Alapon

|| শান্তির সন্ধানে ||



বুকে বাজছে ব্যথার বিন। খুব বেশিই চিন চিন করছে। ব্যথা করছে। একেবারে মধ্যিখানেই। আমার না ক্যাবল কান্না আসছে। চিৎকার করে কান্না আসছে। খুব করে কান্না করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু আমি তো ছেলে আমার কাঁদতে নেই। ছেলেদের নাকি কাঁদতে হয় না। নিয়ম নেই। ছেলেদের না চোখের পানি ঝরাতে নেই! ছেলেদের চোখের অশ্রুতে বুক ভাষাতে নেই। তবে রাতের আঁধারের আবরণে নিজেকে ঢেকে চুপি চুপি বালিশ ভাসানোর নিয়ম আছে। তবুও চারপাশকে জানতে দিতে নেই। শতো চাপে পড়ে পিষ্ট হয়ে যাক। তবুও চারিপাশকে কিছুই বলতে নেই। জানাতে নেই। দেয়া উচিত নয়।

ক্ষুদ্র এই বুকের ভেতর মাঝে মাঝে কী ঝড়টাই না বয়ে যায়। সকাল -সাঁজে। রাত-বিরেতে। বুকের খাঁচাটা ভেঙ্গে ভেঙ্গে মিসমার হয়ে যাক। সুখ নামক বস্তুটি চলে যাক কাউকে বলতে নেই। কাউকে বোঝাতে নেই। আচ্ছা আমার এতো দুঃখ ক্যান! ক্যান কষ্টের সাথে আমার এতো সহবাস! কষ্টটা বারেবার ক্যান আমায় কোলে নেয়!! কষ্টগুলো যদি পানি হতো তা হলে সারাটা পৃথীবিকে তা ভাসিয়ে দিতো! কষ্টগুলো যদি অগ্নি হতো তা হলে তা সারাটা পৃথিবীকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতো।

আচ্ছা মাঝেমধ্যে তো বানের তোড়ে সারাটা পৃথিবীর অনেকগুলো দেশ-অঞ্চল-গ্রাম-শহর-নগর সব ভেসে যায়! আমার ভেতর যে কষ্ট আছে তা-ও এরকম করে, মানে প্রবল জলস্রোতের মতো করে সারাটি পৃথিবীর মাঝে যে কষ্টের অগ্নুৎপাত আছে তাতে ছড়িয়ে পড়তে পারে না? তা হলে তো মনে হয় সমানে সমান হয়ে যাবে। কষ্ট যখন পুড়িয়ে পুড়িয়ে মারে তখন সে -যে কষ্টগুলো সমুদ্রের পানির মতো বুকের পিঞ্জরে জমে আছে, ইচ্ছে মতো ঢেউ তোলে - তার পানি দিয়ে সেগুলোকে নির্বাপিত করবে! আবার আগুনের তাপে কষ্ট-সাগরের পানিগুলোও তো কিছুটা হলেও কমে যাবে!

উঁহু আমি ভাবছিটা কী! এ-সব ভেবে কী লাভ! কোনো সমাধান নেই। সম্ভাবনাও নেই.... কিন্তু আমার তো ব্যথার উপশম হচ্ছে না! প্রাণের কোণের শূন্যতা পূর্ণতা পাচ্ছে না! বিমূর্ত বেদনার সংক্রমণ কমাতে আমি আমার প্রিয়তম প্রিয়জন স্বজন পরিজনদের কাছে ফোন করি। সাক্ষাৎ করি। দেখা করি। কথা বলি। খোশগল্পে মেতে উঠি। নাহ! সাময়িক থামলেও তাকে কোনোভাবেই নিরাময় করা যাচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না.....

