Alapon

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং কিছু কথা...


এক.
তোমরা এইচএসসিতে অটো পাশ নিয়ে যখন হাসাহাসি করো, আমি তখন হাসাহাসি করি শিক্ষা নিয়ে।
কারন এই শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড নয়, জাতির অভিশাপ।
পাশ করতে দিলে কি করতে?

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে লাইন দিতে সহমত ভাই হবার জন্য, এই তো৷
এইসব বিশ্ববিদ্যালয় একেকটা কাপুরুষ তৈরির কারখানায় পরিনত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে এমন একেকটা প্রতিষ্ঠান যেগুলো কলেজ লেভেলের তাজা টাটকা প্রতিবাদী রক্ত নিয়ে আসা মেধাবী ছেলেমেয়েদেরকে ভোতা, কুটিল আর চাটুকারিতার প্রশিক্ষণ দেয়, যাতে তাদের দিয়ে একটা আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষমতা কাঠামোকে টিকিয়ে রাখা যায়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, শিক্ষাই শক্তি নয়, বরঞ্চ শিক্ষাই ভন্ডামি।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে শিক্ষা দেয়া হয় তা মূলত অন্যায়কে সহ্য করা ও অন্যায়কে মেনে নেয়ার শিক্ষা। এই শিক্ষাব্যবস্থা আবরার ফাহাদ তৈরি করে না, এটা তৈরি করে অমিত সাহাদের, এবং আবরারদের এই শিক্ষাব্যবস্থা বলে অমিত সাহাদের দাসত্ব মেনে নিতে।

তাই, অটো পাশ দেয়ায় শিক্ষা নিয়ে হাহাকার করার কোন মানে নাই। সামগ্রিক শিক্ষা বহু আগেই বলদীকরন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশকে বলদের উৎপাদনকেন্দ্রে পরিনত করেছে, যে বলদদের দিয়ে হাল চাষ করিয়ে ঘি খায় দুর্বৃত্তের দল।
অটো পাশ না দিলেও এই চিত্র বদলাতো না।

দুই.

বাংলাদেশে ধর্ষনের প্রধানতম কারন বিচারহীনতা এবং সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের কোন প্রকার রক্ষাকবচ না থাকা। বাংলাদেশে যেকোন সময়ের চেয়ে ধর্ষন এখন বেশি হিংস্র ও নগ্নভাবে হওয়ার কারন, বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক ক্ষমতার কোন ভারসাম্য নাই। সবচেয়ে বড় বিপদ, সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে আছে একদল লোলুপ জানোয়ারের হাতে, যাদের প্রধান নিজেকে রিযিকদাতা, পালনকর্তা, জান লেনেওয়ালা ও দেনেওয়ালা মনে করে, ফলে সে জনগনের বুকের ওপর মিথ্যা খোদা হয়ে বসে আছে।

তার ওপর, দেশে টিকে আছে এক মান্ধাতার আমলের কলোনিয়াল বিচারব্যবস্থা, যা তৈরি হয়েছে মূলত ব্রিটিশ আমলের জমিদারীব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য, প্রজা নিপীড়নের জন্য। কোন প্রকার মেজর চেঞ্জ ছাড়াই দেশের বাদামী বাবুরা এই বিচারব্যবস্থাকে গ্রহন করে নিয়েছে৷ ফলে, বিচারের নামে যা হচ্ছে তা হল প্রজা নিপীড়ন। গরীবের যাওয়ার কোন জায়গা নাই, এমনকি মধ্যবিত্তের যাওয়ারও কোন জায়গা নাই।

সমস্ত হায়ারার্কি পার হয়ে বসে আছে এক গোপাল ভাড়, যার কাজ সমাবর্তনে গিয়ে লোক হাসানো আর দলীয় খুনীদের সাজা মাফ করানো।

এই পরিস্থিতিতে সামগ্রিক বিচারব্যবস্থা হচ্ছে একটা প্রহসন, কারন এই বিচারব্যবস্থা তৈরি হয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তার দোসর জমিদার-নীলকরদের জন্য, তাই আধুনিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আম্মোলীগ ও তাদের দোসররা ছাড়া বাকিদের এই বিচারব্যবস্থা থেকে কিছু পাওয়ার নেই।

মূলত এই কারনেই কোর্টে আবরার ফাহাদের বাবা অনিকের আইনজীবীর জেরায় হয়রান হন, আবরারের শাহাদাতের এক বছর পর, আর আবরারের বন্ধুরা একটা তুলুতুলু সেক্যুলারাইজড, হোয়াইটওয়াশড আর্কাইভ বানিয়ে তাকে স্মরন করে। এই আর্কাইভ দেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আবরার আসলে কে ছিল তা কখনোই বুঝতে পারবে না।

গণবলদীকরন প্রজেক্ট হিসাবে শিক্ষার অবদান কি, তা এই জায়গায় এসে আমরা বুঝতে পারি। একপাল বলদ যখন একটা সিংহশাবকের জীবন নিয়ে আর্কাইভ বানাবে, তখন ঐ সিংহশাবককেও তাদেরই মত বলদই মনে হবে, কারন আর্কাইভটা বলদদের বানানো।

তিন.

