Alapon

নিজের আত্মপরিচয় কখনো ভুলে যাবেন না...


একটা ঘটনা বলি। ইয়ামেনের রাজা একটা বহুমূল্য গাউন মহানবী (সঃ) কে উপহার হিসেবে দেন। তিনি (সঃ) উপহারটি গ্রহণ করছিলেন। একবার সেটা গায়ে দিয়ে খুতবাও দিয়েছিলেন। সাহাবি হাকীম ইবনে হিশাম রা: বলছেন যে 'এ গাউনে তিনি মহানবী (সঃ) এর মত সুন্দর এবং স্মার্ট আর কাউকে দেখেননি'।

একদিন সাহাবি হাকীম রা. (তখনও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি) মদিনার রাস্তায় উসামা বিন যায়েদ(রাঃ) কে সেই গাউনটি পরাবস্থায় দেখলেন। হযরত উসামা রা: ছিলেন মহানবী (সঃ) এর দাস যায়েদ বিন হারিসা (রাঃ) এবং প্রিয় নবী সা: এর পিতা আব্দুল্লাহর ক্রয় করা নিগ্রো দাসী বারাকাহ উম্মে আইমান রা: এর সন্তান।

উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) র গায়ের রং ছিল কালো, চ্যাপ্টা নাক এবং চিকন ঠোঁট, দেখতে সুশ্রী ছিলেন না তিনি। একজন নিগ্রো দাসের গায়ে ইয়েমেনের রাজার সেই গাউন দেখে হাকীম রা: খুব অবাক হলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন; তুমি উসামা না?তুমি সেই গাউন পরেছো যে গাউন ছিল ইয়ামানের রাজা যিয়াজানের?

প্রিয় নবী সা: এর ঘরে তারই কাছে প্রশিক্ষিত নিগ্রো ও দেখতে অসুন্দর উসামা রা: ঐ প্রশ্নের যে জবাব দিয়েছিলেন তার মধ্যেই রয়েছে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা।
তিনি জবাব দিয়েছিলেন; আল্লাহর কসম, আমি ইয়েমেনের বাদশাহর চেয়েও শ্রেষ্ঠ (ওআল্লাহি আনা খাইরুম মিন যিয়াজান) আমার বাবা যিয়াজানের বাবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, আমার মা যিয়াজানের মায়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কারন আমি, আমার বাবা, আমার মা, আমরা সকলেই পড়েছি; 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ'!

ইসলাম যে যুগে সমাজের সবচেয়ে হতদরিদ্রদের মধ্যেও এমন আত্মসম্মানবোধ জাগিয়েছিল! আর আজ? আজ আমাদের মনে আত্মসম্মানের লেশমাত্র নেই! আমরা বির্ধমীদের কাছে সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য মুখিয়ে থাকি? সম্মান ও মর্যাদা পেতে বোধে বিশ্বাসে, শিক্ষা ও দর্শনে, কৃষ্টি ও কালচারে, চলনে ও বলনে তাদের সাথে মিশে যেতে চাই? আত্মপ্রবঞ্চনা আর কাকে বলে!

প্রাক্তন যুগোশ্লাভিয়ার অংশে (বসনিয়া ও হার্জেগোভিনিয়া) বসবাসরত মুসলমানরা আধুনিকতা, তথাকথিত ইউরোপীয় প্রগতিবাদিতা, সহাবস্থান ও সেক্যুলাজিমের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন খুব ভালো করেই। চাল চলনে, কথা বার্তায়, আচারে আচরণে, বোধে বিশ্বাসে, পোশাকে পরিচ্ছদের কোন দিক বিচারেই বলার কোন পথ ছিল না যে, এই জনগোষ্ঠী মুসলমান। কালে ভদ্রে দু'একটি পরিবার ছাড়া বলা কোন উপায়ই ছিল না যে, ঐ জনগোষ্ঠী প্রকৃতপক্ষেই ইসলাম ধর্মের অনুসারী।

তারা নিজেদেরকে যতোটা গর্বের সাথে ইউরোপীয় হিসেবে পরিচিত করতে চাইতো, তার কণাভাগও মুসলমান হিসেবে পরিচিত করানোর ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না। বিবাহপূর্ব যৌনতা, বিবাহ ছাড়াই সন্তান ধারন, মদপান, মাদক সেবন, জবাই না করেই মাংশ খাওয়া এবং শুকরের মাংশ খাওয়া, খৃষ্টান সার্বদের সাথে অবলীলায় বসনিয় নারীদের বিবাহ কিংবা লিভটুগেদার, কোনটাতেই কোনরকম আপত্তি ছিল না।

কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পরে স্বাধীনতার প্রশ্ন থেকে যে সংঘাত ও পরিশেষে যুদ্ধ সংঘটিত হলো, তাতে পুরো ইউরোপ, এমনকি, পুরো বিশ্বের চোখের সামনে নিরস্ত্র বসনীয়দের উপরে জঘন্য হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। প্রকাশ্যে অন্তত ৮০০০ মুসলমান নরনারীকে হত্যা করা হয়েছে।

এইসব নিরস্ত্র ও বেসামরিক মুসলমানদর উপর বর্বরতা চালানোর সময় সার্ব খৃষ্টানরা এটাকে কোন গুরুতই দেয়নি যে এইসব মুসলমানরা (দু'একজন ব্যতিক্রম ছাড়া) তাদের ব্যক্তিজীবনে ইসলামের সাথে যতোটা না সম্পর্কিত ছিল, তার চেয়েও বেশি সম্পর্কিত ছিল ইউরোপীয় ও খৃষ্টবাদী সংস্কৃতি এবং জীবনধারার সাথে!

তার মানে হলো, জীবন, বোধ বিশ্বাস, নীতি আদর্শ এবং শিক্ষা সংস্কৃতি ও জীবনধারার সাথে আপোষ করে নিজেদের পৃথক জাতিসত্তাকে বিসর্জন দিয়েও বসনীয় মুসলমানরা সার্বীয় খৃষ্টানদের কাছে 'আপন' হতে পারেনি!

একই ঘটনা ঘটেছিল স্পেনেও। কর্ডোভার পতনের পরে সেখানে রয়ে মুসলমানদের জোর করে খৃষ্টান বানানো হয়। ইসলাম থেকে ধর্মান্তরিত এইসব খৃষ্টান এবং তাদের পরবর্তি প্রজন্ম খৃষ্টান হওয়া সত্তেও কেবলসাত্র একসময় তারা নিজেরা কিংবা তাদের বাপ দাদারা মুসলমান ছিল, এই অপরাধে ফার্ডিান্ডের স্পেনে তাদের আলাদা নামকরণ করা হয় 'মরিস্কো' হিসেবে।

'মরিস্কো'দের ঘৃনার চোখে দেখার পাশাপাশি ব্যবসা বাণিজ্য, প্রশাসন, চাকুরি বাকুরিতে কোণঠাসা করে রাখা হয়। তাদেরকে আলাদা রংয়ের পোশাক পরতে বাধ্য করা হয়।সন্দেহ হলেই ইনকুইজিশনের আগেুনে জ্যন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। সহাবস্থানের নামে ধর্ম ও কৃষ্টি বিসর্জন দিয়েও রক্ষা পায়নি এইসব হতভাগারা।

ইতিহাস বলে; আত্মপরিচয় বিসর্জন দিয়ে সহাবস্থান সম্ভবপর নয়। আত্মরক্ষাও হয় না। আপনি এই পৃথিবীর বুকে আমেরিকা কিংবা ফরাসি প্রেসিডেন্ট বা ধনকুবের বিল গেটস-এর চেয়েও সম্মানী, সে সত্যটা উপলব্ধী করুন।

কারণ আপনি বিশ্বের বুকে আল্লাহর খলিফা, একজন মুসলমান। আল্লাহ আপনাকে ইসলাম দিয়ে সম্মানিত করেছেন। আপনার প্রতি আল্লাহ যে সম্মান দেখিয়েছেন, সেটা উপলব্ধী করুন সময় থাকতে।

হোয়াইট হাউজে কিংবা দুনিয়ার কোন রাজপ্রাসাদে আপনার কোন সম্মান নেই, সম্মান রয়েছে আপনার নিজের কাছে, যতোক্ষণ আপনার মধ্যে ইসলাম রয়েছে।

আর আপনার মধ্যে যতোক্ষণ ইসলাম রয়েছে, ততোক্ষণ হোয়াইট হাউজ কিংবা প্যারিসের এলিসি প্রাসাদের চেয়েও বড়ো সম্মানজনক অবস্থানে রয়েছেন আপনি। অতএব দয়া করে নিজেকে চিনুন, নিজের আত্মপরিচয়কে শানিত করুন। ।

- Ziaul Huq

পঠিত : ৯৬৬ বার

মন্তব্য: ০