Alapon

শরীয়াহ আইন মানে অন্য ধর্মের উপর ইসলামকে চাপিয়ে দেয়া নয়...



যখন শরীয়াহ আইনের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়, তখন অমুসলিমরা এবং কিছু সংখ্যক মুসলিমও প্রশ্ন তুলে থাকেন- শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠার মানেই অমুসলিমদের উপর ইসলামের বিধান চাপিয়ে দেয়া নয় কি? একজন মুসলিমকে বিশ্বাস রাখতে হবে- আল্লাহর আইনই সর্বশ্রেষ্ঠ আইন। তার যৌক্তিকতা মানুষের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক অনুধাবন করতে সক্ষম হোক কিংবা না হোক, এটাই সঠিক- এমন বিশ্বাস মুসলমানের থাকতেই হবে। তবুও কিছু যুক্তির আলোকে অমুসলিমদের উপরোক্ত প্রশ্নের যুক্তি খণ্ডন করার চেষ্টা করা যেতে পারে।

যদি হিন্দু ধর্মের সর্বোচ্চ গুরুর কাছে জানতে চাওয়া হয়- রাষ্ট্র, আইন ও সমাজ কিভাবে চলবে, এ ব্যাপারে হিন্দুধর্মে কোনো পূর্ণাঙ্গ বা স্পষ্ট নির্দেশনা আছে কিনা? গুরুজি বলবেন, “নাহ, বাবা! এ নিয়ে আমাদের ধর্মে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি।” একইভাবে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা অন্যান্য ধর্মের গুরুদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তাঁরাও একই কথা বলবেন। অর্থাৎ, রাষ্ট্রে প্রচলিত ‘যৌক্তিক যেকোনো আইন’ মেনে নিতে তাঁদের ধর্মীয় কোনো বাধা নেই। কিন্তু, মুসলমানদের ক্ষেত্রে- ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আইন কিভাবে চলবে তার পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় নির্দেশনা রয়েছে। কারণ, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। কাজেই ধর্ম পালনের স্বাধীনতার অংশ হিসেবে হলেও মুসলমানরা শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠান অধিকার রাখেন।

প্রশ্ন উঠতে পারে- মুসলমানদের সুনির্দিষ্ট কাঠামোগুলো অন্য ধর্মের মানুষ বা অবিশ্বাসীদেরকে মানতে বাধ্য করা হবে কেন? এর জবাবে বলা যায়- মুসলমানদের ধর্মীয় কোনো বিধান, যেমন- সালাত, সিয়াম ইত্যাদি পালনে অমুসলিমদেরকে কখনো বাধ্য করা হয়না। বাকি রইলো সমাজ, আইন ও রাষ্ট্র। আমাদের দেশে অনেক অসৎ জনপ্রতিনিধি চাল চুরির দায়ে ধরা পড়ে। উত্তেজিত হুজুগে জনতা তাদের ক্রসফায়ার চায়। কিন্তু, যদি ইসলামের বিধান মেনে চুরির শাস্তি বলবৎ থাকতো, তাহলে কি আজ এমন অসৎ জনপ্রতিনিধি গড়ে উঠতো? আজ যখন ধর্ষকের ফাঁসি চেয়ে সমাজ উত্তাল, সে জায়গায় ইসলাম বহু আগেই অবৈধ যৌনতাকে নিষিদ্ধ ও হারাম ঘোষণা করে কঠোরতম শাস্তির ঘোষণা দিয়েছিলো। যে বিধানকে কিছুদিন আগেও বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষ অমানবিক বলতো; অথচ আজ তারাই অবৈধ যৌনতার বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও ভাবতে শুরু করেছে। আমার দেশের অসহায়, ঋণগ্রস্থ মানুষ ঋণ নেয়ার পর মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে সুদ প্রদান করতে গিয়ে কত যে কষ্ট পোহাচ্ছে, তা আমাদের পুঁজিপতিরা দেখেন না। পুঁজিপতিরা বুলি ছুঁড়েন- সুদ নিষিদ্ধ করায় ইসলামি অর্থনীতি উন্নতি লাভ করেনা।

আমার দেশের গরিবের পেটে লাথি মেরে এই সুদভিত্তিক অর্থনীতি সত্যিই কি দেশকে উন্নত করতে পারবে? এভাবে ইসলামের প্রতিটি আইনকেই সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য যৌক্তিক হিসেবে প্রমাণ করা যায়। এই যৌক্তিক আইনগুলো কার্যকর করা হলে তা ‘অমুসলমিদের উপর ইসলামকে চাপিয়ে দেয়া’ কোনো যুক্তিতেই বলা চলেনা। বরং বলতে হয়, কোনো ধর্ম বা বিশ্বাস যখন সমাজ, রাষ্ট্র ও আইন নিয়ে সুস্পষ্ট, ত্রুটিমুক্ত ও পূর্ণাঙ্গ বিধান দেয়নি বা দিতে পারেনি, ইসলাম সেখানে যৌক্তিক ও সাম্যের আইন প্রদানের মাধ্যমে আমাদের স্বস্তি দিয়েছে।