আবরার ফাহাদের স্মরনে যে আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভ আখতার হোসেনরা বানালো, তা ভেঙে দেয়া হল ২৪ ঘন্টার মাথায়। ভেঙে দেয়ার মাধ্যমে বুঝানো হল, আবরারের একটা ক্ষুদ্র চিহ্ণও নব্য উপনিবেশবাদী ভারতীয় দালালেরা সহ্য করতে পারে না, কারন আবরারের প্রতিটি চিহ্ণ এই যমীনে তাদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি। আবরার এই যমীনে ভারতীয় নব্য উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রথম শহীদ হিসাবে যে শহীদী তরীকা তরুণদের দেখিয়ে দিয়ে গেছে, সেই তরীকাকে দালালেরা ভয় পায়। তারা চায় না মানুষ আবরারকে ইয়াদ করুক।
কিন্তু আবরারকে মুছে দেয়া এত সহজ নয়।

আমীর আযীযের ভাষায় আমরা বলতে চাই, সাব ইয়াদ রাখা যায়ে গা, সাব কুছ ইয়াদ রাখা যায়ে গা।

এবার জেলায় জেলায় আবরার ফাহাদের নামে আগ্রাসনবিরোধী স্তম্ভ হবে। আবরার ফাহাদের নামে টি শার্ট হবে, হবে দোকান, বাজার, বই সবকিছু। আবরার ও আবরারের মত তরুণরা হবে স্বাধীনচেতা মানুষদের গ্লোবাল আইকন।

চে গুয়েভারা যদি লাতিন আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক হতে পারে তবে বুরহান ওয়ানী আর আবরার ফাহাদরা হবে দক্ষিণ এশিয়ায় উপনিবেশী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক, তাদের রক্ত হবে এই অঞ্চলের মানুষের মুক্তির সোপান, তাদের চেহারা হবে গণপ্রতিরোধের দরাজ পতাকা।

চার.

আবরার ও এইচএসসি ইস্যুতে মাতামাতির ফলে ধর্ষন থেকে ফোকাস সরে গেছে বলে মনে হয়। কিন্তু না, আসলে ব্যাপারটা তা নয়, যদি না আপনি রাজনৈতিক হয়ে থাকেন। সব রসুনের গোড়া এক জায়গাতেই। দুর্বৃত্তদের শাসন।

আপনি যখন ধর্ষনের বিরুদ্ধে বলেন, তখন আপনি আবরারের খুনীদের বিরুদ্ধেই পরোক্ষভাবে কথা বলেন, আবার যখন আবরারের খুনের ব্যাপারে প্রতিবাদ করেন, তখন পরোক্ষভাবে ধর্ষনের বিরুদ্ধেই আপনি আওয়াজ বুলন্দ করেন। কেননা, এরা আসলে একই লোক, এবং এদের রোগও একই রোগ।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেভাবে বাংলাদেশকে এককালে ধর্ষন করেছে প্রায় কাছাকাছি পন্থায় বাংলাদেশের ওপর ধর্ষন চালাচ্ছে আরেকটি রাষ্ট্র। সেই কথা বলায় আবরার ফাহাদ হয় লাশ।

ওদিকে, সেই ধর্ষকামী রাষ্ট্রটির এদেশীয় দালালেরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ধর্ষনকে লোকালাইজ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জনপদে মেয়েদের ধর্ষন করার মাধ্যমে, এবং সেই ধর্ষনকে নরমালাইজ করার জন্য তারা স্বাধীনতার চেতনার বুলি ছাড়ে।

এদের বিরুদ্ধে রাস্তাঘাটে চুম্মাচাটি করে যে প্রতিবাদ কায়েম করা হয়েছে, ঐ প্রতিবাদে এদের কিছু যায় আসে না। যতক্ষণ না আপনি লোহার বিরুদ্ধে লোহা প্রয়োগ করছেন, আপনার প্রতিবাদ অর্থহীন।

বাংলাদেশের মানুষকে তাই ধর্ষক মানুষ ও ধর্ষক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লোহার বদলে লোহা মোতায়েন করতে তৈরি হতে হবে। আপনার ঘরে যে ধর্ষক প্রবেশ করতে আসবে, তার বিরুদ্ধে কেবলমাত্র সর্বোচ্চ পর্যায়ের সংহারী আত্মরক্ষামূলক আক্রমনই এই জঙ্গের ময়দানে শিকারী ও শিকারের সংজ্ঞা বদলে দিতে পারে। এইভাবে, ধর্ষনের বিরুদ্ধে লড়াই হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার নিপীড়িত জনগনের আযাদীর লড়াই।

আত্মরক্ষা, ন্যায়বিচার ও ইনসাফের অধিকারের বাইরে যে স্বাধীনতার চেতনার ছবক আমাদের দেয়া হয়, তা মিথ্যা।

এই মিথ্যা স্বাধীনতার ছবকওয়ালাদের সামনে তাই গলার শাহরগ ফুলিয়ে আমাদের উচ্চারন করতে হবে,

জিস আযাদী মে ইনসাফ নেহি,
ও আযাদী ঝুটা হ্যায়!
ঝুটা হ্যায়, ঝুটা হ্যায়,
ও আযাদী ঝুটা হ্যায়!!

- Muhammad Sajal

পঠিত : ৩৯৮ বার

মন্তব্য: ০