথা পাকিস্তানের তৎকালীন নেতারা তাদের প্রদেশগুলোর মধ্যে কমন ভাষা চালু করার জন্যই উর্দুকে সিলেক্ট করেছে। আর বিষয়টা এমন ছিল না যে উর্দু অপ্রত্যাশিতভাবেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। প্রত্যেক জাতি তাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা থেকে বঞ্চিত করেছে সংহতি রক্ষার জন্য। শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ভিন্ন দাবি করেছে আমাদের কিছু বাঙালি ছাত্র। বাংলার সব মানুষ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিল এটাও সঠিক নয়। ঢাকায় সেসময় প্রচুর ছাত্র উর্দুর পক্ষেও ভূমিকা রেখেছিলো। বাংলার কোন রাজনৈতিক নেতা বায়ান্নোর আগ পর্যন্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন না। ঢাকা ভার্সিটি ও জগন্নাথ কলেজের (তখন কলেজ ছিল) কিছু ছাত্র ছাড়া এই আন্দোলন অন্য কেউ করেনি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী সর্বপ্রথম অফিসিয়ালি উত্থাপন করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তৎকালীন সকল বাঙ্গালী সংসদ সদস্যরা ওনার বক্তব্যকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃএব এটা বাংলার গণমানুষের দাবী এটা বলা অযৌক্তিক।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার সুপরিকল্পিত উদ্যোগ সর্বপ্রথম গ্রহণ করে তমুদ্দুনে মজলিশ ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বরে। তমুদ্দুনের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় ভাষা আন্দোলনের মেনিফেস্টোরূপী ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ নামের একটি ছোট বই। এই বইয়ে স্থান পায় বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবদুল মনসুর আহমদ এবং তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের তরুণ লেকচারার অধ্যাপক আবুল কাসেমের তিনটি নিবন্ধ।

তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ওই পুস্তিকার প্রথম নিবন্ধই ছিল অধ্যাপক আবুল কাসেমের। তমুদ্দুনের পক্ষ থেকে তার লিখিত “আমাদের প্রস্তাব” শীর্ষক নিবন্ধে ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি উত্থাপিত হয় দুইটি।
১. বাংলা ভাষাই হবে -
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন
(খ) পূর্ব পাকিস্তানে আদালতের ভাষা
(গ) পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা।

২. পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি :
উর্দু ও বাংলা।
সমগ্র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এই মূল দাবিতেই পরিচালিত হয়। অধ্যাপক আবুল কাসেম তার নিবন্ধে এক পর্যায়ে বলেন, "গণপরিষদের প্রত্যেক সদস্যের কাছে ডেপুটেশন নিয়ে তারা যেন বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে মত দিয়ে বাঙালির আত্মহত্যার পথ সুগম না করেন, তা স্পষ্ট বুঝাতে হবে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে সে সম্বন্ধে মুসলিম লীগ কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করায় বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যায়। এ পরিস্থিতির সুযোগ নেন নতুন রাষ্ট্রের প্রশাসনের উচ্চ স্তরের কর্মকর্তারা।"

পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র চূড়ান্ত না হওয়ায় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে মুসলিম লীগ কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত না নেয়া সত্ত্বেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টা শুরু করে দেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায়, নতুন রাষ্ট্রের পোস্টকার্ড, এনভেলপ, মানি অর্ডার ফরম প্রভৃতিতে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দুর ব্যবহার থেকে। এই প্রেক্ষাপটে নবগঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিস বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে দেয়। এ দাবিকে শিক্ষিত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ব্যক্তিগত যোগাযোগের পাশাপাশি আলোচনা সভা অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য কার্যক্রম শুরু করে দেন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল কাসেম।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার অধ্যাপক নূরুল হক ভুইয়াকে আহ্বায়ক করে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। হাবিবুল্লাহ বাহারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক আবুল কাসেম, কবি জসীমউদ্দিন, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ। ১৯৪৭ সালের ১৭ নভেম্বর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মওলানা আকরম খাঁসহ কয়েকশ চিন্তাবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনীতিক ও ছাত্রনেতাদের স্বাক্ষরসহ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হয়।

