Alapon

সাদকায়ে জারিয়া...


১.
আয়ান মায়ের একমাত্র সন্তান।আদর যত্নের সবটুকু নির্যাস পেয়েই বড়ো হয়েছে। মা ওকে স্নেহমাখা চাদরে এমনভাবে ঢেকে রাখেন যে, কখনো বুঝতেই দেননি বাবার অভাব।
সেই আয়ান এখন মাদ্রাসার গন্ডি পেরিয়ে শহরে নামকরা ভার্সিটিতে চান্স পায়। মা কত বুঝিয়েছিলেন দ্বীন নিয়ে পড়াশুনার জন্য। কিন্তু আয়ান এখন আধুনিক হতে চায়!
আধুনিক হয়েছেও বটে! রঙিন মরীচিকায় গা ভাসিয়ে আয়ান হারাতে থাকে। আগে যেই নামাজটুকুও আদায় করতো তার ছায়াও এখন উবে গেছে শহরে এসে।
সারাদিন ফ্রেন্ড-সার্কেলের সাথে আড্ডা মাস্তি, ঘোরাঘুরি। সময় কই আল্লাহকে স্বরণ করার!
মায়ের ফোন রিসিভ করার সময়ও নেই আয়ানের। জাস্ট ফেন্ড, গার্লফেন্ড দের সাথে কথা বলেই তো রাত পেরিয়ে যায়!
এভাবেই দিন-মাস-বছর কেটে যায় আয়ানের। আচমকা একদিন গ্রাম থেকে খবর আসে, ‘আয়ানের মা আর পৃথিবীতে নেই!’ আয়ান হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির পথে রওনা দেয়।

২.
চারদিকে কেমন শুভ্রতার ছোঁয়া। আগর বাতির ঘ্রাণে মোহিত হৃদয় আজ বেদনায় আচ্ছন্ন! তপ্ত বাতাসে শুধু দীর্ঘশ্বাসের বাষ্প! মানুষের হা-হুতাশে কেমন নিবিড় একটা ধ্বনি বার বার ফিসফিস করে কানেকানে এসে যেন বলছে, নেই কিছু নেই!

আয়ান কাঁধ থেকে ব্যাগ রেখে ধীর পায়ে হেটে আসে মায়ের লাশের কাছে। মুখ থেকে সাদা কাপড় সরিয়ে অশ্রুভেজা চোখে তাকায় মায়ের চক্ষু মুজিত মুখপানে। অন্তরটা কেমন শূন্যতায় মুচড়ে উঠে! ধরা গলায় ‘ইন্নালিল্লাহী ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন’ বলে আলতো করে চুমু খায় মায়ের কপালে। চোখ থেকে দু-ফোটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে মৃত মায়ের ধবধবে সাদা মুখে। অত:পর সাদা কাপড় টেনে নেয় মায়ের মুখে। মায়ের লাশ দাফনের সময় হয়ে গেছে। শান্ত মুখে দাফনকার্য শেষ করে আয়ান। সবাই চলে আসার পরও আয়ান ঠায় বসে থাকে মায়ের কবরের পাশে। কবরের মাটিকে কিছুক্ষণ হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করে।

মাকে একা রেখে আসতে মন মানে না আয়ানের । ইনি তো সেই মা, বাবা মারা যাওয়ার পর ছোট্ট আয়ানকে কোলেপিঠে করে যিনি মানুষ করেছিলেন। কতশত আবদার মুখ বুজে মেনে নিয়েছিলেন মা!

আয়ান যখন বড় হয় মাকে একবার জিঙ্গেস করেছিল, আচ্ছা মা, বাবা মারা যাওয়ার পর তুমি আর বিয়ে করলে না কেন? মা মুচকি হেসে বলেছিলেন, ভয় ছিল বাবা তোকে যদি হারিয়ে ফেলি! আয়ানের ভীষণ কান্না পায়। শুধু আমার দিকে তাকিয়ে সারাটা জীবন একা একা পার করে দেন মা! সত্যিই মায়েরা বুঝি এমনি হয় মায়াবতী! বড়ো শখ করে মা মাদ্রাসায় পড়িয়ে ছিলেন আয়ানকে। কোরআন সম্পূর্ন হিফজ করার পর আয়ান যেদিন বাসায় এসেছিল, মায়ের খুশি সেদিন কে দেখে! পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে ডেকে ডেকে মা বলেছিলেন, ‘জানেন আমার ছেলে এখন কোরআনের হাফিজ!’

