Alapon

দুর্নীতি, ধর্ষণ, ফেসবুক প্রতিক্রিয়া ও আমরা...


১.
ছোট মামা একটা মজার ঘটনা বলেছিলেন।
মামা তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। রাতের বাসে ঢাকা ছেড়েছেন।
গ্রীন লাইনের বিলাস বহুল বাস। যাত্রীরাও সবাই অভিজাত, সচ্ছল।
বাস কিছুদূর এগোতেই বোঝা গেল, তাদের কেউ কেউ পরকীয়ায় লিপ্ত। ফোনে লম্বা সময় ধরে আদুরে ভঙ্গিতে কথা বলছেন। যে স্বরে চলন্ত বাসে কেউ তার আপন বউয়ের সাথে কথা বলে না।

আবার অনেকে ফোনে নানা অনৈতিক ব্যবসা, ঘুষ, লেনদেনের হিসাব কষছেন।
মামা রাতের জার্নিতে সাধারণত ঘুমিয়েই কাটান। কিন্তু আশেপাশের লোকদের উচ্চস্বরের ফোনালাপে দু চোখ বন্ধ করাই দায়।

বাস কুমিল্লার কাছাকাছি আসতেই সহযাত্রীরা নিজেদের মধ্যে খোশগল্প জুড়ে দিলেন। গল্পের বিষয়বস্তু হল, দেশটা নানা অন্যায় অনিয়ম দুর্নীতিতে ভরে গেছে। এই দেশের মানুষের মত এত খারাপ মানুষ আর ইহ-ভুবনে নেই।

ত্যক্ত বিরক্ত মামা আর থাকতে না পেরে বলে ফেললেন “ আমরা আপনারা তো সবাই সাধু সন্ন্যাসী! তাহলে দেশে যে এত অনিয়ম, পাপাচার যে হয়...এসব করেটা কে?”
সহযাত্রী কয়েকজন তেড়ে এলেন “আপনি কি বলতে চান? আমরা খারাপ লোক? আপনি নিজে কি? খুব ভাল?”

ক্লান্ত মামা দু হাত জড় করে বললেন “আমি কিছু বলতে চাই না। আমি শুধু একটু আরাম করে ঘুমাতে চাই। কাল সারাদিনে আমাকে অনেকগুলো ক্লাস নিতে হবে”
কুমিল্লায় যাত্রাবিরতির সময় সহযাত্রীদের সাথে মামার বেশ জমে উঠল। চা সিগারেটের ফাকে তারাও স্বীকার করে নিলেন, মামা খুব একটা ভুল বলেন নি। দায় আমাদেরও আছে। আমরা নিজেরাও নিজ নিজ জায়গায় সৎ নই।

২.
ধর্ষণ, দুর্নীতি, অনিয়মের একেকটা ঘটনা ঘটে আর ফেসবুকে মানুষ তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ফেসবুকেই অন্যের ফাঁসি দিয়ে দেয়। পারলে গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে মরিচ লাগিয়ে দেয়।

মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখলে মাঝে মাঝে আমার হাসি পায়।
সবাই অন্যের সমালোচনায় মহা ব্যস্ত। নিজের দিকে ফিরে তাকানোর কারও কোন ফুরসত নেই। সব অপরাধ দুর্নীতি করে অন্য লোকে। আর নিজেদের জায়গায় আমরা প্রত্যেকেই সাধু সন্ন্যাসী।

আমাদের অবস্থা হয়েছে “পান না তাই খান না”। দুর্নীতি করার সুযোগ নেই, তাই আমরা মহা সৎ। আর সুযোগ পেলে নিজের বাপকেও ছাড়ি না।

আমার আরেক মামা ব্যঙ্গ করে বলতেন, এ দেশে দুর্নীতি করে না কে? রিকশাওয়ালা, সিএনজিওয়ালা সুযোগ পেলেই ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। একটু বৃষ্টি হলে, অফিস টাইম, স্কুল ছুটির সময় ভাড়াতো বেশি দিতেই হয়, উলটো রাজি হবার জন্য তাদের হাতে পায়ে ধরতে হয়। “ভাইয়া, চলেন না প্লিজ...” আদুরে ভঙ্গিতে তোয়াজ করতে হয়।

মিটারের চাইতে ৫০/১০০ টাকা বাড়িয়ে নেয়া সিএনজি ড্রাইভার যেতে যেতে ট্রাফিক পুলিশ যে কত খারাপ তার বর্ণনা দেন। দেশটা দুর্নীতিতে ভরে গেছে বলে অন্যকে শাপ শাপান্ত করেন। এর ফাঁকে অনুরোধ করেন “ট্রাফিক পুলিশে ধরলে বলবেন, মিটারে যাচ্ছি”
তরকারিওয়ালা, সিএনজি ওয়ালা থেকে নিয়ে ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক...কেউ এর বাইরে নন। সবাই নিজের সুযোগ সুবিধা ঠিকই বুঝে নেন। আর সুযোগ পেলে অন্যদের গাল দেন।

