Alapon

নেপালের রাজপরিবরা হত্যাকান্ড এবং কিছু কথা...



২০০১ সালের ১ জুন রাত এগারোটার কথা। তখন বাংলাদেশে একুশে টিভির রাতের খবরের একটা আলাদা জনপ্রিয়তা। সেদিন আবার খবর পাঠ করছিলেন সামিয়া জামান- যিনি সম্ভবত এখনো বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদ পাঠিকা। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, সেদিন নিয়মমাফিক শিরোনাম পড়ে সামিয়া জামান হঠাৎ বলতে শুরু করলেন, "এইমাত্র পাওয়া খবরে জানা যাচ্ছে, কিছুক্ষণ আগে বাংলাদেশের বন্ধু, নেপালের রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ কাঠমান্ডুর নারায়ণহিতি প্রাসাদে এক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। আততায়ীর গুলিতে তিনি, রাণী ঐশ্বর্য সহ রাজপরিবারের আরো অনেকে হতাহত হয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে।"

রাজা বীরেন্দ্রকে একজন ভালো মানুষ বলেই জানতাম। সামিয়া জামানের মুখে তাঁর হত্যার খবর শুনে মনে পড়লো, একবার পত্রিকায় পড়েছিলাম, নেপালে কোন স্টেট ফাংশনের সময় বাংলাদেশের কোন একজন রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের সাথে তাঁর যে আসন নির্দিষ্ট করা হয়েছিলো, তা ছিলো বাংলাদেশের মেহমানের চেয়ারের চেয়ে উঁচু। তিনি তৎক্ষণাৎ নিজের চেয়ার বদলে ফেলে সমান উচ্চতার চেয়ার দেয়ার আদেশ দিয়ে যা বলেছিলেন, তা অনেকটা এমন, 'আমি রাজা ত্রিভূবনের পৌত্র এবং রাজা মহেন্দ্রর পুত্র হিসেবে এখানে এসেছি। আর এই মেহমান এসেছেন একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত দেশের নেতা হিসেবে। তাঁর পাশে আমি তাঁর চেয়ে উঁচু চেয়ার নিয়ে বসতে পারিনা।'

যাহোক, রাজা বীরেন্দ্রর হত্যাকাণ্ড আমাকে সত্যিই ব্যথিত করেছিলো। আমি ভাবতে পারছিলাম না, সজ্জন এই মানুষটি কার কি ক্ষতি করলেন!

পরবর্তীতে বাংলা সিনেমার প্রেমের কাহিনীর মতো এক ব্যর্থ প্রেমের গল্প সামনে আনা হয়। বলা হয়, ২৯ বছর বয়সী যুবরাজ দীপেন্দ্রই এই হত্যাকাণ্ড ঘটান। দীপেন্দ্র পরিবারকে হত্যা করে নিজেও নিজের মাথায় রাইফেল দিয়ে শুট করেন এবং তিনদিন কোমায় থাকার পর মারা যান।

প্রায় ২০ বছর আগে নারায়ণহিতি রাজপ্রাসাদে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ডে রাজা বীরেন্দ্রর পুরো পরিবার, তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা ধীরেন্দ্র সহ রাজপরিবারের দশ সদস্য মারা যান। ফলে রাজা মহেন্দ্রর তিন ছেলের মধ্যে একমাত্র জীবিত ছেলে হিসেবে জ্ঞানেন্দ্র ও তাঁর আওলাদ আসহাব ছাড়া সিংহাসনে বসতে সক্ষম আর কারো নামনিশানা রইলো না।

২০০১ সালের ১ জুনের এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে প্রচলিত তত্ত্বকে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনি। এই ধারণা থেকেই যায় যে, নেপালের রাজপরিবারের মূল শাখাকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিলুপ্ত করা হয়েছে।

এরপর রাজা জ্ঞানেন্দ্র কষ্টেসৃষ্টে আরো সাত বছর সিংহাসনে থাকার পর নেপালে রাজতন্ত্রই বিলুপ্ত হয়।

এরপর নেপালে একের পর এক ঘটনা ঘটতেই থাকে। সদ্য প্রজাতন্ত্রে পরিণত হওয়া নেপালের নির্বাহী ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রীর পদ মিউজিকাল চেয়ারে পরিণত হয়। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৯ জন প্রধানমন্ত্রী আসাযাওয়ার মধ্যে থাকেন।

২০১৮ সালে খড়গ প্রসাদ শর্মা অলি প্রধানমন্ত্রী হবার পর তিনি দ্রুত ক্ষমতা সংহত করার পথে এগুতে থাকেন। হিমালয়ের অপর পাড়ের পরাক্রমশালী ড্রাগনের ছত্রছায়ায় নেপাল গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে ভারতের সাথে থাকা অধীনতামূলক মিত্রতা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে। এর অংশ হিসেবে সংবিধান সংশোধন করে ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা দাবী করা, রামের জন্মস্থল নেপালে অবস্থিত বলে ক্লেইম করা থেকে শুরু করে এভারেস্টের উচ্চতা নতুন করে মেপে তার উপর নৈতিক অধিকার আরো প্রকট করার মতো উদ্যোগ নিয়েছে। শেষের উদ্যোগ নেয়ার কারণ, এভারেস্টের উচ্চতা মেপেছিলেন ব্রিটিশ ভারতীয় সার্ভেয়ার রাধানাথ শিকদার। এভারেস্টের কথা এলেই তাঁর কথাও আসে, আসে ভারতের প্রসঙ্গও।

এরই ধারাবাহিকায় নেপাল ২০০১ সালের রাজকীয় হত্যাকাণ্ডের বন্ধ কেস পুনরায় ওপেন করবে কি? নেপালী কমিউনিস্ট পার্টির আরেক বড় নেতা প্রচণ্ড একবার খোলাখুলিই সপরিবারে রাজা বীরেন্দ্রর হত্যার পেছনে দুটি গোয়েন্দা সংস্থার জড়িত থাকার অভিযোগ করেছিলেন।

সময়ই বলবে, নেপাল এই হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত করে ভারতকে আরেকটু বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করে কিনা...!

©️ ইমরান চৌধুরী

পঠিত : ৫৯৮ বার

মন্তব্য: ০