ঋতুরাজ বসন্তের রূপবিভার কতো শতো অনুষঙ্গ প্রকৃতির চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো। সেই ঋতুরাজ বসন্তের কতো সুন্দর মনোরম মনোহর দিনগুলো আমাকে আর কোনোভাবেই টানে না। শরতের তো কতো রূপ কতো রং। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় তার ঝকঝকে পরিস্কার স্বচ্ছ নীলাকাশ! বিস্তৃর্ণ জমিনের মাঠেঘাটে কাশফুলের শুভ্রতা! এই নীলাকাশ আর কাশফুল দেখে দেখে কতো দিন পার করেছি। মন খারাপের ভেলায় ছড়ে যখন ঝকঝকে স্বচ্ছ নীলাকাশ দেখতাম, তখন আমি মনে মনে কল্পনার জগত থেকে দূরের ওই নীলিমা ঘুরে আসতাম। সাদা সাদা কাশফুল হাতে নিয়ে মনে মনে সফেদ মেঘেদের সাথে খেলা করে আসতাম।

রাতের আকাশে তারার মেলা। চাঁদের আলো। শিউলি, পলাশ, বকুল,জুঁই ও চ্যামেলী ফুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে থাকতাম। মাতাল করা ঘ্রাণটা উপভোগ করতে আমি বাড়ির উঠোনে শীতল পাটি বিছিয়ে সটান হয়ে শুয়ে থাকতাম! চোখমুখ বন্ধ করে নাক টেনে টেনে ফুলের এতোসব ঘ্রাণ শুঁকতাম! হারিয়ে যেতাম অনায়াসেই কোনো এক জগতে! হঠাৎ চোখদুটো খুলেই চকচক করে উঠতো চোখের পাতা! কী এক দারুণ মিল খুঁজে পাই আমি রাতের আকাশের তারার সাথে শিউলি ফুলের। মনে মনে ভাবি কী দারুণ মিতালীই না গড়লো তারা উভয়েই। কী অদ্ভুত কিসিমে’র একটা মিল আছে এই দুটো জিনিসের মধ্যে!

রাত শেষে প্রভাত হাসে। তারাগুলো সব নীরব হয়ে হারিয়ে যায়। তদ্রুপভাবেই রাতের আবরণ মাড়িয়ে সকালের স্নিগ্ধ হাসি ফুটে ওঠে যখন, তখন আবার শিউলী ফুল ঝরে যায়। কী অদ্ভুত মিল তাদের! কী সুন্দর করে তারা উভয়েই রাতের সাথে মিতালী গড়েছে! মনে পড়ে যায় গীতিকার সুরকার প্রিয় শিল্পী মাওলানা তারিক মনোয়ারের একটা অসাধারণ সুন্দর সংগীত। যেখানে তিনি শিউলী ফুলের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন গানের ভাষায়,

" ওগো ফুল শিউলী!
তোমার সাথে বলো কার মিতালী!
তার নাম তার খোঁজ দাও না আমায়!
আমার সকলই উজাড় করে,
দেবো গো তোমায়...."

এভাবে একে একে অনেকগুলো ফুলের কাছে বড়ো আশা নিয়ে তিনি তাদের মিতালী কার সাথে, কার সাথে তাদের সখ্যতা, তা জিজ্ঞেস করেছেন। কিন্তু কোনো ফুল তাঁকে জবাব দেয় নি! কিন্তু আমিও একটা মিতালী খুঁজে পেয়েছি তাঁর ও তাঁদের, তা হলো রাতের আকাশের তারার সাথে মিতালী। অবশ্য বিষয়টা শিল্পী তাঁর গানেই তুলে ধরেছেন, হয়তো এতো স্পষ্ট করে দেখান নি বা দেখাতে পারে নি! তবে তিনি যা দেখিয়েছেন তা এরচেয়ে বড়ো অর্থবহ! তিনি ফুলদের মৌনতায় আল্লাহ প্রেমের সুরের তান তথা সুরেলা ধ্বনি খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু আমি!!!

