Alapon

মেঘের আড়ালে রোদ

এই যে করোনা হলো, করোনার এই কঠিনতম সময়ে কষ্ঠের কষাঘাত আমাদের হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে একাকার করলেও বিরাজমান পরিস্থিতি থেকে কিছু পজিটিভ বিষয়ও পর্যালোচনা করা যায়। কংক্রিটের দেয়ালে আবদ্ধ থেকে বড় হওয়া ছেলেমেয়েরা খুঁজে পেয়েছে তাদের জীবনের কিছুটা সময়জুড়ে এক নতুন দুনিয়ার স্বাদ। অবসরে তারা গ্রামীণ আবহে নিজেকে আবিস্কার করেছে নতুন রূপে। প্রকৃতিতে তারা যেন এই সত্যটাই এতদিন খুঁজে চলেছে মনের অজান্তে। সকালের হাসিমাখা সূর্যের মিষ্টি আলো, দুপুরের তেজোময়ী রোদের তুমুল তাপ, সন্ধ্যার পর চাঁদের মায়াবী কিরণ; সব মিলিয়ে তারা আত্নার এক অনিন্দ্য চপলতা পেয়েছে।


এমন একটা দুনিয়ার দ্যাখা তারা পেলো, যেখানে যান্ত্রিক বাতাস নয় প্রকৃতির সুশীতল বাতাস আছে। গাছে গাছে সবুজ আছে। পত্র-পল্লবে সুশোভিত সবুজের সমারোহ আছে। ছাঁয়া আছে মায়া আছে। যে আলো বাতাস দেখে মুখরিত হতো দুর্বা সবুজের মাঠ। সেসব দেখে দেখেই তো আমাদের আমাদের পূর্বপুরুষরা বড় হয়েছে। যা পায় নি বা দেখেনি এই শতাব্দীর কিংবা এই কয়েক দশকের ছেলেপেলের, কিশোর-তরুণদের। কিন্তু যেহেতু বৈশ্বিক এক মহামারী করোনা এসেছে তাই অনেকে না চাইতেও গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছে, সেখানে হিজল বনে পালিয়ে যাওয়া পাখির পাল দেখেছে, বহতা নদীর বয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখেছে। নিঃসন্দেহে এসব তাদের মন-মননে নতুন এক প্রশান্তির, এক অনন্য উৎফুল্লতার জন্ম দিয়েছেন। যা সবার মানসিক বিকাশে একটা অনবদ্য ভূমিকা হিশেবে কাজ করবে।

তাদের জীবনে ছিলো স্কুল-কোচিং-টিউটরের টর্নেডো। সর্বোচ্চ বিনোদন ছিলো টিভি মোবাইল ফেসবুক ইউটিউব আরেকটু বেশি ভাবনা যাদের কিংবা রোমান্টিক যারা তাদের জীবন ছিলো, তাদের বিনোদন ছিলো তাদের ক্লাসের সবচেয়ে সেরা সুন্দরী যে তার জন্য একটা টুকটুকে গাঢ়ো লাল গোলাপ নিয়ে তাকে প্রপোজ করা। তার সেই প্রপোজের যারা রাজি হতো তাদের মনে বয়ে যেতো আনন্দের বন্যা, সাময়িক সময়ের জন্য। সেই আনন্দের ভাগাভাগি হতো ফুচকার দোকানে, চটপটির বাটিতে। পার্কের আড়ালে। রেস্তোরাঁর টেবিলে। অতঃপর কিছু বিষয়ের জন্য মনোমালিন্য। সেই মনোমালিন্য থেকে দেখা গেছে তাদের যে রঙ্গিন স্বপ্ন রঙিন রিলেশন তা শেষ হয়ে যেতো, ভেঙ্গে যেতো। সাথে সাথে তাকে গ্রাস করে ফেলতো হতাশা। ফলে সে নিজের জীবনকে, সৃষ্টির বিশালতাকে নিয়ে ভাবার সুযোগ পায়নি, পাচ্ছে না এবং ভাবেও না। ততোটুকুন ছাড়া ভাবতেও পারে না যতটুকু সিনেমা নাটক গল্প-উপন্যাসে পড়েছে, পড়েছে।

