Alapon

সিনেমা দেখে কি ইতিহাস শেখা যায়...?



মীর নিসার আলী তিতুমীরের ছবি সম্বলিত, বাংলাদেশ সরকারের একটি ডাকটিকেট আছে। দেশের মানুষ ডাকটিকেটের সাথে অত পরিচিত নয়, যতটা পরিচয় আছে প্রবাসীদের ক্ষেত্রে। এক দাওয়াতে প্রশ্ন উঠে এই তিতুমীর টা কে? স্কুলের ছাত্ররা কম-বেশী তিতুমীর সম্পর্কে জানে। কিন্তু এখানকার একজন প্রবীণও তিতুমীর সম্পর্কে জানেনা দেখে আশ্চর্য লাগল। আমাকে অনুরোধ করা হল, একটু জানাতে। এই কথায় পরে ফিরে আসব, তার আগে চলুন সিনেমা দেখে ইতিহাস শেখার কিছু উপাদানের সাথে পরিচিত হই।

সিনেমা দেখে ইতিহাস শেখার আরেক অর্থ হল, ইতিহাসকে ঝাড়ু পেটা করার নামান্তর! সিনেমা বানানোর আগে প্রযোজক তার লগ্নিকৃত অর্থ কমপক্ষে দ্বিগুণ, ত্রিগুণ করার লক্ষ্য নিয়েই এ কাজে হাত দেয়। ফলে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে আকৃষ্ট করতে, সে সব সিনেমায় নিজেদের ইচ্ছামত কাহিনী ঢুকিয়ে দেয়। ইতিহাস জাহান্নামে যাক কিন্তু প্রযোজকের টাকাটা যেন জাহান্নামে না যায় সেটাই প্রযোজকের মুখ্য বিষয় থাকে।

বিষয়টি বুঝার জন্য বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম পরিচিত গ্রন্থ 'আলিফ লায়লা' কিংবা 'সিন্দাবাদ' এর ঘটনা সমৃদ্ধ বইগুলো পড়া যেতে পারে। এসব পড়ার পরে কয়েকটি টিভি সিরিয়াল দেখলেই বুঝা যাবে, ইতিহাসের উপর কত বড় নির্যাতন করা হয়েছে! ইতিহাসের কাহিনী নির্ভর সিনেমা বানাবে বলে, মোগল আজম ছবি তৈরি হয়েছিল বহু কোটি রূপি ব্যয়ে। ফাইনালি পুরোটাই যেন পান্তা ভাবে ঘি মেশানোর কসরত চলেছে। আবার এক ঘটনার ইতিহাস দু'ভাবে উপস্থাপিতও হতেও দেখা গেছে। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খান খুনি কিন্তু পাকিস্তানে সম্মানিত! পানি পথের যুদ্ধের বিবরণ সমৃদ্ধ 'আবদালী' কিংবা জেরুজালেম বিজয়ী 'সালাউদ্দীন আইয়্যুবী' কে নিয়েও ইতিহাস নির্ভর নাটকের পরিণতি এমনটি হয়েছে।

ইতিহাস জানার জন্য কখনও সিনেমা থেকে উপাত্ত নেওয়া ঠিক নয়। ইতিহাস পড়তে হয়, ইতিহাসের পাতা থেকেই। ব্যক্তি জীবনে আমি, অন্য পড়ার সাথে সাথে দৈনিক এক পৃষ্ঠা হলেও ধর্মীয়, দর্শন ও ইতিহাস পড়ার চেষ্টা করি। তাই সিনেমার আবাল পনা সহজে ধরা পড়ে, যা আমার উপকারে আসে।

এটা অস্বীকার উপায় নেই যে, ইতিহাসের বহু বই পড়ে মনের উপর যতটুকু প্রভাব সৃষ্টি করা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশী প্রভাব সৃষ্টি হয় সিনেমার মাধ্যমে। এটার একটা দর্শন আছে। মানুষ শোনার মাধ্যমে অর্জন করে অন্যের অভিজ্ঞতা। বই পড়াটাও, শোনার বিষয়ের একই কাতারে। বিশ্বাস হতেও পারে না হতেও পারে। অন্যদিকে চোখের মাধ্যমে অর্জন করার দক্ষতা নিজের অভিজ্ঞতা হিসেবে বিবেচিত হয়। এটা মানুষের অবিশ্বাস হয় না। তাই সিনেমার ছবি, ঘটনা মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব পড়ে।

