Alapon

‘দা ফ্লাইং ডাচম্যান’ নামে ভূতুড়ে জাহাজের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা...



সপ্তদশ শতাব্দী। ওলন্দাজরা প্রতিষ্ঠা করেছে ‘ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। ১৬৪১ সালের কোনো একদিন কাপ্তান হেন্ড্রিকের জাহাজ নেদারল্যান্ড থেকে রওনা দেয় পূর্ব ভারতের দিকে। উদ্দেশ্য, ভারত থেকে মশলা, রেশমি কাপড়, আর কাপড় রঙ করার রঞ্জক ও বিভিন্ন বিলাসী দ্রব্য কিনে আনা। তাদের উদ্দেশ্য সফল হল। বাণিজ্য শেষে দেখা গেল, জাহাজ কানায় কানায় ভরে উঠেছে বিলাসী দ্রব্য সামগ্রীতে। এবার তাদের ঘরে ফেরার পালা। জাহাজ রওনা দেয় আমস্টারডামের উদ্দেশ্যে।

কথিত আছে কাপ্তান হেন্ড্রিক যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফিরতে চাইছিল কোন এক কারণে। আগের পথ না ধরে কাপ্তান ধরল অন্যএক পথ। জাহাজ যখন অন্তরীপ ঘুরতে শুরু করেছে, ঠিক তখন উঠল ঝড়। কিন্তু কাপ্তান নির্বিকার। বাকি নাবিকেরা এসে করজোড়ে অনুরোধ করে তাকে বলল জাহাজ ঘুরিয়ে নিতে।

কিন্তু কাপ্তান হেন্ড্রিক স্রেফ মানা করে দিল। তারপর ডেকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কাপ্তান তার প্রিয় পাইপ টানতে লাগল। সে যখন তামাকের বড় বড় ধোঁয়া ছাড়ছে, তখন বিশাল বিশাল ঢেউ এসে তলিয়ে দিচ্ছে জাহাজের ডেক। শুধু পাইপ টানলেও হত, কাপ্তান ঈশ্বরকে সমানে গালিগালাজ করতে লাগল এই ঝড়ের কারণে।

অবস্থা বেগতিক দেখে জাহাজের বেশিরভাগ নাবিকেরা বিদ্রোহ করল। কাপ্তান হেন্ড্রিক বিদ্রোহীদের সামনেই তাদের নেতাকে হত্যা করল। যখন নেতার মৃত শরীর সে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলল, তখন জাহাজের ভেতর থেকে শোনা গেল একটা ভৌতিক কণ্ঠস্বর - ‘তুমি কি জাহাজ ঘোরাবে, নাকি সামনে এগুবে ?’ কাপ্তানের উত্তর, ‘জাহাজ ঘোরাবো না আমি।

কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, এক দেবদূত দেখা দিল সবার সামনে। শোনা গেল দেবদূতের অভিশাপ, ‘ অনাদিকাল তুমি সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়াবে তোমার জাহাজ নিয়ে, শান্তি পাবে না তুমি। তোমার সকল নাবিকেরা মরে ভূত হয়ে যাবে, তাদের সঙ্গেই তোমাকে থাকতে হবে। পিত্ত হবে পান করার মদ, মরিচা হবে খাওয়ার মাংস।’

ভয়ানক এই অভিশাপ শুনেও কাপ্তানের হুঁশ হল না । চিৎকার করে কাপ্তান বলে উঠল, ‘তাই হোক!’ দেবদূত জানায়, যদি কোনো নারী হেন্ড্রিককে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে, সে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। তার জাহাজ, তার কর্মী, সবকিছুর মুক্তি ঘটবে। তারপর শয়তান যেন হাওয়ায় গেল মিলে।

১৮৩৫ সালে একটা খবর সারা বিশ্বে বেশ আলোড়ন তোলে। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর এক জাহাজ হঠাৎ করে মুখোমুখি হয় পালতোলা এক জীর্ণ শীর্ণ জাহাজের। জাহাজটি যে এগিয়ে আসছে, কেউ দেখেনি। আচমকাই যেন উদয় হয়েছে। সংঘর্ষ হতে হতেও শেষ মুহূর্তে ইংরেজ নাবিকরা সামলে নিল যেন অলৌকিক ভাবে।

