ফ্রান্সের পন্য বয়কট করে আদৌ কি কোনো লাভ হবে...?
তারিখঃ ২৭ অক্টোবর, ২০২০, ১৮:৫৩
'ফ্রান্সের পন্য বয়কট করে কী হবে?'
সরল প্রশ্ন অনেকের ঠোটেই স্থান পাচ্ছে।
হুম! এই বয়কটে হয়তো ফ্রান্স একেবারে ফতুর হয়ে যাবে না ঠিকই তবে এ প্রশ্নটা শুনে আমার সূরা ইয়াসীনের (১৩-৩২) আয়াত মনে পড়ছে।
"ওদের নিকট এক জনপদের অধিবাসীদের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন কর, যাদের নিকট দু'জন রাসূল পাঠিয়েছিলাম কিন্তু ওরা তাদের মিথ্যাবাদী বললো; তখন তৃতীয় একজন দ্বারা তাদেরকে শক্তিশালী করেছিলাম।
তারা বলেছিলো, 'আমরা রাসূল রূপে এসেছি।' ওরা বললো, 'তোমরা তো আমাদেরই মত মানুষ, দয়াময় আল্লাহ্ তো কিছুই অবতীর্ণ করেননি তোমরা কেবল মিথ্যাই বলছো।'
তারা বললো, 'আমাদের রব জানেন যে আমরা অবশ্যই তোমাদের কাছে প্রেরিত রাসূল। স্পষ্টভাবে প্রচার করাই আমাদের দায়িত্ব।'
ওরা বললো, 'আমরা তোমাদের অমঙ্গলের কারণ মনে করি। যদি তোমরা বিরত না হও তোমাদের অবশ্যই প্রস্তারাঘাতে হত্যা করবো। এবং আমরা তোমাদের মর্মন্তুদ শাস্তি দেবো।'
তারা বললো, 'তোমাদের অমঙ্গল তোমাদের সাথেই আছে। একি এজন্য যে আমরা তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি? বস্তুত তোমরা এক সীমালংঘঙ্কারী সম্প্রদায়।' " [১]
এখান পর্যন্ত দৃশ্যটা একটু কল্পনা করার চেষ্টা করি।
কোনো একটা শহরে দু'জন রাসূল পাঠানো হয়েছিলো। তবুও সেখানের মানুষ বুঝতে চাইছিলনা। তাই আল্লাহ্ রাসূলদের শক্তিশালী করার জন্য সেখানে আরো একজন রাসূল পাঠালেন। তবুও সেখানের মানুষরা ব্যাপারটা মেনে নিতে রাজি হচ্ছিলো না। 'তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ, তোমাদের আমরা অমঙ্গলের কারণ ভাবছি' এসব কথা বলে নিজেরাই নিজেদের আরো বিভ্রান্ত করে দিচ্ছিলো।
আরো একটু গভীরভাবে কল্পনা করতে চেষ্টা করি। এক শহরে তিন জন রাসূল পাঠানোর পরও সে শহরের মানুষরা আল্লাহর দাসত্ব মেনে নিচ্ছিলোনা। শুধু তাই নয়, বরং তারা আল্লাহর তিন জন রাসূলকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অপমানিত করছিলো। তারা তাদের অমঙ্গলের কারণ মনে করছিলো; ফলে তারা রাসূলদেরকে হত্যা করতে উদ্দ্যত হলো। আই রিপিট! এক শহরের সমস্ত মানুষ মিলে তিন জন ব্যক্তিকে (রাসূল হিসেবে তো কেউ মেনেই নিচ্ছিলো না।) অপমানিত করছে ও বলছে ওরা(রাসূলরা) যদি দাওয়াহ্ দেয়া বন্ধ না করে তাহলে তাদেরকে (রাসূলদেরকে) পাথর মেরে হত্যা করা হবে!!
এরকম পরিস্থিতিতে আমি-আপনি থাকলে কী করতাম?
হয়তো কনফিউজড হয়ে এড়িয়ে যেতাম। যেমন, রাস্তায় কাউকে কোনো বখাটে উত্তক্ত করতে দেখলে আমরা এড়িয়ে যাই। ভাবি আমি আর এদের বিরুদ্ধে কী বা করতে পারবো।
আর যদি আমরা বুঝতামও যে ঐ তিন জন মানুষ আসলেই আল্লাহর রাসূল, তাহলে!!
তাহলে হয়তো ভাবতাম, আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহ্ তো বিজয়ী করবেনই। কিন্তু যে মানুষরা আল্লাহর তিন জন রাসূলের কথাই শুনছে না তারা আর আমার কথা কি শুনবে! যেখানে এক শহরের সব মানুষ মিলে মাত্র তিন জন মানুষকে হত্যা করতে চাচ্ছে সেখানে আমার একার পক্ষে আর কি বা করা সম্ভব!
