Alapon

নাইন- ইলাভেনের ১৯ বছর: সেদিন যা ঘটেছিল

নাইন- ইলাভেনের ১৯ বছর: সেদিন যা ঘটেছিল
লিখেছেন: সোহেল রানা
ফার্স্টলেডি লরা বুশ প্রতি দিনের মত সেদিনও হোয়াইট হাউজেই ছিলেন। ফ্লোরিডায় প্রেসিডেন্ট বুশের সফর সঙ্গী হন নি। আর কিছুক্ষণ বাদেই একদল খুদে শিক্ষার্থীকে সামনে রেখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট দাঁড়াবেন বক্তৃতার মঞ্চে। ততক্ষণে যুক্তরাষ্ট্রের বুকে আছড়ে পড়েছে এক ঝড়। গত দুইশো বছরের ইতিহাসে এমন ভয়ংকর মনুষ্য দুর্যোগ দেখেন নি কোন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তিন দফা জঙ্গি হামলা নাড়িয়ে দিয়ে গেছে বিশ্ব পরাশক্তিকে।
পৃথিবীর শীর্ষ ক্ষমতাধর দেশটির নিরাপত্তাবেষ্টনী ডিঙিয়ে এমন ভয়াবহ হামলা সম্ভব, মার্কিনীদের এমনটা ভাবার কোন কারনই ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর তাদের চ্যালেঞ্জ করারও কেউ নেই। যাহোক,সেই বিপর্যয়ের ক্ষত ১৯ বছরেও সারানো যায় নি। যদিও মার্কিনীদের ক্রোধের আগুনে পুড়েছে ইরাক ও আফগানিস্তান। বছরের পর বছর কমিউনিস্ট এস্টাবলিস্টমেন্টের বিরুদ্ধে লড়াই করা অামেরিকা খুলেছে যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট- ওয়ার অন টেরর।
নিউইয়র্কের ম্যানহাটনকে বলা হয় পৃথিবীর বাণিজ্য, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। এখানে আছে বিশ্বখ্যাত সংস্কৃতি কেন্দ্র ব্রডওয়ে, ওয়ালস্ট্রীট, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, গ্রীন উইচ গ্রাম ও সেন্ট্রাল পার্ক। নিউইয়র্ক শহরের ৪০-৫০ মাইল দূর থেকেও খালি চোখে দেখা যায় ১১০ তলার টুইন টাওয়ারটি। সকালে কিছু সময়ের ব্যবধানে টাওয়ারটিতে হামলে পড়েছে বোস্টন থেকে উড়ে আসা দুটি যাত্রীবাহী বিমান। বোস্টন বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর বিমান দুটি আচমকা দিক পরিবর্তন করে নিউইয়র্ক সিটির দিকে চলে আসে।
সেদিন আরো দুটি বিমান ছিনতাই হয় যার একটি গিয়ে আঘাত হানে আমেরিকার প্রতিরক্ষাদপ্তর পেন্টাগনে। এই বিমান উড়ে এসেছিল ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের ডালাস থেকে। আর নিউজার্সি থেকে উড়ে আসা চতুর্থ বিমানটি ৪৪ আরোহী সহ বিধ্বস্ত হয় পেনসিলভানিয়ার আকাশে। আরোহীদের কাউকেই বাঁচানো যায় নি। অনেকে সন্দেহ করেন, হয়তোবা এই বিমানের লক্ষ্যবস্তু ছিল খোদ হোয়াইট হাউজ।
সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে আমেরিকান এয়ারলাইনসের বোয়িং-৭৬৭ উড়োজাহাজটি আছড়ে পড়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উত্তর দিকের টাওয়ারে। ১১০ তলা ভবনটির ৮০তম তলায় ঢুকে পড়ে বিমানটি। এর ১৭-১৮ মিনিট পরই দ্বিতীয় বিমানের হানা। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দক্ষিণ দিকের টাওয়ারের ৬০তম তলা বরাবর আঘাত করে বসে বিমানটি। ঘন্টাখানের ব্যবধানে ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় টুইন টাওয়ার।