এর বিপরীতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধী আন্দোলনও তখন জমে উঠে। এই প্রসঙ্গে আবুল কাসেম বলেন, "এদিকে উর্দু সমর্থক আন্দোলন গড়ে উঠে। স্বনামখ্যাত মৌলানা দ্বীন মোহাম্মদ সাহেব প্রমুখকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহল্লায় ও মফস্বলের বহুস্থানে উর্দুকে সমর্থন করে বহু সভা করা হয়। এরা কয়েক লাখ দস্তখত যোগাড় করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এক মেমোরেণ্ডাম পেশ করেন। পথেঘাটে ইস্টিমারে এ স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজ চলে। স্বাক্ষর সংগ্রহের পর কয়েকজন নামকরা ব্যক্তি করাচীতে গিয়ে সরকারের কাছে পেশ করে আসেন।"

যারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে ছিলেন তারা কেউ কিন্তু অবাঙালি ছিলেন না। তাদের যুক্তি হলো পূর্ব পাকিস্তানে যদি বাংলাকে অফিসিয়াল ভাষা করা হয় তবে অন্যান্য অঞ্চল যেমন পাঞ্জাব, সিন্ধ, বেলুচ, কাশ্মীরে তাদের নিজস্ব ভাষা চালু হবে। এক্ষেত্রে বাঙালিদের সেসব অঞ্চলে কাজ করা ও শিক্ষাগ্রহণ করা কঠিন হবে। অন্যদিকে বাংলায় অন্যান্য জাতি গোষ্ঠির পাকিস্তানীরা আসবে না। ফলে দীর্ঘদিনের ইংরেজ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শোষণের ফলে পিছিয়ে থাকা বাংলা আরো পিছিয়ে যাবে। সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় সংহতি বিনষ্ট হবে।

১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচিতে একটি শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের সাধারণ ভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। এ সময় পাকিস্তান সেন্ট্রাল পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক ১৫ ডিসেম্বর এক সার্কুলারে বাংলাকে বাদ দিয়ে ইংরেজি ও উর্দুকে পরীক্ষার বিষয়ভুক্ত করায় তার বিরুদ্ধে অধ্যাপক আবুল কাসেম এক বিবৃতি দেন। আবুল কাসেম এমনভাবে বিবৃতি দেন যেন পাকিস্তানে বাঙালি বাদে আর কোনো জাতি গোষ্ঠী নেই। তার এই অনুচিত বিবৃতি ছাপে নি কোনো পত্রিকা।

আবুল কাসেম এই বিবৃতি ৩১ ডিসেম্বর ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদে ছাপার ব্যবস্থা করেন। কলকাতার ঐ পত্রিকা এ বিষয়ে পাকিস্তানের কড়া সমালোচনা করে ও বাঙালি নির্যাতনের অভিযোগ এনে “অবিশ্বাস্য” শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। ওই পত্রিকায় কপি ঢাকায় নিয়ে এসে প্রচারণা চালায় তমুদ্দুনে মজলিসের কর্মীরা। এই ঘটনা ঢাকাবাসীর মনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। তাদের আগের ধারণা সত্য হয়েছে বলে তারা মনে করেন। নতুন একটি ইসলামী ভাবধারার রাষ্ট্রে ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্যই মুশরিকরা কিছু ছাত্রদের লেলিয়ে দিয়েছে। এরকমটাই ভাবতে থাকেন ঢাকাবাসী। তারা তমুদ্দুনের বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করেন।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত এবং শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। তারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। একমাত্র চারজন হিন্দু ছাড়া আর কোনো পূর্ব পাকিস্তানের গণপরিষদ সদস্য এই প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নেননি। ফরিদপুরের নেতা তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে গণপরিষদের সকল বাঙালি নেতা একযোগে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। ঢাকার নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন যে, “পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ চায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু হোক, আমরা সবাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতি চাই।” পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এ প্রস্তাবটিকে পাকিস্তানে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা বলে উল্লেখ করেন। উর্দুকে লক্ষ কোটি মুসলমানের ভাষা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেবলমাত্র উর্দুই হতে পারে”। গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথের সংশোধনী প্রস্তাব ভোটে বাতিল হয়ে যায়।

গণপরিষদে বাংলার রাষ্ট্রভাষা প্রস্তাব বাতিল হওয়ার প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি সাবেক বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের সোহরাওয়ার্দী-হাশিম সমর্থক অংশ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ সংগঠন ভাষা আন্দোলনের সমর্থক হওয়ায় পুনর্গঠিত সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর নির্বাচিত হন যুগপৎ মজলিস ও ছাত্রলীগের সদস্য তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শামসুল আলম। তবে বাংলার একজন রাজনৈতিক নেতারও প্রত্যক্ষ সমর্থন না পাওয়াও ভাষা আন্দোলন গণভিত্তি তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। যাই হোক রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ও মিটিং-মিছিলের মাধ্যমে ১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।