৩.
যাদের শক্তি আছে, সাহস আছে, তারা সুযোগ পেলে ধর্ষণ করে। আর যাদের সে সুযোগ নেই, তারা অন্যভাবে মজা নেয়।

ফেসবুকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো আম জনতার অনেকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকায় ধর্ষণের কাহিনী পড়ে। একে অন্যের সাথে রসালো আলাপ করে।

কেউ ফোড়ন কাটে “ঠিকই হইছে। মাইয়া মানুষ এত রাইতে বাইরে গেল ক্যান”
কেউ বলে “উল্টাপাল্টা পোশাক পইরা ঘুরাঘুরি করলে ধর্ষনতো অইবই। এমন মাইয়াগো লগে এডাই ঠিক”।

ধর্ষিতা কোন নারীর সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় থাকলেতো কথাই নেই। দেখা হলে রসাত্মক ভঙ্গিতে চোখ ঘুরায়। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মেয়েটার দিকে ইংগিতপুর্ণ হাসি দেয়। সমাজে, মানুষের মুখে মুখে সেই নারীর বাড়ি পরিচিত হয়ে উঠে “ধর্ষিতা্র বাড়ি” হিসেবে।
গ্রামে কোন আগন্তুক এলে অন্যরা আগ বাড়িয়ে পরিচয় করিয়ে দেয় “ এই বাড়ির এক মাইয়ারে গত বছর পাটক্ষেতে...”।

একটা নারী হয়তো শারীরিক ভাবে ধর্ষিতা হয় একবার। কিন্তু সমাজের যাঁতাকলে সে ধর্ষিতা হয় বারবার। সারাটা জীবন এই অপমান তাকে বয়ে বেড়াতে হয়। ধর্ষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো সমাজের মানুষগুলো তার জীবনটাকে জীবন্ত নরক বানিয়ে ছাড়ে। অনেকে তাই লোক লজ্জার ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যায়।

অথচ এমন কেন হবে? একজন ধর্ষিতা নারীকে কেন এলাকা ছাড়তে হবে? সে তো কোন অন্যায় করে নি। কেন তাকে অন্যের সামনে হেয় হয়ে, মাথা নিচু করে জীবন কাটাতে হবে?
তার পোশাক যা-ই হোক না কেন, রাতের যত অন্ধকারেই সে পথ চলুক না কেন, কোন দিক দিয়েই ধর্ষণের ভয়াবহতা, নৃশংসতা তার চেয়ে বেশি নয়। তবে কেন অপরাধীর অপরাধের চাইতে আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণকে আমরা বড় করে দেখি? কেন তার জীবনটাকে আমরা নরক বানিয়ে তুলি?

আমাদের একেজনের ভেতরে একেকটা Dr jekyl আর Mr Hide বাস করে। বাইরে আমরা সজ্জন, ভাল মানুষ, ভেতরে চরম দায়িত্বহীন, নিষ্ঠুর। অন্যের দুঃখে আমাদের ৩২ পাটি দাঁত বেরিয়ে পড়ে।

৪.
তাই, ফেসবুকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো লোকদের মাঝে মাঝে বলি, ভাই একটু থামেন। অপরাধের বিচার, অপরাধীর শাস্তি আমরা সবাই চাই। কিন্তু কিন্তু নিজ নিজ জায়গায় আমরা নিজেরা কি সৎ? আমরা নিজেরা কি ঠিক কাজ করছি?

আইনের ভাষায় একটা কথা আছে “Where there is a Right, there is a Duty” অর্থাৎ একের কর্তব্য অন্যের অধিকার। সবাই যার যার জায়গায় নিজের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলেই অন্যের অধিকার সংরক্ষিত হয়।

কিন্তু, আমরা নিজের অধিকারের বেলায় যতটা সোচ্চার, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই উদাসীন। সমাজ হয়তো আমরা বদলাতে পারব না। তাই চলুন, নিজেকে বদলাই। নিজের কাজটি সততার সাথে সঠিকভাবে পালন করি। শারিরীক নিগ্রহের শিকার নারীকে হেয় করা থেকে বিরত থাকি। তাতে অন্তত কিছু মানুষ ভাল থাকবে। শান্তিতে বেচে থাকার সাহস পাবে।

- সামছুর রহমান ওমর

পঠিত : ৪২২ বার

মন্তব্য: ০