তাদেরকে অবাক করে দিয়ে নেদারল্যান্ডের পতাকা ঝুলানো জাহাজটা যেন হাওয়াই মিলে গেল নিমিষে। ঘটনাটি পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়। জার্মান নাট্যকার রিচার্ড ভাগ্নার ঘটনাটা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখে ফেললেন গীতিনাট্য ‘দা ফ্লাইং ডাচম্যান’। যে কাহিনী এতদিন লোকমুখে শোনা যেত, ভাগ্নারের গীতিনাট্য সেটা দাবানলের মত ছড়িয়ে দিল সারা ইউরোপে।

১৮৮১ সালে HMS Bacchante নামক এক জাহাজে করে বিশ্ব ভ্রমণে বের হয়েছিলেন ওয়েলসের রাজপুত্র জর্জ, পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ, তার ছোট ভাই রাজপুত্র ভিক্টর, এবং তাদের শিক্ষক জন নিল ডাল্টন। ১৮৮১ সালের ১১ জুলাই তারা অবস্থান করছিলেন অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে। ভোর চারটার দিকে জর্জ এমন কিছু দেখলেন যেটা কল্পনারও অতীত। লগবুকে লেখা তার অভিজ্ঞতাটা ছিল -

"জুলাই ১১। ভোর চারট। আমরা ফ্লাইং ডাচম্যানকে দেখলাম আমাদের জাহাজ অতিক্রম করতে। ওর শরীর থেকে লাল রঙের অদ্ভুত এক আলোকচ্ছটা বের হচ্ছিলো চারিদিকে। সেই আলোতে জ্বলজ্বল করছিল জাহাজের পাল, আর মাস্তুল গুলো। ওটার সাথে আমাদের দূরত্ব ছিল দুইশ ইয়ার্ড।

বন্দরে যে অফিসারটা পাহারায় থাকে, সেও পর্যন্ত দেখেছে ফ্লাইং ডাচম্যানকে। জাহাজের ডেকে যে কর্মচারীরা ছিল, তারাও দেখেছে। কিন্তু হঠাৎ গায়েব হয়ে গেল ওটা। শান্ত সমুদ্র। বোঝার উপায় নেই যে খানিক আগে একটা জাহাজ চলছিল এখানে। বিষয়টা মরিচিকা বলে উড়িয়ে দেবারও উপায় নেই, কারণ এক সাথে মোট ১৩জন মানুষ দেখেছে ওই ফ্লাইং ডাচম্যানকে। "

১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নৌ অফিসার অ্যাডমিরাল কার্ল তার বাহিনী নিয়ে ডুবোজাহাজে করে পাড়ি দিচ্ছিল সুয়েজ খাল। তখন তারা দেখেছে, ডাচম্যান তাদের দিকে তেড়ে আসছে। ঘটনাটি তারা রিপোর্টও করেছিল হিটলারের কাছে।

ফ্লাইং ডাচম্যান মিথ চালু হওয়ার বহু আগে থেকেই এমন বহু কাহিনী পাওয়া যায় নানা সভ্যতায় নানা ভাবে। হোমারের Odyssey.মহাকাব্য এবং গ্রিক মিথলজিতে পাওয়া যায় ওডিসিয়াস(Odysseus) এর কাহিনী। যেখানে নায়ক ওডিসিয়াস দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর ট্রয়ের যুদ্ধের পর চাইছিল তার ভালোবাসার নারীর কাছে ফিরে যেতে।

কিন্তু নানা ঘটনার পরম্পরা তাকে বাধ্য করে টানা দশ বছর সমুদ্র অভিযানে। আবার তেরো শতকে ইউরোপে শোনা যায় এক ইহুদীর কাহিনী। সেই ইহুদি যীশুখ্রিস্টকে অপমান করেছিল। যার কারণে ঈশ্বরের অভিশাপ নেমে আসে তার উপর। শেষ বিচারের আগ পর্যন্ত তাকে ঘুরে বেড়াতে হবে সারা দুনিয়া জুড়ে। যার কোনো মৃত্যু নেই, যার কোন শান্তি নেই। অভিশপ্ত সে।