অথচ এই যে ফেসবুক ইউটিউব সিনেমা-নাটক প্রচলিত গল্প উপন্যাস --এগুলো মানুষের নীতি-নৈতিকতাকে সমৃদ্ধ করে না, আচার-আচরণকে উন্নত করে না। করতে সাহায্যও অতোটা করে না। মানুষকে হারামের মাঝে উস্কে দেয় অযাচিত কর্মে বিভোর করে ফেলে, করে রাখে। ফলাফল হলো সে পৃথিবীর সুন্দর সুন্দর বেঁচে থাকার উপাদানগুলো, মন ভাল করার যে মাধ্যমগুলো আছে সে-সব সম্পর্কে উদাসীন। কথিত ক্যারিয়ার গড়ার নেশা জীবন গড়ার মন্ত্র তাকে সমাজবিচ্ছিন্ন জগত বিচ্ছিন্ন বাস্তবতা বিচ্ছিন্ন একজন যান্ত্রিক মানুষ হিশেবে তৈরি করে, করে ফেলছে। সে শতো দুঃখেও হাসতে শিখে নি, হাজারো কষ্টের মাঝেও আলহামদুলিল্লাহ বলে রব্বুল আলামীনের দরবারে সিজদাহ্য় নতো হতে শেখেনি। তাঁর কাছে নিজের না-চাওয়া বিষয়গুলো পাওয়ার জন্য মুনাজাত করতে শেখেনি। অবাঞ্চিত হতাশাগুলোকে বিসর্জন দিতে শিখেনি। জীবনের মানে বুঝতে শিখেনি। পৃথিবীর এত রূপ এত রঙ দেখতে শেখেনি, পারেনি। আচ্ছা যাই হোক, বস্তুতান্ত্রিক জীবন, শিক্ষাব্যবস্থা তাদের সেরকমই করে দিয়েছে। সে কথাবার্তা পরে। তো ফিরে আসি আসোল কথায়,

আমাদের এলাকায় এবং সবার এলাকায় অসংখ্যসব শহুরে কিশোর-তরুণ --যারা এবার গ্রামের দুষ্টু ছেলেদের সাথে গাছের মগডালে থেকে নদীতে কিংবা পুকুরে লাফিয়ে পড়ার জন্য একসাথে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। নদীর স্বচ্ছ জলে সাঁতার কাটার চেষ্টা করেছে। অপরূপ সবুজের হাতছানিতে, সবুজের সমারোহে শেষ বিকেলে হারিয়ে গেছে। বৃষ্টিদিনে কাদা মেখে গড়াগড়ি করতে দেখেছে, সোঁদা গন্ধ উপভোগ করতে পেরেছে। লিচুর থোকায় ঢিল ছুড়ছে। লাফিয়ে লাফিয়ে আমের আঁটি পড়ে আম খেয়েছে। এককথায় ভিন্ন একটা দুনিয়া দীর্ঘদিন হতে কাছ থেকে দ্যাখার সুযোগ পেয়েছে।

পৃথিবীতে করোনা এসে আরো কিছু মানুষের সুস্পষ্ট স্বরূপ তুলে ধরেছে। কিছু নির্মম নিষ্ঠুরতম মানুষদের ঘটনা দেখা গেছে যেমন, তেমনি আবার কিছু মানুষদের অতিমানবিক আচরণ, দয়া-বদান্যতা, উদারতা, সৃষ্টির প্রতি সহনশীলতা-সম্প্রীতির অনেক উঁচু মানের নজিরও আমরা দেখেছি। অনেক মানুষকে জীবনবোধ ও বাস্তবতা মানতে শিখিয়েছে, অনেক মানুষের সুপ্ত মননশীলতা, মানবতা বিকশিত করেছে। যাঁরা দ্বীন-ধর্মের ধরা-ছোঁয়ার বাহিরে ছিলো সেরকম অনেকেই ফিরে এসেছে দ্বীনুল ইসলামের শীতল ছাঁয়ায়। বিলিয়ে দিয়েছে রব্বুল আলামিনের কাছে নতমস্তকে আনুগত্যের শির।

সেজন্যই বলি যে বিষয়টা, তা হলো মেঘের আড়ালে সবসময় বৃষ্টি থাকে না, মেঘের আড়ালে রোদও থাকে। হুবহু এমনই একটা কথা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা'লা বলেছেন, "নিশ্চয়ই কষ্টের পরে স্বস্তি আছে"-(সুরা ইনশিরাহ-০৫)

পঠিত : ৬৭৩ বার

মন্তব্য: ০