বলছিলাম নীলাকাশের তারা আর শিউলী ফুলের কথা, সেই শিউলী ফুল তার গাছের চেয়ে নিচে ঝরে পড়ার মধ্যে বেশি সৌন্দর্য তুলে ধরে। মাটির মাঝে শিউলী ফুলের পাপড়িগুলো কী অনিন্দ্য সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটায়! তারাগুলোও রাতের আকাশের পরে সকলে যেভাবে হারিয়ে যায়, তখনই তো স্নিগ্ধ সকাল আসে এক পবিত্র-পরিশুদ্ধ এবং প্রবল প্রশান্তির আমেজ নিয়ে।

দুঃখ-কষ্টটাও তো এমনই ঝরে পড়তে পারে। তা ঝরে পড়ার মাঝেই তো প্রবল প্রশান্তির প্রবর্তনা। জীবনটা তাজা থাকে তা হলে। কাজের মাঝে পাওয়া যায় প্রচুর উদ্দীপনা। স্বপ্নের মাঝে বহমান নদীর মতো বইতে থাকে তখন সাধনার প্রণোদনা। কিন্তু আমার যে বুকের খাঁচায় চেপে আছে এখনো একরাশ বিমূর্ত বেদনার প্রতিচ্ছবি।

আচ্ছা! বেদনারা চিরকাল আমাকেই ক্যানো পেয়ে বসে? পবিত্র প্রভাতের মতো করে আমার জীবনে ক্যানো কোনো সূর্যি হাসে না!! আমার তো আগেও দুঃখ হতো। কষ্ট জাগতো। বেদনার বাহুডোরে আগেও তো জড়িয়ে যেতাম। তখন কিন্তু রাতের আকাশ থেকে চাঁদ-তারা যেভাবে নিভে যায়, সেভাবে আবার খানিক পরেই আমার দুঃখগুলো ঝরে যেতো। কষ্টগুলোও খসে পড়তো। অথচ এখন আর খসে পড়ে না।দুঃখ-বেদনাগুলো ঝরে যায় না !

আমার এই কষ্টগুলো নিয়ে, হতাশাগুলো নিয়ে কালকে ছোট বোনের সাথে অনেক কথা বলেছি। আমি বুঝতে পেরেছি সে-ও ভীষণ কষ্টে আছে। আমার আর তার কষ্টের মাঝে যদিও-বা যোজন যোজন ফারাক আছে, তবে কষ্ট তো তো কষ্টই। তো সে হঠাৎ পরামর্শ দিল সেজদা দীর্ঘ করতে, কোরআন তেলাওয়াত এর কথা এসেছে যখন, তখন তার মুখে সুরা দুহার কথা শুনলাম। আমার আবার সুরা দুহা প্রচুর পরিমাণ ভালো লাগে। এই সুরাটা ডিপ্রেশনের এক মহৌষধ।

আমি সাহিত্যে, কবিতায় উবু হয়ে পড়ে থাকতাম। প্রচুর ভালো লাগে তা। কিন্ত এখন তাতেও আমার রাজ্যের অনীহা জন্মে গেছে। তবুও সবচেয়ে যে কয়টি বিষয় আছে ভালো লাগার মতো, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাহিত্য। এই কবিতা, এই সাহিত্য আমায় টানে। প্রচুর টানে।

যাদের আরবি ভাষা-সাহিত্য সম্পর্কে সাম্যক ধারণা আছে তারা এই যে আলকুরআন, এর মাঝে তো বটেই, স্পেশালি এই সুরার মাঝেও ব্যাপক মজতে পারবেন। এখানের শব্দের দ্যোতনা, ভাবের ব্যঞ্জনায় ডুবে এক অনুপম আনন্দের জোয়ারে ভাসতে পারবেন। সুরাটি জীবনের সাথে মিলানো এক জীবন্ত উপদেশ। এটা পড়লেই আমি জীবন্ত কুরআনের স্বাদ খুঁজে পাই। এই সুরার আয়াতগুলো মনে হয় আমাকেই ডাকছে, আমাকেই বলছে। আমি কুরআন পড়ি আর কুরআনের সুরে মজি। তবে এই সুরাটা আমার কাছে মনে হয় কুরআনকে আরো জীবন্তরূপে হাজির করে আমার সামনে!