যদি সত্যিই নানা কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে উড়ন্ত ওলন্দাজের সূত্রপাত ঘটে, কিন্তু তাই বলে এতগুলো মানুষ কি ভুল দেখেছে? বছরের পর বছর ধরে অভিযাত্রীরা ভূতুড়ে জাহাজ দেখার কথা লিখে গেছে লগবুকে। এর ব্যাখ্যা কী? এই রহস্য ভেদ কি হয়েছে?

উত্তর হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞান এই রহস্য ভেদ করেছে। মূলত দৃষ্টি বিভ্রমের কারণে এই দৃশ্য দেখা যায়। Fata Morgana নামক এক মরীচিকা। এ ধরনের মরীচিকা হল superior mirage-এর একটা জটিল রূপ। যার কারণে অভিযাত্রীরা সবাই একত্রে ফ্লাইং ডাচম্যানকে দেখেছে। আগ্রহের পাঠকেরা গুগল সার্চে Fata Morgana বা superior mirage লিখে সার্চ দিতে পারেন।

মূলত দৃষ্টিবিভ্রমের কারণে এই দৃশ্য দেখা যায়। Fata Morgana নামক মরীচিকা হল superior mirage-এর একটা জটিল রূপ। এগুলো দেখা যায় যখন আপনার দৃষ্টিরেখার নিচের বায়ু ঠাণ্ডা এবং উপরের বায়ু উষ্ণ থাকে। দিনের বেলায় সাধারণত বায়ুমণ্ডলের নিচের দিকের বায়ু উষ্ণ আর উপরের দিকের বায়ু শীতল থাকে।

যখন এই হিসেব উল্টে যায়, তখন দৃষ্টিবিভ্রম ঘটে। ঠাণ্ডা আর উষ্ণ বায়ুর উল্টো অবস্থানের কারণে আলো বাঁকা হয়ে যায়, ফলে যে বস্তুটা দৃষ্টিরেখা বরাবর দেখার কথা ছিল, সেটা দেখতে পাওয়া যায় দৃষ্টিরেখার চেয়ে উঁচুতে। ফলে মনে হয় বস্তুটা ভেসে আছে। একই কাহিনী ঘটেছিল নাবিকদের বেলায়।

তারা মূল জাহাজ না দেখে দেখেছিল জাহাজের প্রতিবিম্বকে, যে প্রতিবিম্ব ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উঁচুতে। একারণে মনে হত জাহাজটা উড়ছে, আর সেখান থেকেই নাম হয়েছে ফ্লাইং বা উড়ন্ত ডাচম্যান। যখন তারা প্রতিবিম্বের জায়গায় যেত, ততক্ষণে আসল জাহাজ চলে গেছে বলে প্রতিবিম্বও মিলিয়ে যেত। একারণেই কেউ খুঁজে পেত না ঘটনার কারণ। আর ব্যাখ্যাতীত ঘটনা সবসময় জায়গা করে নেয় ‘ভূতুড়ে’ হিসেবে।

ফ্লাইং ডাচম্যান নাম শুনলে অনেকের মনে আজ পাইরেটস অফ দা ক্যারিবিয়ানের দৃশ্য ভেসে উঠবে। চলচ্চিত্রটি ফ্লাইং ডাচম্যান নামের অদ্ভুত এই জাহাজকে আজ বিখ্যাত করে দিয়েছে। অসাধারণ চিন্তাটা চিত্রনাট্যকারের মাথা থেকে বের হয় নি। আসলে এটা একটা পৌরাণিক জাহাজ! পুরাণের সেই কাহিনীকে নতুন রূপে সিনেমায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সৌজন্য -Razik Hasan

পঠিত : ৫৬০ বার

মন্তব্য: ০