Alapon

স্বপ্নে হলেও এসো একবার!




প্রিয়জন হারা মনে কখনো প্রশান্তি থাকে? মনে হয় থাকে না। আমারও নেই। বিরহের জ্বালা কেউ সয় কেউ সইতে পারে না। আমিও ক্যানো যেনো পারছি না! বিরহের বেদনায় ভারাক্রান্ত মনের কানন। সেই বিরহের ব্যথা আমার হৃদয়কে, আমার অন্তরকে খুবলে খুবলে খাচ্ছে। দুঃখ-জ্বালায় আমি বিমর্ষ হয়ে পড়ছি। আমি তোমাকে দেখতে চাই। খুব সখ দেখার। তোমাকে না দেখার ব্যথা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে! তাই আমি শুধু তোমার-ই পথ চেয়ে থাকি। সেই পথ চেয়ে আমি কাঁদি। আমার দুটো নয়ন কাঁদে। আঁখিতে অশ্রু টলমল করে সরবরের ন্যায়। কখনো কারো জন্য এতো পথ চেয়ে থাকি নি, এতো এতো পথ চেয়ে দেখি নি।দেখিও না। কারো জন্য এতো কাঁদি না। মাঝেমধ্যে কতোজনের জন্যেই তো কাঁদি। কতোভাবেই কাঁদি। সুখে কাঁদি, দুখেও কাঁদি। বিরহে কাঁদি। ব্যথায় কাঁদি।মাঝেমধ্যে মনে হয় আমার এই মনটা যেনো বিরহী ডাহুক। রাতভর বুকভরা অসহ্যসব কষ্ট আর কান্নারা ডাকাডাকি করে। কখনো কখনো সেই কান্নার মাঝেও সুখ পাই। সেই যে সুখ, সেই সুখের মতো কান্নাটা সবারই ভালো লাগে। সেই কান্নায় হৃদয়টা নিরব হয়। পাতল হয়। হালকা হয়। হৃদয়ের অলিন্দে প্রশান্তি এসে আশ্রয় নেয়। হৃদয়-বন্দরের দুঃখ জ্বালাগুলো ক্ষণিকের জন্য প্রশমিত হয়ে যায়।


কেউ আমার জন্য আমার কাছে স্বপ্নে এসে সাক্ষাৎ করুক, দেখা করুক তা চাই না। চাই নি। কখনোই চাইতাম না। এখন চাই।খুবই বেশিই চাই। আমাকে চাইতে হয়। তোমার প্রেমের পরশ পেয়ে সিক্ত হতে চাই। হৃদয়ের শুকনো মরুভূমিটাকে ভিজিয়ে নিতে চাই। স্বপ্নের এই যে সুপ্ত একটা ইচ্ছে, এই ইচ্ছেটা শুধু তোমার জন্য। শুধুই তোমার জন্য। এখানে আর কারো জন্য সামান্যতম জায়গা নেই। বিন্দুসম স্থান নেই। স্বপ্নে হলেও একটিবার দেখার যে ইচ্ছে,সেই ইচ্ছেটা জাগে প্রতিটিদিন। প্রতিটি মুহূর্তে। প্রতিটি ক্ষণে। অবুঝ এই হৃদয় বাগে তোমার প্রেমরই শুধু আলোড়ন চলে।

সাহারাসম তৃষ্ণা আমার এই ক্ষুদ্র বুকের গহীণ গহ্বরে। সেই তৃষ্ণা আমার মনে শুধুই তোমার জন্য। তোমার প্রেমে মজার জন্যে। তোমার ভালোবাসায় হৃদয়ের মণিকোঠাটা ভিজিয়ে রাখবার জন্যে।

আমি কেঁদে কেঁদে আমার রব্বের দুয়ারে ফরিয়াদ করি যেনো তোমাকে আমি কখনোই না ভুলি। আমি যে তোমাকে ভুলতে চাই না, কখনোই। কোনোভাবেই। তোমাকে আমি যদি ভুলে যাই –সেটা হবে আমার জীবনের সবচে বড়ো পরাজয়। আমি বারবার পরাজিত হই। পরাভূত হই। আমি আর চাই না পরাজিত হই, পরাভূত হই। আমি এবার বিজয়মাল্য পরিধান করতে চাই। সেই বিজয়ের মালা পরিধান করতে আমি তোমাকে পেতে চাই। তোমাকে পেলেই আমি আমার আল্লাহ তা'য়ালাকে পাবো। এভাবেই আমার জয়ের মালা গাঁথা হয়ে যাবে।


গুণগুণ করে গাইতে থাকি, মিলোডি মাস্টার সাইফুল্লাহ মানসুরের গাওয়া একটা গান,

আমি তো আমার চেয়ে তোমাকে
ভালোবেসে বেসে সারা হতে চাই।
পৃথিবীর সবকিছু হারালেও
তোমারে কভু যেনো না হারাই
আর কারো প্রেমে যেনো ডুবে না মরি
যায় যদি ভেঙে যাক জীবন-তরী!
তোমাকে পেলেই পাবো আল্লাহ তা'লা
এইভাবে গাঁথা হবে জয়েরও মালা...


