Alapon

গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ যেভাবে কর্মকান্ড পরিচালনা করে...



পৃথিবীর সফলতম গোয়েন্দা সংস্থা গুলোর একটি মোসাদ। মোসাদের গোপন কিলিং মিশন গুলো নির্ভুল ভাবেই পরিচালিত হয়ে থাকে। আজ আমরা জানার চেষ্টা করবো ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ নিয়ে:

১৯৪৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ১৯ মাসের মাথায় ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডাভিড বেন গুরিয়ন ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন, ইসরায়েলের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা "দ্যা ইন্সটিটিউট অফ ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অপারেশন" । ১৯৫১ সাল থেকে এটি বিশ্বব্যাপি মোসাদ নামে পরিচিত হয়ে আসছে।মোসাদ যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্য, কানাডার গোয়েন্দা সংস্থার অনুরুপ ভাবে অনুসরণ করে থাকে।মোসাদের সকল কাজের রিপোর্ট এবং গোয়েন্দা তথ্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হয়। মোসাদের সদস্য সংখ্যা কত এর সঠিক তথ্য কেউ ই জানেনা, তবে ধারনা করা হয় প্রায় ১২ শ এর মতো হতে পারে। মোসাদের সদর দপ্তর ইসরায়েলের তেল আবিবে অবস্হিত।

মোসাদের লক্ষঃ

ফিলিস্তিনিদের মুক্তি আন্দোলন ব্যাহত করা এবং ইসরায়েলের সীমানার বাইরে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করা। শত্রুভাবাপন্ন দেশ গুলো যেন,বিশেষ ধরনের অস্ত্র তৈরি করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা। দেশে বিদেশে ইসরায়েলি লক্ষ বস্তুতে হামলার ষড়যন্ত্র আগাম প্রতিরোধ করা।

মোসাদের কার্যক্রম ৮ বিষয়ে পরিচালিত হয়ে থাকলেও ৫ বিষয়ে ধারনা পাওয়া যায়:


(ক) কালেকশন ডিপার্টমেন্টঃ

মোসাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ এটি। বহির্বিশ্বে ডিপ্লোম্যাট,সাংবাদিক, ব্যাবসায়ীসহ অন্যান্য ছদ্মবেশে কাজ করে এই বিভাগের সদস্যরা।


(খ)পলিটিক্যাল একশন ও লিয়োজ বিভাগঃ

এই বিভাগের কাজ হলো বন্ধুভাবাপন্ন দেশ গুলোর গোয়েন্দা ও গুপ্তচরদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং যেসব দেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক নেই তাদের সাথে যোগাযোগ রাখা।


(গ)স্পেশাল অপারেশন বিভাগঃ

বিশ্বব্যাপি গুপ্তহত্যার জন্য পরিচিত মোসাদ, এই বিভাগের মাধ্যমে কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করে থাকে।গ্রুপটি চাইলে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ১২/১৪ টি অপারেশন একসাথে পরিচালনা করতে পারে।


(ঘ)ল্যাপ ডিপার্টমেন্টঃ

এই বিভাগটি প্রতিপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করতে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের জন্য প্রচারণা চালায় এবং শত্রু শিবিরে ভুল তথ্য ছড়িয়ে বিভ্রান্ত তৈরি করে।

(ঙ)রিসার্চ বিভাগঃ

যাবতীয় গোয়েন্দা গবেষণা এবং "কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স" এর ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্য কাজ করে থাকে এই গবেষকেরা।

★★"বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকরী হত্যাযন্ত্র" খ্যাত মোসাদের হাত থেকে রক্ষা পাননি গুরুত্বপূর্ণ নেতা কিংবা বিজ্ঞানীরাও। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মোসাদের কার্যক্রম গুলো দেখে নেওয়া যাকঃ

*এডলফ ইচম্যানকে অনেক দিন হলেই খুজছিলো মোসাদ,খুজতে খুজতে ১৯৬০ সালে আর্জেন্টিনায় ইচম্যানের খোঁজ পেয়ে যায় তারা। এবং একই বছর তাদের একটি গোপন টিম পাঠিয়ে তাকে অপহরণ করে ইসরায়েলে আনা হয় এবং তার বিরুদ্ধে উত্তর ইউরোপে ইহুদি গনহত্যার অভিযোগ আনা হয়। পরবর্তীতে ইসরায়েলি আদালত তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়।