সকাল দশটার দিকে দক্ষিণের টাওয়ারটি আর তার আধাঘন্টার মাথায় উত্তরের টাওয়ারটি খাড়াভাবে নিচের দিকে নেমে এসে ধ্বংস্স্তূপে রূপ নেয়। হামলাকারী ১৯ জন সহ পুরো যুক্তরাষ্ট্রে সেদিনের ঘটনায় নিহত হয় ২৯৯৬ জন। আহত হন ছয় হাজারের মত মানুষ। হতাহতদের মধ্যে আছেন উদ্ধার করতে যাওয়া দমকল কর্মী ও পুলিশ সদস্যও। হামলার পর প্রথম দিনেই নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে বড় ধরনের ধস নামে। এক মাসেই চাকরি হারান ১ লাখ ৪৩ হাজার মানুষ।
নিজ দেশের ওপর এরকম ভয়াল সন্ত্রাসী হামলার পর পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষেই স্বাভাবিক থাকা সম্ভব না। প্রেসিডেন্ট বুশ যখন হামলার খবরটি জানতে পারলেন তার পক্ষেও স্বাভাবিক থাকা সম্ভব হয়নি। তিনি যখন শিশুদের সামনে বক্তব্য দিতে ওঠে দাঁড়ালেন, তিনি ছিলেন বিচলিত, বিমর্ষ ও মুষড়ে পড়া এক চিতাবাঘ।
এ ধরনের বিপযর্য়ে সাধারণত রাষ্ট্রনায়করা সব কাজ ফেলে রাজধানীতে দ্রুত ফিরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন, জনগণকে সাহস দেন। প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক সহকর্মীরাও এমনটাই চেয়েছিলেন। কারন জনমনে প্রশ্ন ওঠতেই পারে জাতির ক্রান্তিলগ্নে রাষ্ট্রপতি কোথায়? কিন্তু বুশের বেলায় তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। রাজধানীর পরিবর্তে দুটি যুদ্ধবিমানের প্রহরায় বুশের বিমানটি গিয়ে নামে ফ্লোরিডার কাছের একটি বিমানঘাঁটিতে। নিরাপত্তাকর্মীদের বাধায় সেদিন তাৎক্ষণিক রাজধানীতে ফেরেন নি বুশ। যদি হোয়াইট হাউজ আক্রান্ত হয়?
ততক্ষণে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউজ খালি করে ফেলা হয়েছে। সেখান থেকে লরা বুশ ও অন্যান্য স্টাফদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিকচেনিকে উপ- রাষ্ট্রপতির ভবন থেকে একরকম টেনে-হিচড়ে বের করে হোয়াইট হাউজের পেছনের মাঠের মাটির নিচের বাংকারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী কলিন পাওয়েল লাতিন আমেরিকা সফর সংক্ষিপ্ত করে চলে এসেছেন দেশে। কিন্তু বুশের তখনো রাজধানীতে ফেরার নাম নেই। বুশ যখন রাজধানীতে ফিরে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন ততক্ষণে রাত সাড়ে আটটা বেজে গেছে। পরদিন হোয়াইট হাউজের দক্ষিণ লনে দাঁড়িয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন বুশ, বললেন, 'এই হামলা একটি যুদ্ধের সূচনা। '
মাসখানেকের মধ্যেই একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো আমেরিকা। যুদ্ধটা আফগান তালেবান আর সিআইএর মদদে গড়ে ওঠা আমেরিকার এক সময়কার মিত্র ওসামা বিন লাদেন ও আলকায়েদার বিরুদ্ধে। প্রমাণ থাকুক আর না থাকুক বুশ প্রশাসন উপসংহার টানলো- এটা লাদেনের কাজ। ২৩ সেপ্টেম্বর কলিন পাওয়েল টেলিভিশনে বললেন, ‘আমরা পৃথিবীর সামনে এমন জোরালো মামলা দাঁড় করাবো যে, তাতে প্রমাণিত হবে ওসামা বিন লাদেন এই সন্ত্রাসের সাথে জড়িত’। অতএব তার আশ্রয়দাতা ও মদদদাতাদের ধরো। তারা কারা? আফগানিস্তানের তালেবান সরকার।