হৃদয়-বেতারে তোমার প্রেমের গান বাজুক। বাজতে থাকুক অবিরাম, অবিরত...

আমি তো তোমাকে কখনোই দেখি নি। তবুও ক্যান তুমি আমার স্মরণে আজো অমলিন হয়ে আছো? ক্যান শুধু তোমার প্রেম চাই! শুধু তোমারই ভালোবাসা চাই। ক্যান চাই তোমার প্রেমের ফল্গুধারা যেনো আমার হৃদয়ে বয়ে চলে! ক্যান!? ক্যান, কী জন্যে শয়নে-স্বপনে, নিশীথে-জাগরণে তোমার ভালোবাসায় ধন্য হতে চাই!

আমি তোমার প্রেমের সাড়া পেলে আমি পৃথিবীর সবকিছু হারালেও কোনো আফসোস নেই। আমি তোমার জন্য পৃথিবীর সবকিছু হারাতে পারি তোমার জন্যই। আর কারো জন্য না। কিছুর জন্য না।


আচ্ছা আমি তো কুরআন পড়ি। আলকুরআন খুলে দেখি। কুরআনে আমি দেখি আমার আল্লাহ বলেছেন, তুমিই আমার এবং আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ আদর্শ। [০১] আমি পড়তে থাকি। পাতার পাতা, সুরা পড়তে থাকি। দেখি আমার আল্লাহ বলেছেন হে নবী, তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী! এমন মহান, যেই মহত্তম চরিত্রের কোনো কূল কিনারা নেই [০২]

পড়তে পড়তে আরেকটা আয়াত পেয়ে যাই আমি। যেই আয়াতটা পড়ে হৃদয়টা আমার উৎফুল্ল হয়ে ওঠেছে। আমার আল্লাহ বলেন -
আমি আপনাকে সমগ্র জগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি। [০৩]



যেই মানুষকে আমার জন্য না শুধু, সারা বিশ্বের জন্যে রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছে তাঁর জন্য আমার ভালোবাসা থাকবে না তা কী করে হয়! তাকে আমি ভালোবেসে তাঁর রহমতের স্নিগ্ধতায় সিক্ত হবো না তা কী করে হয়! আমার আল্লাহ আরো বলেন
"নিশ্চয় আপনি প্রেরিত রাসূলগণের একজন। সরল পথে প্রতিষ্ঠিত।’’ [০৪]।


হাদিসের গ্রন্থ খুলতেই দেখি উম্মুল মুমিনিন আয়িশা (রাঃ) বলেছেন, পুরোটা কুরআনই আমার প্রিয়তম-প্রিয়জনের চরিত্র। [০৫]

আমি আজ তাই তোমার আদর্শে আলোকিত হতে চাই। আমার আল্লাহ তো বলেছেনই তোমার আনিত আদর্শই শ্রেষ্ঠ আদর্শ। তুমিই তো একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ আমার জন্য। আমাদের জন্য। আজ আমি তাই সেই আদর্শে ধন্য হতে চাই। সেই মহান এবং মহৎ মানুষের সাক্ষাৎ কতো মানুষ স্বপ্নের মাঝেও পায়। আমি পাচ্ছি না। আমি তাই স্বপ্ন হলে একটি বার শুধু দেখতে চাই। আমি যখন আখেরাতে মাগফিরাত চেয়ে চেয়ে কাঁদবো, তখন তোমার শাফায়াত তো আমাকে মুক্তি দিবে। কেউ যখন আমাকে চিনবে না, আমি হন্য হয়ে যখন ছুটোছুটি করবো, তখন তো তুমিই আমার জন্য শাফায়াত করবে। আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে আমার জন্য মাগফিরাত কামনা করার কথা তো পড়েছি। [০৬
বুখারি : ৪৭১২]



যেই মানুষটার মাঝে এতো দরদ, যিনি এতো দরদী আর প্রেমময়ী উম্মতের জন্যে, যার আচরণ এতো উন্নত আর অনুপম, দেখতেও যেই মানুষটার সৌন্দর্য হার মানায় পূর্ণিমার স্নিগ্ধ জোসনার মায়াবী আলোকেও –এমন একজন মানুষের কথা কেবলই শুনেছি, দেখিনি। তাই আজ শুধু আমি না, তঁকে দেখার জন্য, তাঁর জন্য সাক্ষাতের জন্য সারা ভুবনই কাঁদে – এমন একজন মানুষের জন্য কার না কান্না আসবে! কে না এমন মানুষের ভালোবাসা সিক্ত হতে চাইবে? এমন মানুষের প্রেমের পরশে কোন মানুষটা তার হৃদয়কে উজালা করতে না চাইবে!