কিন্তু দেখুন সেই শহরেরই একজন সাধারণ মানুষ, আমার আপনার মতই ছা-পোষা মানুষ এমন পরিস্থিতিতে কি করেছিলো।
"তারপর নগরীর এক প্রান্ত থেকে এক ব্যাক্তি ছুটে এলো এবং বললো, 'হে আমার সম্প্রদায়! রাসূলদের অনুসরণ করো। অনুসরণ করো তাদের যারা তোমাদের নিকট কোনো প্রতিদান চায় না এবং যারা সৎপথ প্রাপ্ত। যিনি আমার সৃষ্টিকর্তা এবং যাঁর নিকট আমাদের ফিরে যেতে হবে আমি কেন তাঁর উপাসনা করবো না? তাঁকে ব্যাতীত আমি কি অন্য উপাস্য গ্রহন করবো? দয়াময় আমাকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে চাইলে ওদের সুপারিশ আমার কোনো কাজে আসবে না এবং আমাকে উদ্ধার করতেও পারবে না। এমন করলে আমি অবশ্যই স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পড়বো। আমি তোমাদের রবের বিশ্বাসী তাই আমার কথা শোনো।' " [২]
'তারপর নগরীর এক প্রান্ত থেকে এক ব্যাক্তি ছুটে এলো...'
এই দৃশ্যটা কল্পনা করতে চেষ্টা করি।
এক বিশাল সংখ্যক মানুষ অন্য তিন জন মানুষকে হেনস্তা করতে করতে হত্যার উদ্দ্যেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় শহরের কোনো এক প্রান্ত থেকে একজন লোক হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে ছুটে এল। তাফসীর থেকে জানা যায় তিনি ছিলেন তাতী, রেশমের কাজ করতেন অথবা ধোপা বা মুচি ছিলেন। এবং তিনি একজন কুষ্ট রোগী ছিলেন। [৩] অর্থাৎ, এমনটা না যে সমাজের খুব প্রভাবশালী কেউ যার এক কথায় পুরো শহর নড়ে যাবে। বরং তিনি হয়তো এটা জানতেন যে তার বলা না বলায় কিছুই যায় আসে না। তবুও তিনি এতো বিপুল সংখ্যক লোকের বিরূদ্ধে গিয়ে রাসূলদের সাপোর্ট করেছিলেন। ও নিজের সামর্থ মত শহরবাসীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন।
"তাকে বলা হলো, 'প্রবেশ করো জান্নাতে।'
সে বললো,'হায়! আমার সম্প্রদায় যদি জানতো; কি কারণে আমার রব আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিত করেছেন।' " [৪]
কি ব্যাপার!!
এর আগের আয়াতেই তো লোকটা শহরবাদীদের বোঝাচ্ছিলো আর পরের আয়াতে বলা হচ্ছে ,'জান্নাতে প্রবেশ করো!!'
ব্যাপারটা আমরা কোনো মুভির সাথে মিলিয়ে কল্পনা করতে পারি। মুভিতে যেমন দেখায়, কারো গাড়ির ব্রেক ফেল হয়ে গেছে ! আর একটু হলেই একসিডেন্ট হবে। আর তার পরের সিনটা থাকে, কোনো হস্পিটালে তার পরিবারের মানুষরা কাঁদছে। এ দু'টো সিনের সামারি হলো লোকটা মারা গেছে। ঠিক তেমনি ২০-২৫ আয়াতের পর ২৬ ও ২৭ নং আয়াতের সামারি হল লোকটা খুব বোঝানোর পরও তার সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে পাথর মেরে হত্যা করেছিলো। ফলে সে সরাসরি জান্নাতে প্রবেশ করেছিলো। তারপর ২৭নং আয়াতে দেখা যায় লোকটা জান্নাতে গিয়েও কিছুটা আক্ষেপের সুরে বললো, 'ইশ! যদি আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা জানতো...'
একটা হাদীস শেয়ার করতে খুব লোভ হচ্ছে।
রাসূল(সাঃ) বলেছেন, 'জান্নাতে প্রবেশের পর আর কেউ দুনিয়ায় ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা করবে না, যাদিও দুনিয়ার সকল জিনিস তাকে দেয়া হয়। একমাত্র শহীদ ব্যাতীত; সে দুনিয়ায় ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা করবে যেন দশবার শহীদ হয়। কেননা, সে শহীদের মর্যাদা দেখেছে।' [৫]
২৬ ও ২৭ নং আয়াতে আমাদের ভাবার মত অনেক কিছু আছে।
যে লোকটাকে আল্লাহ্ জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছিলেন ও শহীদের মর্যাদা দিয়েছিলেন সে কী এমন কাজ করেছিলো?
না লোকটা সারাজীবন ইবাদাত করেছিলো; না সে অনেক অনেক রোজা রেখেছিলো; না সে দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে তুমুল বিরত্বপূর্ণ লড়াই করে শহীদের মর্যাদা অর্যন করেছিলো।
তাহলে সে করেছেটা কী?