চোখে দেখার প্রভাব কতটুকু বেশী সেটা তো আমরা বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের মোবাইল প্রীতি দেখেই বুঝতে পারি। অনেক টাকা খরচ করে পাঠশালায় শিক্ষকদের পড়া মুখস্থ হয় না কিন্তু ইউটিউবের গান সহজেই মুখস্থ হয়ে যায়। মূলত কাগজ-কলমের প্রচারণার চাইতে, চলচ্চিত্র মাধ্যম সংক্ষিপ্ত সময়ে বেশী প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। সে কারণে সিনেমার ভুল ইতিহাসকেও দর্শক সঠিক বলে মনে করে।

তিতুমীরের ঘটনায় ফিরে আসি। তিতুমীরের দুটো সাইড আছে একটি ধর্মীয়, অন্যটি ব্রিটিশ বিদ্রোহী বিপ্লবী হিসেবে। আমি ভাবছি উপস্থিত মিশ্রিত মানুষের কাছে তিতুমীরের কোন সাইডটি কে প্রাধান্য দিয়ে, কথা শুরু করব! ভাবলাম ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলন দিয়েই শুরু করি।

উপস্থিত দুই একজনের কাছে আমার উপস্থাপনাটি খুব ভাল লাগল মনে হল। তাদের মধ্যে একজনের উত্তেজনা বেড়ে গেল! তিনি আমার কথা কেড়ে নিয়ে বলল, "আপনার কথা বিলকুল ঠিক আছে। হিন্দি সিনেমার নায়ক, রাজেশ খান্না একটি ছবিতে বহু ব্রিটিশকে মেরে-পিটে দেশ থেকে, বের করে দিতে দেখেছি! তখন কিন্তু ছবিটির মর্ম বুঝি নাই, আজকেই বুঝলাম!" উপস্থিত বাকি তিনজন তার সাথে কথায় সায় দিয়ে, নতুন আলোচনায় মেতে উঠল! রাজেশ খান্না কিভাবে, গুলি করে, বোমা ফাটিয়ে, উড়ন্ত লাথি মেরে ব্রিটিশদের ভারত থেকে তাড়িয়ে দিল, সেটাই হয়ে উঠল তাদের বিবেচ্য বিষয়!

এসব মানুষ গুলো রাতদিন হিন্দি সিনেমায় বুঁদ হয়ে থাকে। তাদের উপায়, উপকরণ, জীবন, জিজ্ঞাসা এমনটি জীবন চলায় উদাহরণটা পর্যন্ত সিনেমা থেকেই সংগ্রহ করা। নিজের উপর গোস্বা এলো, এই ভেবে যে, এতগুলো শিক্ষিত মূর্খদের মাঝে, এই বিষয়ে কথা না বলাটা উত্তম ছিল। এদের মগজে এমনভাবে পচন ধরেছে, ভাল কথা শুরু করতে গেলেও উত্তম-ভাবে পবিত্র করাটা জরুরী! ততক্ষণে রাজেশ খান্নার আলোচনা শেষ হয়েছে। ইতিহাসের খ্যাতিমান, বীর বাহাদুর এই ব্যক্তিকে আমি চিনিনা, কখনও দেখিনি। তবে সম্বিৎ ফিরে পেলাম তাদের নতুন প্রশ্ন শুনে।

তাদের একজন আবারো প্রশ্ন করল, "আচ্ছা ছবিতে দেখলাম গান্ডু ব্রিটিশদের ওভাবে পিটিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে কিন্তু তাদের দোষটা কি ছিল? মাথায় হাত দিলাম! তাহলে তারা কি দেখেছে, কি শিখেছে? প্রমাণিত হল, এভাবেই ওরা ইতিহাসের বিদ্যা অর্জন করেছে! তাহলে বাংলাদের সরকারের পাঠ্যপুস্তক পড়ে তারা কি শিখেছিল, এ প্রশ্ন রয়েই যায়।

- tipu

পঠিত : ১৩১০ বার

মন্তব্য: ০