আমার ভেতরের কষ্টগুলো তাড়াতেই যেনো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলেছেন যে,

" শপথ রাতের যখন তা নিঝুম হয়। তোমার রব তোমাকে পরিত্যাগ করেন নি এবং তোমার ওপর অসন্তুষ্টও হন নি। "

এইটুকু পড়ে আমি স্থির থাকতে পারি নি। সত্যি আমি বাচ্চাদের মতো করে কাঁদছি। খুবই কাঁদছি। এই যে এখন যে শব্দগুলো লিখছি, এই লেখার মাঝেও আমি আনন্দ-আবেগে কঁদে ফেলেছি। রাত যখন নিকষ কালিমায় ভরে যেতো, যখন তা নিঝুম হতো -আমি তখন রুম থেকে বের হতেও ভয় পেতাম। এই রুম থেকে ওই রুমে যেতেও ভয় পাই আমি মাঝেমধ্যে। আগে এমন ভয় হতো। ভীষণ ভয় হতো! এই যে এতো বড়ো হয়েছি, এখনো গ্রামে গেলে মাঝেমধ্যে হয় এমন। মনে হয় আমার রব্ব আমার মতো একটা ভীতুর ডিমকে উদ্দেশ্য করেই এসব বলছেন। আমাকেই বিপদের ভীড়ে সাত্বনার সুশীতল বাণী শুনোচ্ছেন। আমি ভাবি, আমি তো কত্তো কত্তোগুলো পাপ করি! পাপের ভীড়ে আমার আমিত্বকেও খুঁজে পাওয়া দায়। তবুও আমার আল্লাহ'র বাণী শুনে আমি আশাহত হতে পারি না! আমি ভাবি -আমার রব্ব, আমার আল্লাহ এত্তো ভালো ক্যানো! ক্যান এত্তো ভালো তিনি! হুঁ….….??

আমার ভুলচুক পেলে তো কতো কাছের মানুষগুলোও সুদূরে চলে যায়! আমাকে তাদের জীবন আঙ্গিনা থেকে তাড়িয়ে দেয়। অথচ আমার আল্লাহ আমাকে তাড়ায় না। তাঁর রহমের অবারিত বারিধারায় আমাকে ভিজিয়ে দেয়। দয়া-মায়া আর স্নেহ-ভালোবাসায় সিক্ত করে নেয়। আমার শতো সহস্র ভুল দেখেও বুকে টেনে নেয়। কাছে রেখে দেয়। ধুর ধুর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে না। দেয় না। আমি চরম অবাধ্য! চরম!! তবুও তিনি আমাকে ঘৃণা করেন না। অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ করে আমাকে শায়েস্তা করেন না। আমি ভাবি -মানুষের হাতে যদি এসব বিষয় থাকতো, তা হলে আমার পাপের জন্যে আমাকে নিমিষেই মেরে ফেলতো। পাপ করা অবস্থায় সেখানেই। সেভাবেই....

ব্যথাহত মনটাকে আমি পূণরায় আকাশ দেখাই। ভোরের শীতল আকাশটা দেখাই। একেবারে শরতের ঝকঝকে নীলাকাশটা-ই দেখাই। যে আকাশটা বর্ষার আকাশের মতো অঝোরে কেঁদে কেঁদে হাহুতাশ করে না। সে আকাশ দেখাই, যে আকাশে রব্বের রহমের বারিধারা ওড়াউড়ি করে!