মা বড্ড ধার্মিক ছিলেন।ছোটবেলায় মা কি সুন্দর মুখে মুখে দো’আ, হাদিস শেখাতেন! আয়ানের মনে পড়ে যায় মায়ের শেখানো খুব প্রিয় একটা হাদিস:

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘জান্নাতে কোনো কোনো ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে। তখন সে বলবে, ‘কীভাবে আমার মর্যাদা বৃদ্ধি পেলো?’ তখন তাকে বলা হবে, ‘তোমার সন্তান তোমার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেছে, তাই।’[১]

মা সবসময় শুধু বলতেন, সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি, যে দুনিয়াতে নেককার সন্তান রেখে যেতে পেরেছে।তোকেও আমি নেককার সন্তান হিসেবে দুনিয়ায় রেখে যেতে চাই। আমি মারা যাওয়ার পর তুই হবি আমার সাদকায়ে জারিয়া! আমি মারা যাওয়ার পর বেশি বেশি দো’আ করবি বুঝলি? আর দান-সাদকা করবি কেমন? আয়ান তখন সুবোধ বালকের মতো শুধু মাথা নাড়ত।

৩.
মায়ের কবরের কাছ থেকে ফিরে এসে নিজের রুমে যায় আয়ান। বাথরুমে অজু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে দাড়িয়ে যায় সালাতে। বহুদিন পর ঘুণে ধরা, পচে যাওয়া অন্তর নিয়ে সালাতে দাড়িয়েছে। ভাঙ্গা অন্তরকে শক্ত আটার প্রলেপে বাধিয়ে দেন যে রব্ব তার সামনে!
বেশ দীর্ঘ সালাতের পর দুইহাত তুলে প্রার্থনা জানায় রবের কাছে। কান্নার উজার স্রোতে বিড়বিড় করে আর্জি পেশ করে মায়ের গুনাহ মোচনের জন্য । নিজেকে আর সামলাতে পারে না আয়ান। হাউমাউ করে শিশুর মতো কান্না করে।

আয়ান ভাবতে থাকে তার অতীতের দিনগুলোর কথা। ছোটবেলায় মায়ের পাশে ঘুমিয়ে কী সুমধুর কন্ঠে সূরা মূলক পড়ে শোনাত! আচ্ছা শেষ কবে আয়ান কোরআন তিলাওয়াত করেছিল? আয়ান আর ভাবতে পারে না! নিজের প্রতি ঘৃণায় লজ্জায় দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকে।

অত:পর শপথ করে আল্লাহর কাছে আজ থেকে সে নেককার সন্তান হবে তার বাবা-মায়ের জন্য।মরিচীকার চাকচিক্যতাকে বিদায় জানিয়ে আত্মসমর্পণ করে মহিমানিত্ব রবের নিকটে।
দিন গড়ায়।আয়ান বদলায়। একটু একটু করে নয়,একেবারেই নতুন মানুষ হয়ে যায়। এক পৃথিবী লজ্জা নিয়ে আয়ান পুনরায় তার রবের নিকট ফিরে। আর চায় না আয়ান এমন ছন্নছাড়া জীবনকে! রব্বকে বলে তাকে জড়িয়ে নিতে অসীম মায়ার চাদরে!

৪.
দূষিত অন্তরকে পরিশুদ্ধ করতে গভীর রাতে সালাতে দাড়ায় আয়ান। অতীতের কৃত গুনাহের জন্য সালাতে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে লজ্জায় মাথা নুয়ে আসে আয়ানের,সিজদায় বুক ফেটে বেরিয়ে আসে আল্লাহর অবাধ্যতায় ডুবে থাকা মুহূর্তগুলোর আর্তচিৎকার।
প্রতিদিনের দো’আয় হৃদয়ের সমস্ত আবেগ ঢেলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে, ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছাগিরা ‘
-‘হে আমার রব, তাদের (বাবা-মায়ের) প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন’।[২]

নিয়ম করে প্রতি সপ্তায় বাবা-মায়ের কবর জিয়ারতে যায় আয়ান। মায়ের কবর শিউলি ফুলে ভরে উঠে। কবরের ভেজা মাটির গন্ধে মায়ের আচলের ঘ্রাণ খুজে! মাঝে মাঝে কবরের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘মা আমি কি হতে পেরেছি তোমার জন্য সাদকায়ে জারিয়া?’ অত:পর আনমনেই কবরে কান লাগায় হয়তো মায়ের জবাব শুনার অপেক্ষায়!
রেফারেন্স:
——————-
১. [ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ২/১২০৭, আলবানি, সিলসিলা সহিহাহ: ৪/১৭২; হাদিসটি সহিহ]
২.সূরা বনি-ইসরাঈল :২৪

-ফাইয়ারা জিবা

পঠিত : ৪৫৬ বার

মন্তব্য: ০