১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনকারীরা খুবই সহিংস হয়ে ওঠে। তারা সচিবালয়ে ঢুকে সরকারি কর্মকর্তাদের হেনস্তা করতে থাকে। এর প্রতিরোধে মুসলিম লীগের নেতা কর্মীরা রাস্তায় নামে। ফলে পালিয়ে যায় ভাষা আন্দোলনকারীরা। মুসলিম লীগের নেতা কর্মীরা ঢাকা মেডিকেল ও ঢাবির হলে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করে। পুলিশ দুই পক্ষের লোকদেরই ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে তৎকালীন প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিগুলো ছিল-
১- ভাষার প্রশ্নে গ্রেপ্তার করা সবাইকে মুক্তি প্রদান করা হবে।
২- পুলিশি অত্যাচারের বিষয়ে তদন্ত করে একটি বিবৃতি প্রদান করা হবে।
৩- বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে।
৪- সংবাদপত্রের উপর হতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে।
৫- আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না।
৬- ২৯ ফেব্রুয়ারি হতে জারিকৃত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করতে হবে।
৭- পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজি উঠে যাবার পর বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে প্রবর্তন করা হবে।
৮- রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন " রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই" এই মর্মে প্রধানমন্ত্রী ভুল স্বীকার করে বক্তব্য দিবেন।

পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষণা দেন "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা"। এতে ভাষা আন্দোলনকারীরা ক্ষেপে যায় এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উদ্যোগ নেয়। এরপর ২৪ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তার উক্তির প্রতিবাদ জানায়। জিন্নাহ তাদের সাথে কথা বলতে আগ্রহী হন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল জিন্নাহ্‌'র সাথে সাক্ষাৎ করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়।
প্রতিনিধি দলে ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম এবং নজরুল ইসলাম। বৈঠকে জিন্নাহ একক রাষ্ট্রভাষার গুরুত্ব তুলে ধরেন, পাকিস্তান নিয়ে তার চিন্তা ও পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন।

জিন্নাহ তাদের বুঝাতে সক্ষম হন কেন উর্দু জরুরি এবং এতেই কল্যাণ রয়েছে বাঙালিদের। প্রতিটা প্রদেশে আলাদা ভাষা থাকলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাঙ্গালিরাই। জিন্নাহ ছাত্রদের বুঝিয়ে ভাষা আন্দোলন থেকে সরে আসার অনুরোধ করেন। ভাষা আন্দোলনের নেতারা জিন্নাহর যুক্তির কাছে হার মানে এবং আন্দোলন থেকে সরে আসার মৌখিক স্বীকৃতি দেয়। অবশ্য জিন্নাহ তাদের কাছ থেকে লিখিত কোনো ডকুমেন্টস চাননি। তিনি আন্তরিকভাবে বুঝিয়ে ছাত্রদের ভুল আন্দোলন থেকে ফিরতে বলেছেন। ঢাকা ত্যাগের সময় তিনি খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে করা চুক্তির আর প্রয়োজনীয়তা নেই বলে উল্লেখ করেন একইসাথে উর্দুর ব্যাপারে আবারো তার মতামত ব্যক্ত করেন। আন্দোলন নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে তমুদ্দুন মজলিস।
দ্বিধান্বিত নেতৃত্ব থেকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব কেড়ে নেয় বামাদর্শের ছাত্রনেতা কমরেড তোয়াহা এবং এই আন্দোলনকে বামদের আন্দোলনে পরিণত করেন। নেতৃত্ব হারানোর পর পরবর্তীতে তমুদ্দন মজলিস আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার জন্য কমিউনিস্টদের দায়ী করে একটি বিবৃতি প্রদান করে এবং পরে তারা আস্তে আস্তে আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসে।
১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তিনি ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। সেই মিটিং-এ ডাকসুর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে মানপত্র পাঠ করা হয়। সেই মানপত্র পাঠ করেন ডাকসুর জিএস গোলাম আযম। মানপত্রে তিনি বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করেন। তবে লিয়াকত আলী খান এই ব্যাপারে কোনোরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। ১৭ নভেম্বর আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভায় একটি স্মারকলিপি প্রণয়ন করা হয় এবং সেটি ২৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রেও কোনো সাড়া দেননি।

