Alapon

এলোমেলো জীবনের এলোমেলো গল্প!

হঠাৎ একরাতে বেরিয়ে পড়লাম। দিনাজপুরের গাড়িতে চেপে আস্তো একটা রাত শেষে ফজরের ওয়াক্তে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে পৌঁছলাম। তখনও উত্তরবঙ্গ থেকে শীত বিদায় নেয়নি। হালকা কুয়াশা আর হাড় কাঁপানো শীত না হলেও দাঁত কাঁপানো শীত আমাকে জেকে বসল!


ফুটানি করে ব্লেজারটিকে ব্যাগের ভিতরেই বন্দি রেখেছিলাম। কিন্তু বাস থেকে নামার পর মনে হল, বিরাট ভুল হয়ে গেছে! কিন্তু যা ভুল তা ভুলই! আপাতোত তার কোন ক্ষমা নেই। ব্যাগ থেকে ব্লেজারটিকে বের করে শরীরে জড়ানোর মত বিরাট কাজ আমার মত অলসের কর্ম নহে! এরপর কোনরকম তারিফের রুমে পৌঁছেই লেপের নিচে শুয়ে পড়লাম! তারিফ সাহেব বললেন, ‘অন্তত কাপড়টা চেঞ্জ কর!’
- রাখ তোর কাপড় চেঞ্জ! শীতে জীবন যায় আর তুই আছিস কাপড় নিয়ে। 
এরপর এক ঘুমে অর্ধদিবস খতম!


শেষবিকালে তারিফের সাথে দিনাজপুর শহরে পা রাখলাম। বড়মাঠের বিশাল রূপ দেখে আমি সেখানেই অস্থায়ীভাবে শিকড় গাড়লাম। বড়মাঠের রূপে মুগ্ধ হয়ে আর কোথাও ঘুরবার কথা প্রায় ভুলেই গেলাম। ভুলে গেলাম বললে ভুল হবে; আসলে সেসব কোনটাই দেখার ইচ্ছে আমার কোন কালেই ছিল না আগামীতেও হবে বলে মনে হয় না। আমি দেখি সৌন্দর্য! অন্তঃনিহিত সৌন্দর্য!


হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়টির আয়তন অতিকায় বিরাট না হলেও একদমই ছোট নাহ! কিন্তু যতোটুকুই হোক বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে শুধু গাছ আর গাছ। মাঝরাতে জ্যোৎস্না গাছগুলোর সাথে আলোআধারির খেলা খেলে। আমি এই আলোআধারির খেলার একজন নীরব দর্শক!


বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসীমান্তে ছোট্ট একটি পুকুর আছে। সানবাঁধানো পুকুর। ফেরার আগের রাতে, ভরা জ্যোৎস্নায় সেই সানবাঁধানো পুকুর ঘাটে গেলাম। তখন প্রায় রাত ২টা। তারিফ সাহেব তার আগেই ঘুমে বেহুশ। একলা হাটছি। পুকুরের পাড়টাতে ঘন অন্ধকার। পুকুরপাড়ের গাছগুলোর পাতাকে ভেদ করে চাঁদের আলো পুকুর পাড়টিকে আলোকিত করতে পারছে না। কেমন জানি একটা ভুতুড়ে পরিবেশ!


এরই মাঝে কে যেন একজন হেলতে দুলতে এপথেই হেটে আসছে! কিছুদূর আসার পর সে থমকে দাঁড়াল। হয়তো আমাকে দেখেই সে দাঁড়িয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করল, ‘কে? কে ওখানে?’
‘আশরাফুল মাখলুকাত মানে আমি মানুষ। ভয় নাই চলে আসেন।’
সে এসেই বলল, ‘নাম কি? কোন ব্যাচ? কোন হলে থাকো?’
আমি নীরব! 
সে আরো কাছে আসল। তাকে বললাম, ‘ভাইসাহেব, আমি আপনার ভার্সিটির কেউ না। তার মানে আমার উপর খবরদ্দারিও করতে পারবেন না। তাই এতোসব জেনে আপনার কাজ নাই। তার চেয়ে আসেন পুকুর পাড়ে বসি দু’টা সুখ দুঃখের গল্প করি’!