পরের আয়াতগুলো পড়ি। আরো গাঁঢ়ো মনোযোগ দিয়ে পড়ি। "অবশ্যই তোমার জন্য পরবর্তী সময় পূর্ববতী সময়ের চেয়ে উত্তম হবে। নিশ্চয়ই তোমার রব্ব তোমাকে এতো বেশি দিবেন যে তুমি খুশি হয়ে যাবে"! নিরবে নিভৃতে প্রভুর বাণী শুনে তা থেকে আমার আশার সঞ্চার হয়। আমি স্বপ্ন -সাধনার প্রণোদনা পাই। সাহসের প্রবর্তনা নিই। জীবনযুদ্ধে একজন আদর্শিক ও সাহসী যোদ্ধা হবার উদ্দীপনা এখান থেকেই পাই। এখন ক্যানো যেনো বুকের ভেতরটার মাঝে খুব বেশি একটা চিনচিন করছে না। বুকের ভেতর বয়ে চলা ব্যথার নহর, দগদগে সব ক্ষত --সব কিছু আজ যেনো ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে। সেরে যাচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ!

..."তিনি তোমাকে পথহারা অবস্থায় পান, অতঃপর তিনিই তোমাকে পথ দেখান"

এই আয়াতটা আমাকে পাপের পথ পোক্তভাবে ছেড়ে আসার স্বপ্নটা দৃঢ় করতে অনুপ্রেরণা যোগায়। আশা জাগায়। আমি আরো একবার আশার ভাসমান ভেলায় ছড়া শুরু করছি। আমি জানি আমার রব্বুল আলামীন আমাকে আবারও আলোর পথ দেখাবে। আমি তো একসময় প্রায় আলোর আঙিনা হতে ছিঁটকে গেছি। হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে। আবারও আমার রব্ব আমাকে আলো দেখিয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি আবারও আলো দেখাবেন তিনি। আমার হৃদয়ের কোটরে বেড়ে ওঠা অশান্তির অমানিশা তিনি বিদূরিত করবেনই। ইন শা আল্লাহ!

কুরআন রেখেই শুয়ে পড়ি। রাত্রির নির্জনতা বাড়ে। গভীরতা বাড়ে। ঘুম আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। গভীর ঘুমের কোলে ঢলে পড়ি। হারিয়ে যাই সুগভীর নির্জনতায়। আচমকা জেগে উঠি। শেষ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভাঙ্গি। অযু করি। জায়নামাজ বিছিয়ে দিই। সালাতে দাঁড়িয়ে যাই। সিজদাহ্ একটুখানি দীর্ঘ করলে শান্তি পাই। মনের মুকুরে প্রশান্তির ফল্গুধারা নেমে আসে। রব্বের রহমের ছোঁয়ায় হৃদয়টা ভিজিয়ে নিই। সিজদাহ্ দীর্ঘ করতে ছোটো বোনের উপদেশটা আরো বেশিই মনে ধরেছে। তার মতো এতো চঞ্চলা চপলা একটা মেয়ে আমাকে ক্যানো সিজদাহ্ দীর্ঘ করতে বলছে তা প্রকটিত হয়ে যায় আমার কাছে। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হয়ে ওঠে আমার মনে।

শেষ রাতে মানুষ সব বেঘোরে ঘুমোয়। আমার রব্বের দুয়ারে তাঁর কুদরতি পায়ে আমি আমার মাথাটা নুইয়ে দিই। দীর্ঘ সিজদাহ্, দীর্ঘ তাসবীহ্'র মাঝে এতোটা প্রশান্তির আবেশ পাওয়া যায় তা এতো সুদৃঢ় করে কখনোই উপভোগ করিনি। যদিও-বা উপলব্ধি হয়েছে বেশ কয়েকবার। কারণ আমরা তো আর কোনো কারণে কষ্ট পেলে, কষ্টের কষাঘাতে জর্জরিত হলে দেবদাস হয়ে নেশার রাজ্যে হারিয়ে যেতে পারি না। আমাদের ব্যথা-বেদনার উপশম তো রব্বের দুয়ারে লুটিয়ে পড়ার মাঝেই নিহিত। সিজদাহ্'তে অবনত হওয়া। তাঁকে ডাকা। তাঁকে স্মরণ করা। কিংবা সর্বোচ্চ হলে আচ্ছামত একটা ঘুম দেয়া।

