Alapon

শরাব মানুষের ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্য নষ্ট করে...



এথেন্সে আমার একজন কলিগ, মাতাল অবস্থায় ভাল ও কল্যাণের কথা বলত। যখন সে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকত, তখন প্রতি চার বাক্যে একবার গালি দিত। অর্থাৎ সারা জীবনে যত কথা বলে তার পাঁচ ভাগের একভাগ মন্দ-কথা। একই কোম্পানির ভিন্ন ডিপার্টমেন্টের একমাত্র বাংলাদেশী ভাইকে পেয়ে খুবই পুলকিত হয়েছিলাম। পরে বুঝলাম আহা! এর সাথে যদি কোনদিনই আমার পরিচয় না হত, তবে কতই না ভাল হত!

সর্বদা গালি দেবার মত ঘটনা পাওয়া যাবে এমন তো নয়। তবে সারাক্ষণ সে যেভাবে নিজের মাতৃভূমি বাংলাদেশকে গালি দিত, তা আমি ইহজন্মে কাউকে দেখিনি! বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল, প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যক্তিই তার গালির বাহিরে থাকত না। তা না হলে পুরো জনগণকে গালি দিত। তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মত খারাপ একটি দেশ পৃথিবীতে নেই। ভাগ্য ভাল যে, হাল আমলের বাংলাদেশের সময় আমার সাথে তার দেখা হয়নি।

খৃষ্টমাস উপলক্ষে এক সন্ধ্যায় হোটেলে আয়োজিত, কোম্পানির প্রোগ্রামে যেতেই হল। সেই সন্ধ্যায় আরেকজন বাঙ্গালীর দেখা পেলাম। তার কথা শুনেছি কিন্তু দেখিনি। তিনি কোম্পানির মালিকের ব্যক্তিগত সহকারী। মালিক বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন এবং এই বাঙ্গালী ভাইকে খুবই বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য মনে করে। তাই মালিকের সাথে অফিসিয়াল ও ব্যক্তিগত কাজে তার সাথে সারা পৃথিবীর দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। ওর সাথে আরো কথা বলার জন্য, পোডিয়ামের বাহিরে, খোলা জায়গায় হাওয়া খেতে গেলাম। সেখানেই আমাদের সেই গালিবাজ দেশীয়কে দেখতে পেলাম। তাকে আজ সুন্দর ভাষায় কথা বলতে দেখলাম! কিছু ধর্মীয় কথাও বলল। পৃথিবীর আয়ু যে আর আর বেশীদিন নেই সেটা বারে বারে মনে করিয়ে দিল।

আমি ভাবলাম, খৃষ্টমাসের দিনে তার অন্তরে কোন পরিবর্তন এলো কিনা? যে ব্যক্তি নামাজ-রোজার কিছুর ধার ধারে না, সে আজ ধর্মের কথা বলা শুরু করেছে। নতুন আগন্তুক যার সাথে কিছুক্ষণ আগে পরিচয় হয়েছিল, তিনি বললেন, সে আমার বাল্যবন্ধু। আমিই তাকে এই কোম্পানিতে চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু মানুষটি দিনে দিনে বদমাইশির সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে।

বন্ধুকে সামনে রেখে, তার সম্পর্কে এমন চড়া মন্তব্যে আমাকে হতবাক করল। তাঁকে ইঙ্গিত দিয়ে বললাম আপনার এই মন্তব্যে বন্ধু মনক্ষুন্ন হতে পারে!
তিনি সহাস্যে বললেন, আপনি মনে হয় এ দেশের সংস্কৃতির সাথে এখনও ভাল করে পরিচিত হয়ে উঠেন নি। তার সামনে এর চেয়ে জঘন্য কথা বললেও, সে কিছুই বুঝবে না।
এতক্ষণ তার একটি হাত পিছনে ছিল। ঠিক তখনই মদের বিরাট বোতলটি প্রকাশ্যে এনে উঁচিয়ে দেখলেন তলানিতে সামান্য মদ তখনও অবশিষ্ট আছে। ঠোটে লাগানোর আগে বলল, "হায় দুনিয়া, তোমার বয়স বুঝি শেষ হয়ে গেল!"