যদিও ভাষা আন্দোলন করেছে অল্প কিছু ছাত্র এবং এটি মোটেই গণভিত্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়নি তথাপি পাঞ্জাবের নেতা লিয়াকত আলী খান এটিকে একেবারে উড়িয়ে দেননি। তিনি মনে করেছেন যেহেতু এই ভাষায়ই পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলে এটা একসময় বড় আকার ধারণ করতে পারে। তাই তিনি এর কিছুদিন পর, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে ভাষা সমস্যার ব্যাপারে একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন। এই জন্য বাংলা সমর্থক মাওলানা আকরম খাঁনের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করেন লিয়াকত আলী খান। ভাষা কমিটিকেও এই বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলেন। ১৯৫০ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে কমিটি তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে ও সমাধানে কিছু প্রস্তাবনা তৈরি করে। ধীরে ধীরে ভাষা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।

১৯৫২ সালে ঢাকার নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী। তিনি ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন। সেই ভাষণে পাকিস্তানের মূল সমস্যা সংবিধান নিয়ে কথা বলেন। সেখানে পাকিস্তানের অফিসিয়াল ভাষা ইংরজি পরিবর্তন করে উর্দু করার কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, 'কোনো জাতি দু'টি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনি। প্রদেশের সরকারি কাজকর্মে কোন ভাষা ব্যবহৃত হবে তা প্রদেশের জনগণই ঠিক করবে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে কেবল উর্দু'। এতে আবারো বামপন্থী ছাত্ররা নতুন করে সংগঠিত হয়। নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। পরদিন ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়। নতুন কর্মপরিষদ ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।

এবার আন্দোলন চাঙ্গা হয় কারণ এবার মুসলিম ভেঙে গঠিত হওয়া আওয়ামীলীগের একাংশের সাপোর্ট পায় ভাষা আন্দোলন। ভাসানীর সাপোর্টের মূল কারণ হলো নাজিমুদ্দিনের বিরোধীতা। সেসময় মুসলিম লীগের বিরোধীতা করাই ছিল আওয়ামীলীগের অন্যতম কাজ। যাই হোক ৪ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিল করে ভাষা আন্দোলনকারীরা এবং প্রচুর ভায়োলেন্স করে। জ্বালাও পোড়াও শুরু করে। এর অন্যতম কারণ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।

৪ ফেব্রুয়ারির সহিংসতার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি পূর্ব-পাকিস্তান সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরিষদের কিছু সদস্য নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার পক্ষে থাকলেও, সবশেষে ১১-৩ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু বাম ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার ব্যাপারে আলাদা সিদ্ধান্ত নেয় এবং সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বার্তা পাঠিয়ে দেয়।

সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসে জড়ো হয়। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকে এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সমাবেশ চালাতে থাকে। পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিক ঘিরে রাখে। পুলিশের নমনীয় অবস্থান দেখে ছাত্রলীগ তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সমাবেশে যোগ দেয়। বিভিন্ন অনুষদের ডীন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঐসময় উপস্থিত ছিলেন। ছাত্রলীগ যোগ দিলে সমাবেশের আকার অনেক বড় হয়ে যায়। তাই এগারটার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রশাসনের প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়। অনেক ছাত্র ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে গেলেও বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। উপাচার্য তখন পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে অনুরোধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেন। পুলিশ পিছিয়ে আসে।

পুলিশ পিছিয়ে গেলে ছাত্ররা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। এ সময় কয়েকজনকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার শুরু করলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এবার পুলিশ অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে এবং তেজগাঁও নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়। বেলা ২টার দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ভাষা আন্দোলনকারীরা তাদের বাধা দেয়। অনেককে হেনস্তা করে। পুলিশ লাঠিচার্জ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু পরিস্থিতির ভয়ানক পরিবর্তন ঘটে যখন ছাত্ররা দলবল নিয়ে আইনসভার দখল নিতে যায়। আইনসভার ওপর তারা ক্ষ্যাপা কারণ আইনসভার সদস্যরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে পছন্দ করেনি। ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়া শুরু করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। এ সময় ছাত্রছাত্রীদের আক্রমণে লুটিয়ে পড়ে গণপরিষদের পিয়ন আব্দুস সালাম। যাকে এখন ভাষা শহীদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সামলাতে ব্যর্থ হয়ে আইনসভার সদস্য নিরাপত্তায় গণপরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসররত মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিবর্ষণে আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এছাড়া আবুল বরকত ও ওহিউল্লাহ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। পরেরদিন আবারো হত্যার প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলনকারীরা মিছিল বের করে। এখানেও পুলিশ গুলি করে। এতে শফিউর রহমানসহ কয়েকজন নিহত হন।