ইসলাম ও এর আইন আল্লাহ প্রদত্ত। আর আল্লাহই বলেছেন, “তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশ অবিশ্বাস কর? যারা এমন করে পার্থিব জীবনে দুর্গতি ছাড়া তাদের আর কোন পথই নেই। কিয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শাস্তির দিকে পৌঁছে দেয়া হবে।” (সূরা বাকারা, আয়াত: ৮৫)। তাই মুসলিমগণ কেবল শরীয়াহ আইনই মানবেন বা সমর্থন করবেন। অমুসলিমগণের যেহেতু সমাজ, আইন ও রাষ্ট্রের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই, সেহেতু প্রচলিত যৌক্তিক যেকোনো আইনই তাঁরা মানতে পারবেন। দেখা যায়, শরীয়াহ আইন সমাজের মূল সমস্যাগুলোর সঠিক সমাধান বহু আগেই দিয়ে রেখেছে, যার কোনো ত্রুটি এ পর্যন্ত ধরা পড়েনি। অন্যদিকে, মানবসৃষ্ট আইনে ব্যভিচারের দায়ে নারীর শাস্তি হয়না, সুদকে প্রশ্রয় দেয়া হয়, শর্তসাপেক্ষে মাদককে প্রশ্রয় দেয়া হয়। তাহলে অমুসলিমদের জন্য কোন আইনটি কল্যাণকর, তা সহজেই অনুমেয়।

যে দেশে অমুসলিমের সংখ্যা অনেক বেশি, সে দেশে ইসলামের বিধান কার্যকর না থাকলে অবাক হওয়ার কিছু থাকেনা। কিন্তু, যে দেশে সিংহভাগ মানুষ মুসলমান, সে দেশে মুসলমানরাই ধর্মের বিধান মানেন না বা মানতে পারছেন না। এর দায় কার? স্বার্থান্বেষী মহল ছাড়াও এ দায় সকল মুসলিমের। আল্লাহর বিধানবিরোধী বিশ্বাস কিভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো? তার জন্য সেক্যুলারিজম বা লা’দিনিয়্যাহ এর ইতিহাস জানতে হবে।
সেক্যুলারিজমের মূল লক্ষ্যই ছিলো ধর্মহীনতা চাষ। এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- Rejects all forms of religious faith.অর্থাৎ, এ দর্শন সকল প্রকার ধর্মবিশ্বাসকে নাকচ করে দেয়। Encyclopedia of Britanica তে বলা হয়েছে যে, যারা কোন ধর্মের অন্তর্গত নয়, কোন ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত নয়, কোন ধর্মে বিশ্বাসী নয় এবং আধ্যাত্মিকতা, জবাবদিহিতা ও পবিত্রতা বিরোধী, তাদেরকেই বলা হয় ধর্মনিরপেক্ষ। Oxford dictonary -এর মতে, স্রষ্টায় বিশ্বাস বা পরকালে বিশ্বাস ত্যাগ করে মানব জাতির বর্তমান কল্যাণ চিন্তার ওপর ভিত্তি করে নৈতিকতা গড়ে উঠবে। কিন্তু এসব সংজ্ঞা বা চিন্তাধারা মুসলমানদের সহজে প্রলুব্ধ করতে পারেনি। তাই বুলি পাল্টিয়ে শোনোনো হয়-সকল ধর্মকে সমান চোখে দেখা হবে, সবার অধিকার সমান, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মকে তথা ইসলামকে রাখা হবেনা। (অন্য ধর্মে রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে কিছু বলা হয়নি।) ব্যস, পূর্বের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞাকে ঢেকে দিয়ে উপরের এই নীতিকথাগুলো অনেক মুসলিমকেই বিচ্যুত করেছে। তখন থেকেই লা’দিনিয়্যাহ বিস্তৃতি লাভ করে। কিন্তু, আড়ালে লুকিয়ে থাকা দুর্ভিসন্ধি অনেক মুসলিমই অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন।

এর প্রতিকারও ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিতেই করতে হবে, কোনোরূপ ভুল ধারণা কাজ করলে তা জঙ্গিবাদ হিসেবে গণ্য হবে, যা ইসলাম বিরোধী। কেউ যদি রাতারাতি অস্ত্রের মুখে কিংবা জোর করে দেশে ইসলামের আইন প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে চান, নিজের মতকে চাপিয়ে দিতে চান, তাহলে সেটা জঙ্গিবাদ হবে বলেই আমার ধারণা। কারণ, রাসুল (সা.) এর ক্ষেত্রে দেখা যায়- সকল বিধান একই সময়ে অবতীর্ণ হয়নি। মানুষ যখন উপযোগিতা উপলব্ধি করেছে, তখনি কোনো বিধান অবতীর্ণ হয়েছে। তাই, আমার মতে- দেশের যে সিংহভাগ মুসলমান, তাঁদেরকেই নিরাপদ সীমার ভেতরে থেকে শরীয়াহ আইনের উপযোগিতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে; যা আমার-আপনার সকলেরই দায়িত্ব। এ ক্রমধারা চলতেই থাকবে, হয়তো বা শেষ হবে ইমাম মাহাদী, হযরত ইসা (আ.) এর মাধ্যমে। তার আগ পর্যন্ত আমরা কেবল আমাদের দায়িত্বটুকুই পালন করে যেতে পারি। মনে রাখা দরকার, অন্যায়ের প্রতিবাদের ক্ষেত্রে ইমানের নূন্যতম স্তর হলো- মনে মনে ঘৃণা করা। কোনো মুসলমান যদি ইসলাম বিরোধী কোনো কিছুকে ঘৃণা না করেন, তবে ইমানের দুর্বলতম স্তরও রক্ষা হয়না। তখন তাঁর ইমান রক্ষার্থে সতর্ক হওয়া উচিত।

ইসলামকে জানতে হলে শিখতে হবে। তাই তো প্রয়োজনীয় ইলম অর্জনকে ফরজ করা হয়েছে। আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক আকিদা পোষণ করার তাওফিক দিক। আমিন।

“আঁধারের ভাজ কেটে আসবে বিজয়,
সত্যের লগ্ন সে নিশ্চয়।” - (কবি মল্লিক)

-তারেক আবরার

পঠিত : ৫৪৯ বার

মন্তব্য: ০