ইতি-পূর্বেকার কথায় বুঝতে পারিনি যে, সে মদ পান করেছিল। কথাবার্তায় তেমন অসারতা ছিলনা। ব্যতিক্রমের মধ্যে শুধু আজ তার মুখে ভাল কথা শোনা গিয়েছে।
ততক্ষণে হলের মধ্যে নৃত্য আর সঙ্গীতের দামামা সৃষ্টি হয়েছে। সবাই মদপানে মত্ত। কোম্পানির তরুণী সুন্দরী সেক্রেটারির সাথে, ভারতীয় যুবকদের যারা একটি ছবি তোলার জন্য মুখিয়ে থাকত। আজ তিনি মদ পানে মাতাল চরম বে-সামাল। ক্ষণে ক্ষণে পরিবেশের পরিবর্তন হতে থাকে। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না, এরা কি আমার অফিসের সেই সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। যারা গুরুগম্ভীর গলায়, অফিসারদের কাজ বুঝিয়ে দেন, ভুল হলে ভৎসনা করেন। যুবকেরা হিরো সাজতে যে সুন্দরী তরুণীকে অনুরোধ করে ছবি তুলত, সেই সুন্দরী মাতাল হয়ে একবার টেবিলে আরেকবার ফ্লোরে শুয়ে পড়ছেন।

মূলত মদ পানে মানুষের ব্যক্তিত্ব নষ্ট হয়ে যায়। সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌছতে মানুষকে বহু প্রচেষ্টা করতে হয় কিন্তু মদ পানের মাধ্যমে সেই অর্জন নষ্ট হয়ে যায়। ড্রাইভার আর সাহেব দুই জনের আভিজাত্যের তফাত থাকে বিস্তর। আভিজাত্য অর্জন করতে হয়, টাকা ঢাললেই আভিজাত্য সৃষ্টি হয়না। একদা আরেকটি অনুষ্ঠানে, সেকশনের বস আর অফিস বয় একসাথে মদপান করেছিল। কিভাবে তারা দুজন একই হলে মিলিত হয়ে যায়। সেখানে অফিস বয় চেয়ারে বসে বসকে যেন, কি কাজর নির্দেশ দিচ্ছিল। বস সেটা মানার ওয়াদা করছিল।

আমরা হয়ত, গরীব মানুষদের মাতাল হয়ে রাস্তার পার্শ্বে পড়ে থাকতে দেখি। কিন্তু শিক্ষিত মানুষেরা মদ পান করে, কত নোংরা, কদর্য হতে পারে তা না দেখলে বুঝা যাবে না। এসব মানুষের ব্যক্তি জীবনে ভাল কাজের প্রভাব পড়েনা। সৎ হবার কথা শুনলে, তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তাদের অন্তরে এই বিশ্বাস দৃঢ়তা ধারণ করে যে, দুনিয়াতে সৎ মানুষ বলতে কেউ নেই। মদপানে মানুষের মুখস্থ শক্তি কমে যায়। চিন্তাশক্তি লোপ পায়। হৃদয়ে ভাবাবেগের সৃষ্টি হয় না, অনুভূতি নষ্ট করে। বর্তমানে মদ পান ও মাদক গ্রহণ সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সময়টির কথা রাসুল (সা) তার হাদিসে উল্লেখ করেছেন এভাবে,
"কেয়ামতের আলামতের একটি হল, ১. বিদ্যা উঠে যাবে ২. মূর্খতা বেড়ে যাবে ৩. ব্যভিচারের বিস্তার ঘটবে ৩. মদপানের প্রসার ঘটবে ৪. পুরুষের সংখ্যা কমে যাবে ৫. নারীর সংখ্যা বেড়ে যাবে।" মিশকাত-৫২০৩

- টিপু

পঠিত : ৫২৫ বার

মন্তব্য: ০