১৯৬৫ সালে নাযি ওয়ারে অভিযুক্ত লাটভিয়ার বৈমানিক হার্বার্টস কুকার্সকে উরুগুয়ে থেকে ফ্রান্স হয়ে ব্রাজিল যাওয়ার পথে হত্যা করে মোসাদ।

অর্থনীতি ও কুটনীতিবিদ এবং চিলির সাবেক মন্ত্রী অরল্যান্ড লেটেরালকে ওয়াশিংটন ডিসিতে গাড়ী বোমা হামলায় হত্যা করা হলে,ধারনা করা করা হয় হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে চিলির ডিএনআইএ'র এজেন্টরা।পরবর্তীতে জানা যায়, এটি ছিলো মোসাদের পরিকল্পিত হত্যাকান্ড।

*মিশরে ১৯৫৭-৬৫ সাল পর্যন্ত জামাল আব্দেল নাসেরের সামরিক এবং যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে গোয়েন্দা কার্যক্রম চালায় মোসাদ ।১৯৬২ সালে মিশরের সফল রকেট উৎক্ষেপণ গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিলো,মোসাদ শুরু করে দিলো কিলিং মিশন।একে একে মিশরের বিজ্ঞানীদের হত্যার টার্গেট নিয়ে মাঠে নামলো মোসাদ। রকেট কারখানায় পার্সেল বোমার মাধ্যমে ৫জন কর্মকর্তা কে হত্যা এবং বিজ্ঞানীদের মুহুর্মুহু গুলি এবং হত্যার হুমকি দিয়ে আতঙ্কিত করে তোলে তারা। ফলে যারা বেঁচে ছিলেন, পরবর্তীতে তারা ইউরোপে বাসস্হান গড়ে তোলেন। ১৯৬৪ সালে বৃহত্তর পরিকল্পনা নিয়ে নতুন গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু করে মোসাদের আরেক স্পাই ইলি কৌহেন। ফলাফল সবার ই জানা, ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আরবদের পুনরায় পরাজয়।

*ইসরায়েল ইরানকে অনেক বড় হুমকি মনে করে। ফলে ইরানে মোসাদ ব্যাপক গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে,এবং ইরানের সম্ভাবনাময়ী বিজ্ঞানী বুদ্ধিজীবীদের গুপ্তহত্যা করে থাকে। ২০০৭ সালে ইরানের পারমানবিক বিজ্ঞানী ড. আরদেশির হোসেনপুরকে হত্যা করা হয়। প্রথমে ধারনা করা হয়,তিনি গ্যাস বিষক্রিয়ায় মৃত্যু বরন করেছেন। তবে পরবর্তী সময়ে জানা যায়, ড.আরদেশির মোসাদের টার্গেট ছিলো এবং তারাই এই হত্যাকান্ড পরিচালনা করেছিলো।

২০১০ সালে ইরানের নিউট্রন বিষেশজ্ঞ মাজিদ শাহরিয়ার যিনি ইরানের প্রতিভাবান পরমানু বিজ্ঞানী ছিলেন,তাকে গাড়ী বোমা হামলার মাধ্যমে গুপ্তহত্যা করে মোসাদ।একই দিনে তৎকালীন ইরানের আনবিক সংস্থার প্রধান ড.আব্বাসির গাড়ীতেও হামলা হয়েছিলো,যদিও তিনি প্রানে বেঁচে গিয়েছিলেন।

৩৫ বছর বয়সী ইরানের বুশেহার পরমানু কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রকৌশলী অধ্যাপক দারিউশ রেজায়ী বাড়ী ফেরার পথে মোসাদের গুপ্তঘাতকের গুলির আঘাতে মৃত্যুবরন করেন।

৩২ বছর বয়সী কেমিক্যাল ইন্জিনিয়ার মোস্তফা আহমদ রোশান ইরানের নাতান্জ পরমানু কেন্দ্রের প্রধান ছিলেন,২০১২ সালে প্রতিদিনের মতো তেহরানের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ী বিস্ফোরণে মৃত্যু বরন করেন। পরে জানা যায় তার গাড়ীতে চুম্বক বোমা লাগানো ছিলো।