আজকে আমার ব্যথা-বেদনার উপশম ঘটাতে আমি সুদীর্ঘ একটা সময় ধরে মাথা নুইয়ে পড়ে ছিলাম রব্বের দুয়ারে। তাঁর সঙ্গে আমার কত্তোগুলো কথোপকথন জমে আছে যে! তাঁকে নিবেদন করার মতো অনেকগুলো আরজি, অনেকগুলো দরখাস্ত পড়ে আছে ! আমি আজকে সবকিছুই খুলে খুলে তাঁর কাছে বলেছি। আজকের সিজদাহ্'তে অনেক বেশিই অশ্রুপাতন হয়েছে আমার! আমার কান্নার অশ্রু যেনো আজ সাগরের ঢেউয়ের মতো উপচে উপচে পড়েছে। কান্নার নোনাজলে জায়নামাজের সিজদাহ্'র জায়গাটা অনেকখানি ভেজে গেছে। সেই জল আমার অন্তরাত্মাকে ভিজিয়ে নির্মল ও সতেজ করে দিয়েছে।

ছেলেদের কাঁদতে নেই। তাঁদের দুঃখের প্রকাশ ঘটাতে নেই। চুপিচুপি বালিশের কোণ ভাসানোর যে নিয়ম আছে বলে মনে করতাম - এখন আমার সেসব ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। আমি এখন মনে করি ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সকলের কাঁদা উচিত। একেবারে সকলের। খুব করে কান্না করা উচিত। খুউউব!

চুপিচুপি বালিশ ভেজানোর প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলো গভীর রজনীর নির্জনতায় রব্বের সাথে মিতালী গড়া। মাথাটা নুইয়ে অশ্রুর শ্রাবণ ঝরানো প্রয়োজন। প্রয়োজন জায়নামাজ ভাসানো। আর সেই অশ্রু-শ্রাবণে ভিজে জুবুথুবু হয়ে যাবে পাপের সকল রঙিন জামা। সেই ভেজা জুবুথুবু রঙিন জামাকে আমরা তখন পাল্টে ফেলবো। পাপের কালিমাগুলকে মুছে ফেলবো। আমরা পরিশুদ্ধ হবো।

সিজদাহ্'য় এতোখানি প্রশান্তি ক্যানো পাই, এর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে অবুঝ মনে এক অনাবিল আকুলতা সৃষ্টি হয়। আমি তা জানতে কুরআনকেই পুনরায় ছুঁয়ে দেখি। কুরআন আমাকে কী সুন্দর করে জানান দেয়,

''..আর তুমি সিজদা করো এবং (তোমার) আল্লাহর নিকটবর্তী হও”। (৯৬:১৯)

এই আয়াতটা পড়ে আমার মনের সকল প্রশ্নের জাওয়াব মনে হয় এককথায়ই পেয়ে গেছি।

ওয়াল্লাহি! যখনই আমি গভীর আবেগে রহমানের দরবারে সিজদাহ্'তে ঢলে পড়েছি, তখনই মনে হয়েছে যেনো আমি আমার অদেখা অ-ছোঁয়া রব্বের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়ে আছি! মনে হয়েছে তিনি আমার সামনেই! এই যে অনুভূতি তা পৃথিবীর কোনো সাহিত্যিকের সাহিত্যের শব্দসম্ভার দিয়ে বুঝানো যাবে না। অনুভব করানো যাবে না।

আজ আমি চাঁদের আলো, পুষ্পের সৌরভ -- সবকিছুর চেয়েই রব্বের দরবারে মগজ লুটিয়ে দেয়ার মাঝে এক অনাবিল আনন্দের হিল্লোল খুঁজে পেয়েছি। কবি মতিউর রহমান মল্লিকের কবিতার ভাষায় বলতে চাই ; আমি সেই সন্ধানী পেয়ে গেছি সন্ধান!

|| শান্তির সন্ধানে ||
~Redwan Rawaha[/b]

পঠিত : ১০৮৮ বার

মন্তব্য: ০