সে শুধু মাত্র তার দায়িত্ব পালন করেছিলো। তার মৃত্যুর আগ মূহুর্তে রাসূলদের সাপোর্টে বলা শেষ কয়েকটা কথাই তাকে শহীদের মর্যাদা এনে দিয়েছে।
সেই বিপুল সংখ্যাক লোকেদের মধ্যে হয়তো কেউ কেউ বলেছিলো, 'দেখো লোকটা কত বোকা! জেনে শুনে মৃত্যু বেছে নিল।' কেউ হয়তো লোকটার বোকামি দেখে খুব হেসেছিল। আবার কেউ হয়তো বলেছিলো, 'ঠিকই আছে! এতো বোকা মানুষদের এমন পরিনতিই হওয়া উচিৎ।'
কিন্তু দিন শেষে বিশাল সংখ্যাক মানুষের চোখে যে খুব বোকা সেই কিন্তু আল্লাহর প্রিয়পাত্রদের একজন হয়ে গেলেন। হয়ে গেলেন শহিদদের একজন।
এখানে আরো একটা বিষয় লক্ষনীয়; সে কিন্তু দ্বীন প্রতিষ্ঠায় সফল হয়নি। অর্থৎ তার ইফোর্টের কারণে কিন্তু সেই শহরের লোকেরা দ্বীন গ্রহণ করেনি; কিংবা রাসুল্পদেরকে হত্যা থেকেও বিরত হয়নি। বরং তারা তাকেই প্রথম হত্যা করেছিলো। তাবুও আল্লাহ্ তাকে ক্ষমা করেছেন ও সম্মানিত করেছেন। কারন, আমরা দ্বীনের কোনো কাজে ঠিক কতটা সফল হলাম তার থেকে আমরা কতটা ইফোর্ট দিলাম সেটা আল্লাহ্ এর কাছে বেশি অগ্রাধীকার পায়। দ্বীনের বিজয় তো আল্লাহ্ তাঁর নির্ধারিত উপায়ে ঘটাবেনই। সেখানে আমার কোনো অংশগ্রহন থাকুক আর না থাকুক। তবে অংশগ্রহন থাকলে দিন শেষে তা আমার লাভের খাতাই পূর্ণ করবে।
সতরাং বয়কট প্রসংঙ্গেও আমাদের ইফোর্টের ফলে কার কতটা লাভ হচ্ছে সেই হিসেব না কষে আমাদের উচিৎ নিজের সাধ্য মত চেষ্টা করে যাওয়া। হোক সেটা সামান্য পন্য বয়কট এর মাধ্যমে অথবা একটা হ্যাশট্যাগ বা প্রোফাইল পিক এর ফ্রেম চেঞ্জ করাই। হয়তো আমার-আপনার লেখা কোনো ছোট্ট একটা বাক্যই কারো মনে নাড়া দিলো অথবা আল্লাহ্ এর খুব পছন্দ হয়ে গেলো।
তারপর ২৮-৩২ আয়াত আমাদের নিজেদের কাজে আরো সিনসিয়ার হওার জন্য যথেষ্ট!
'আমি তার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আকাশ হতে কোনো বাহিনী প্ররণ করিনি এবং এর প্রয়োজনও ছিলো না। কেবল মাত্র এক মহাগর্জন হলো। ফলে ওরা নিথর নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। পরিতাপ আমার বান্দাদের জন্য; ওদের নিকট যখনই কোনো রাসূল এসেছে তখনই ওরা তাকে ঠাট্রা-বিদ্রুপ করেছে।ওরা কি দেখে না ওদের পূর্বে কত মানবগোষ্ঠিকে আমি ধ্বংশ করেছি যারা ওদের মধ্যে ফিরে আসবে না। এবং অবশ্যই ওদের সকলকে একত্রে আমার নিকট উপস্থিত করা হবে।'
আমাদের রবের আকাশ থেকে কোনো বাহিনী প্রেরণ করে, আমাদের অবাধ্যতার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন হয় না। আল্লাহ্ এর সৈন্য তো কখনো বাতাস, কখনো পানি, কখনো শব্দ, কখনো পাখি, আবার কখনো পরম নির্ভরতায় আমরা যে মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছি সেই মাটি। কত সম্প্রদায় তাঁর অবাধ্যতা করে বিলুপ্ত হয়েছে। অতীত না ঘেটেও যদি আমরা আমদের চারপাশে তাকাই তাহলেও অনেক উদাহারন দেখতে পাবো।
আমরা যদি সেই শহরের একপ্রান্ত থেকে ছুটে আসা লোকাটার মত হই ও ক্ষমা এবং সম্মান প্রপ্ত হই; অথবা যদি বিপুল সংখ্যাক অবাধ্যদের একজন হই ও আযাব প্রাপ্ত হই; যে দলেরই হইনা কেন , আমাদের সকলকে একত্রে আল্লাহ্র সামনে উপস্থিত হতেই হবে।
তাই সময় থাকতেই আমাদের নিজেদেরই ডিসিশন নিতে হবে; ঠিক কি অবস্থায় আমরা আল্লাহ্র সমনে উপস্থিত হওয়াটায়াটা পছন্দ করবো।
[১]৩৬:১৩-১৯
[২]৩৬:২০-২৫
[৩]তাফসির ইবন কাসীর
[৪]৩৬:২৬-২৭
[৫]সহীহ বুখারী, ৪/২৮১৭
- সংগৃহিত
মন্তব্য: ০