মনে পড়ে গেলো মুত'আর যুদ্ধের প্রথম শহীদ সেনাপ্রধান আল্লাহর রাসুলের পালক পুত্র হিব্‌বু রাসূলিল্লাহ (রাসূলুল্লহার প্রীতিভাজন) উপাধিযুক্ত যায়িদ বিন হারেসা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর ঘটনা। আল্লাহর রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে লালন পালন করেছেন। তাঁকে তাঁর পিতা-মাতার ভালোবাসাও নবিজী (সঃ) এর ভালোবাসার কাছে টলাতে পারে নি।

"আল্লাহর রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওনার স্ত্রী খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ) হাদিয়া দিয়েছেন। বালক যায়িদ তাঁর মহান সাহচর্য লাভ করে উত্তম আর শ্রেষ্ঠ চারিত্রিক সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেলেন।

এদিকে তাঁর মা পুত্রে শোকে অসম্ভব অস্থির! মায়ের ভালোবাসা সন্তানের জন্য ক্যামন হয় তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না! পুত্র শোকে মা মূহ্যমান!মায়ের রজনীর সুগভীর সুষুপ্তি হারাম হয়ে গিয়েছে!


একদিন যায়িদ (রা) এর পিতা হারিসা ছেলের সন্ধান পেয়ে গেলেন। হারিসা ছেলেকে ফেরত আনান জন্য সফরের প্রস্তুতি নিলেন। কলিজার টুকরো নয়নের মণি সন্তান যায়িদের মুক্তিপণের অর্থও বাহনে উঠালেন। সফরসঙ্গী হিশেবে সাথে নিলেন হারিসার ভাই কা’ব। তাঁরা মক্কার পথে বিরামহীন চলতে লাগলেন। একপর্যায়ে প্রিয় নবীজি মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহর কাছে পৌঁছলেন এবং বললেনঃ

' ওহে আবদুল মুত্তালিবের বংশধর! আপনারা আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশী। অসহায়ের সাহায্যকারী, ক্ষুধার্তকে অন্নদানকারী ও আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয় দানকারী। আপনার কাছে আমাদের যে ছেলেটি আছে তার ব্যাপারে আমরা এসেছি। তার মুক্তিপণও সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন এবং আপনার ইচ্ছামত তার মুক্তিপণ নির্ধারণ করুন।’

মুহাম্মাদ সা. বললেনঃ ‘আপনারা কোন্‌ ছেলের কথা বলছেন?

– আপনার দাস যায়িদ ইবন হারিসা।

– মুক্তিপণের চেয়ে উত্তম কিছু আপনাদের জন্য নির্ধারণ করি, তা-কি আপনারা চান?

– কী তা?

– আমি তাকে আপনাদের সামনে ডাকছি। স্বেচ্ছায় সে নির্ধারণ করুক, আমার সাথে থাকবে, না আপনাদের সাথে যাবে, যদি আপনাদের সাথে যেতে চায়, মুক্তিপণ ছাড়া তাকে নিয়ে যাবেন। আর আমার সাথে থাকতে চাইলে আমার করার কিছুই নেই।

তারা সায় দিয়ে বললঃ আপনি অত্যন্ত ন্যায় বিচারের কথা বলেছেন।

মুহাম্মাদ সা. যায়িদকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেনঃ এ দু’ব্যক্তি কারা?

বললঃ ইনি আমার পিতা হারিসা ইবন শুরাহবীল। আর উনি আমার চাচা কা’ব।

বললেনঃ ‘তুমি ইচ্ছা করলে তাঁদের সাথে যেতে পার, আর ইচ্ছা করলে আমার সাথেও থেকে যেতে পার।’

কোন রকম ইতস্ততঃ না করে সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেনঃ ‘আমি আপনার সাথেই থাকবো।’

তাঁর পিতা বললেনঃ ‘যায়িদ, তোমার সর্বনাশ হোক! পিতা-মাতাকে ছেড়ে তুমি দাসত্ব বেছে নিলে?’

তিনি বললেনঃ ‘এ ব্যক্তির মাঝে আমি এমন কিছু দেখেছি, যাতে আমি কখনও তাকে ছেড়ে যেতে পারিনে।’’


কী এক অদ্ভুত মায়া, ভালোবাসা, স্নেহ আর উত্তম আচরণ পেলে একটা বালক তাঁর বাবা-মাকেও ছেড়ে থাকতে পারে, ভাবা যায়!! আমার তো যায়িদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মতো এতো বিরাট সৌভাগ্য হয় নি সেই সহান মানুষের সাহচর্য পেয়ে ধন্য হবার এবং খুব কাছ থেকে দেখার! আর সেই জন্যেই আমি গানের ভাষায় বলে যাই –স্বপ্নে হলেও এসো একবার!


||স্বপ্নে হলেও এসো একবার||
-Redwan Rawaha




রেফারেন্স
------------------

[০১] সুরা আল-আহজাব, আয়াত: ২১
[০২] সুরা ক্বলাম-০৪
[০৩] সুরা আম্বিয়া -১০৭
[০৪] সুরা ইয়াসিন- ০৩-০৪
[০৫] সহীহ মুসলিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৪৬
[০৬] সহীহ্ বুখারী -৪৭১২
[০৭] আসহাবে রাসুলের জীবন কথা, প্রথম খন্ড- ডঃ আব্দুল মাবুদ
[০৮] গীতিকার সুরকার মাওলানা তারেক মনোয়ারের কয়েকটি না'তে রাসুল থেকে অনুপ্রাণিত

পঠিত : ৯৫১ বার

মন্তব্য: ০