ঐসময় গণপরিষদে অধিবেশন শুরুর প্রস্তুতি চলছিল। পুলিশের গুলির খবর জানতে পেরে আওয়ামী লীগের মাওলানা তর্কবাগিশসহ বিরোধী দলীয় বেশ কয়েকজন অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন। যদিও মাওলানা তর্কবাগিশ বাংলা রাষ্ট্রভাষা হওয়ার বিপক্ষে ছিলেন তারপরও তিনি পুলিশের গুলির প্রতিবাদ করেন। পরবর্তীতে মুসলিম লীগ সরকার আর ভাষা আন্দোলনকারীদের কোনো সভা সমাবেশ বা কোনো কার্যক্রমের সুযোগ দেয়নি।

১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া এক সভায় সিদ্ধান্ত নেন বাংলা ভাষাকে উর্দু ভাষার সমমর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা করে হবে। এ সিদ্ধান্তের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের ছয়টি ভাষাকে একই মর্যাদা দেয়ার দাবি তোলে সেখানকার প্রতিনিধিত্বকারীরা। পশ্চিম পাকিস্তানের আরেক মুসলিম লীগ নেতা আবদুল হক এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান এবং তার এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অনড় থাকেন। তার নেতৃত্বে ২২ এপ্রিল করাচিতে এক বিশাল প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করা হয়। প্রায় ১ লক্ষ মানুষ মিছিলে অংশ নেয় ও মুসলিম লীগের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। সেখানে সহিংস ঘটনায় সিন্ধি ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক আল ওয়াহিদ পত্রিকার অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে ২৭ এপ্রিল বাংলা ও অন্যান্য ভাষাকে সমমর্যাদা দেওয়ার দাবিতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এমন জটিল ও সহিংস পরিস্থিতিতে মোহাম্মদ আলী বগুড়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ বন্ধ করেন। ১৯৫৪ সালে গণপরিষদ নির্বাচনে শেরে বাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট অধিকাংশ আসনে জয়লাভ করে।

যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক ক্ষমতায় এসে বাংলা একাডেমী গঠন করে। এ প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, গবেষণা এবং মান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করবে বলে গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করা হয়। যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মালিক গোলাম মাহমুদ ১৯৫৪ সালের ৩০ মে তারিখে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকার বাতিল ঘোষণা করে। ১৯৫৫ সালের ৬ জুন তারিখে যুক্তফ্রন্ট পুণর্গঠন করা হয়; যদিও আওয়ামী লীগ সে মন্ত্রীপরিষদে যোগ দেয়নি।

১৯৫৬ সালে প্রথমবারের মতো সরকারের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। শহীদ মিনার নতুনভাবে তৈরি করার লক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে পাকিস্তানের গণপরিষদে কার্যক্রম পাঁচ মিনিট বন্ধ রাখা হয়। সারাদেশব্যাপী পালিত হয় শহীদ দিবস এবং বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ। আরমানীটোলায় এক বিশাল সমাবেশের নেতৃত্ব দেন মাওলানা ভাসানী। ১৯৫৬ সালে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর পদত্যাগের পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। তার প্রত্যক্ষ প্রভাবে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। পাস হওয়া শাসনতন্ত্র নানান ইস্যুতে বিতর্কের জন্ম দেয়। তার প্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে ভাঙন হয়। সোহরাওয়ার্দি পদত্যাগ করেন। তার বছরখানেক পর সেনাবাহিনী শাসন ক্ষমতা দখল করে। সেনাপ্রধান আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হন এবং সংবিধান স্থগিত করেন।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে বড় ঘটনা ঘটায় এই নিয়ে আর কেউ নতুন করে বিতর্ক করে নি। ১৯৫৯ সালের ৬ জানুয়ারি আইয়ুব খান এক সরকারি বিবৃতি জারি করেন এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানে উল্লেখিত দুই রাষ্ট্র ভাষার উপর সরকারি অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। এভাবেই বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্থায়ী হয়।

পঠিত : ১৩০৩ বার

মন্তব্য: ০