*ইরাকে সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতায় আসলে, ইসরাইল ইরাককে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে। ইরাকে মোসাদের ব্যাপক গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার ইতিহাস কমবেশি সবার ই জানা। ১৯৭৮-৮১ সালের মধ্যে ইরাক "অসরিক নিউক্লিয়ার রিএক্টর" এর কার্যক্রম ব্যাপক ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।ধারনা করা হয়,ইরাক এই গবেষণা শেষ করতে পারলে,সেই সময় পারমানবিক শক্তি অর্জন করতে অন্যসব দেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকতো। ১৯৮১ সালে ইরাক কিছু বুজে ওঠার আগেই, এফ-১৬ বিমানের মাধ্যমে গোলাবারুদ দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয় ইরাকের গবেষণা কার্যক্রম।

*ফিলিস্তিনে মোসাদের হত্যাকান্ডের কথা সকলের ই জানা। পিএলও এবং হামাসের স্বাধীনতা কামী নেতা এবং ফিলিস্তিনের অসংখ্য বিজ্ঞানীকে গুপ্তহত্যা করেছে মোসাদ। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে যে নেতাই এগিয়ে নিচ্ছিলো,সে নেতাই হয়ে যেত মোসাদের প্রধান টার্গেট। ১৯৮০ থেকে ৮৮ সাল পর্যন্ত মোসাদ দুর্দান্ত আকারে পিএলও লিডারদের হত্যা করে,ফলে পিএলও এর স্বাধীনতা আন্দোলন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে জন্ম হতে থাকে হামাসের, এবার পিএলও নয় হামাস হয়ে ওঠে মোসাদের টার্গেট। ১৯৯৭ সালে খালেদ মিশালকে টার্গেট করে মোসাদ,জর্ডানের আম্মান শহরে মিশালকে হত্যার টার্গেট টি ছিলো মোসাদের সর্ববৃহৎ ব্যার্থ পরিকল্পনার একটি। ধরা পড়ে যায় মোসাদের গুপ্তচর, সেই যাত্রায় বেঁচে যাওয়া খালেদ মিশাল আজ হামাসের গুরুত্বপূর্ণ নেতা।

হামাসের ড্রোন প্রযুক্তিবিদ মোহাম্মদ জাওয়ারী দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ ড্রোন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করে আসছিলেন। ৪৯ বছর বয়সী জাওয়ারী ২০১৪ সালে অস্ত্র বহন উপযোগী ড্রোন আবিষ্কার করেন।তিনি হামাসের ড্রোন প্রযুক্তির দলনেতা ছিলেন। ২০১৬ সালে তিউনিসিয়ায় মোসাদের সদস্যদের গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় এই তাজা প্রান।

ফাদি আল বাৎশ ফিলিস্তিনি নাগরিক এবং হামাসের ড্রোন প্রযুক্তিবিদ। ২০১১ সালে মালয়েশিয়ায় উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার জন্য যান,২০১৬ সালে দেশটির সরকার থেকে বিশেষ পুরস্কার প্রাপ্তও হন ফাদি। তিনি হামসের ড্রোন প্রযুক্তিকে আধুনিকায়ন করতে কাজ করছিলেন বলে ধারনা করা হয়। প্রতিদিনের মতো নামাজে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলেন তিনি,২০ মিনিট ধরে অপেক্ষা করা গুপ্তচররা ফাদিকে দেখেই মুহুর্মুহু গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় এই তাজা প্রানটিকে।

এছাড়াও পৃথিবী ব্যাপি অসংখ্য হত্যার এবং যুদ্ধ বাধানোর রেকর্ড আছে মোসাদের। ধারনা করা হয়, আমেরিকার নাইন ইলেভেন এবং ২০০৬ সালে লেবাননের যুদ্ধের জন্য দায়ী ছিলো মোসাদ।এমনকি বর্তমান বিশ্বের জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস ইসরায়েলের সহযোগিতায় এবং পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।

- আশরাফুল

পঠিত : ১২৪৪ বার

মন্তব্য: ০