ভেবেছিলাম, এই কথা শুনে হয়তো সে বিদায় হবে। কিন্তু সে উল্টো পুকুর পাড়ে বসে পড়ল। ভদ্র সুরে বলল, ‘আপনার ঠিকানা কই?’
কবর। এইযে মানুষ এতো ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে, কেন বলুন তো? কবরে যাবার জন্য! তাই আমারও ঠিকানা কবর।
সে চট করে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি পাগল?’
তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘আমাকে দেখে আপনার সুখী মনে হচ্ছে নাকি দুঃখী মনে হচ্ছে!’
মনে তো হচ্ছে সুখী মানুষ।
তখন বললাম, ‘তাহলে আমি পাগল!’


সে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। বললাম, ‘আপনার পকেটে কি সিগারেট আছে?’
‘জ্বি আছে।’
সে বলল, ‘খাবেন?’
বললাম, ‘বিরাট আফসোসের কথা কি জানেন ভাই, সিগারেট খাওয়াটা শিখতে পারি নাই।’
তাহলে?
জ্যোৎস্না রাতে জলন্ত সিগারেট হাতে কাউকে দেখতে কখনো কখনো ভালো লাগে, তাই। সে সিগারেট ধরাতে লাগল।
তাকে বললাম, আমি পাগল কেন জানেন?
কারণ, আমি জগতের সকল চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে আপন ভুবনে বিচরন করতে পারছি। যেমন, আমার উচিত জীবন নিয়ে চিন্তা করা। বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করা। কিন্তু সেসব চিন্তার একটি চিন্তাও আমার ভিতরে নাই। যেমন চলতেছে চলুক গে! আমি চলব আমার গতিতে। তাই আমি পাগল আর আমিই সুখী!


এভাবে কেটে গেল অনেক সময়। হয়তো আর কিছু সময় পরই ফজরের আযান হবে। কিন্তু সেই ছেলেটির ঘরে ফেরবার কোন লক্ষণ দেখছি না। একনাগাড়ে বকবক করতে করতে গালগুলো প্রায় ব্যাথা হয়ে গেছে। সাধারণত জ্যোৎস্নার রাতগুলোতে মনটা বেশি ভালো থাকে আর মন ভালো থাকা মানেই বকবক! তাকে বললাম, আজ উঠি! আপনার সঙ্গে আর কখনো দেখা হবার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ আজই হয়তো আমি চলে যাবো।


এরপর আমি হলের দিকে হাটা শুরু করলাম। সে পিছন থেকে বলল, ‘শুনুন! আপনার নামও আমি জানি না। জানতেও চাই না। কিন্তু গত তিন ঘন্টা আপনার সঙ্গে কাটানো সময়টা ছিল বিভ্রান্তিকর সময়। কিন্তু তারপরও বলি, এই তিন ঘন্টা কাটানোর পর আমার মনে হল, আমি যদি মেয়ে হতাম তবে অবশ্যই আপনার প্রেমে পড়তাম। কিন্তু কখনো বিবাহ করতাম না। কারণ পাগল মানুষের সাথে প্রেম করতে বিরাট মজা আর বিবাহ করলে জীবনটাই তেজপাতা’!


আমি হাসলাম! হাহাহা করে হাসলাম। বিদায় বেলায় বললাম, ‘আপনার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট! ক্যারিয়ার নিয়ে এত্তো বেশি চিন্তা করবেন না। রিযকের মালিক আল্লাহপাক। চিন্তাগুলোকে একটু পাশ কাটানোর চেষ্টা করুন আর কিঞ্চিত পাগল হবার চেষ্টা করুন। দেখবেন, আপনিও সুখী মানুষ হতে পারবেন।’

পঠিত : ৮৯২ বার

মন্তব্য: ০