টুইন টাওয়ারে হামলার ২৬ দিন পর শুরু হলো 'অপারেশন এনডিওরিং ফ্রিডম'। আরব সাগরে মোতায়েন মার্কিন রণতরী থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে টমাহক মিসাইল ছুটে গেলো আফগানিস্তানের দিকে। রাজধানী কাবুল, তালেবানদের শক্তিশালী ঘাঁটি কান্দাহার আর ঐতিহাসিক শহর জালালাবাদ কাঁপতে থাকলো। বুশ প্রশাসন সেদিন পাকিস্তানের নাকের ডগায় যে যুদ্ধের সূচনা করেছে, দুই দশকেও তা থেকে তারা বেরোতে পারে নি। মাঝখানে ঝরেছে হাজার হাজার বেসামরিক আফগান ও সাধারণ সৈনিকের প্রাণ। অবশ্য সেদিনের প্রতিপক্ষ তালেবানদের এখন অার সন্ত্রাসী বলতে চান না মার্কিন কর্মকর্তারা। সন্ত্রাসের সাথে কি অার সন্ধি হতে পারে? তাহলে তো অালোচনার বৈধতাই থাকে না!
আমেরিকানরা এখন তালেবানদের সাথে এক টেবিলে বসেন, কথাও বলেন। এমনকি সন্ধি করে নিরাপদ প্রস্থানের উপায়ও তারা বের করেছেন। দুই দশকের লড়াই আমেরিকাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়েছে, আফগানিস্তানে তালেবান একটা বাস্তবতা। তাই কাতারের দোহায় চলছে দুইপক্ষকে মুখোমুখি করে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার অায়োজন। সেই আয়োজন সফল হলে আর মার্কিনীরা ঘরে ফিরলে সিআইএ ঘুরে আবারো দাবার ঘুটি যাবে অাইএসঅাই এর হাতে। এমনটা অারেকবার ঘটেছিল যখন সোভিয়েত সেনারা অাফগান ভূখন্ড ছেড়েছিল অার মার্কিনীরা ভেবেছিল তাদের মিশন অাপাতত কমপ্লিট। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে অামেরিকা অারো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, কারন নতুন রাশিয়ার সীমান্ত অাফগানিস্তানের কাছ থেকে বহুদূর সরে গেছে।
তাই নির্ভার যুক্তরাষ্ট্র মুজাহিদদের হাতে গোলাবারুদ এর ভান্ডার সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ইস্তফা দিয়েছিল কমিউনিস্ট তাড়ানোর মিশন। এর পরের ইতিহাস অামাদের সবারই জানা। মুজাহিদরা নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলো। ভাগ হয়ে গেলো কয়েক ভাগে। এই অাফগান গৃহযুদ্ধের মধ্য থেকেই অাইএসঅাই এর পূর্ণ সহযোগিতায় দৃশ্যপটে এলো নতুন পরাশক্তি- তালেবান। রাব্বানী সরকারকে হটিয়ে তারা নিলো কাবুলের নিয়ন্ত্রণ।
এত বছর পর অাবারো অাফগানিস্তান অাইএসঅাই এর হাতে পড়লে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রভাবশালী দেশ ভারত তা মানবে কেন? অতএব প্রায়ই এখন অাফগান মন্ত্রপরিষদ সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর বোমা হামলার খবর পাওয়া যাবে। যাচ্ছেও। কারন তালেবানদের সাথে অাফগান সরকারের অালোচনার অগ্রগতি মানে এ অঞ্চলের জিও পলিটিক্সে ভারতের অারেক দফা উষ্ঠা খাওয়ার মতই। তালেবান ইস্যুতে ভারতের এক সময়কার ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরানও এখন লিবারেল।

পঠিত : ৫৩৪ বার

মন্তব্য: ০