Alapon

বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ড(২০১২): পরিবেশনায় ছাত্রলীগ, প্রযোজনায় আওয়ামীলীগ

বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ড(২০১২), পুরা ঘটনাটিকে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বললে কোন অংশেই ভুল হবেনা । চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রে থাকে নায়ক , নায়িকা, তবে এতি যেহেতু একক চলচিত্র, তাই এখানে দ্বিতীয় ধরনের চরিত্রের উপস্থিতি নেই । তবে এর জন্য হতাশ হবার দরকার নেই। শুটিং স্পট , কাহিনী সব ঠিকঠাকই আছে । ছবিটিতে খলনায়ক হিসেবে আছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একঝাক তরুণ জঙ্গি । তাদের নাম রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এমদাদুল হক এমদাদ, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, সাইফুল ইসলাম,কাইয়ুম মিঞা, রাজন তালুকদার,মীর নূরে আলম লিমন,গোলাম মোস্তফা,এ এইচ এম কিবরিয়া,ইউনুস আলী,তারিক বিন জোহর তমাল,আলাউদ্দিন,ওবায়দুর কাদের তাহসিন,ইমরান হোসেন,আজিজুর রহমান,আল-আমিন, রফিকুল ইসলাম,মনিরুল হক পাভেল,কামরুল হাসান,মোশাররফ হোসেন [,] । 


ছবিটির নির্দেশনায় আছেন খ্যতিমান নাড়াচাড়াতত্তবিদ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর,  প্রযোজনায় রয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। পরিচালনায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ। ২০১২ সালে ছবিটির নির্মাণ শেষ হলেও পুরোপুরি মুক্তি পায় ২০১৭ সালের ০৬ আগস্ট [] ।


এবারে চলুন দেখে আসি বহুল আলোচিত এই ছবিটির ট্রেইলারঃ
    https://drive.google.com/open?id=0BxsmKzp3HDsOdFpZREJSRk1YZmM


 


যাই হোক এতক্ষণ গল্পে গল্পে বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ড বর্ণনা করে আসলেও কিছু বাস্তব কথা না বললেই নয় । ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসের ৯ তারিখ রবিবার সকালে ১৮ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ কর্মসূচির সময় ঢাকা জজকোর্ট এলাকা থেকে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আইনজীবীরা একটি মিছিল নিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে যান। এ সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও কবি কাজী নজরুল সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আইনজীবীদের ধাওয়া করেন। তখন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পাম্পের দিকে ধাওয়া দিয়ে আসতে থাকলে আতঙ্কিত পথচারী বিশ্বজিৎ দৌড়ে সেখানকার একটি ডেন্টাল ক্লিনিকের দুই তলায় আশ্রয় নেন। ঘটনা শুরু এখান থেকেই।


এরপরই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সেখানে গিয়ে বিশ্বজিৎকে জাপটে ধরে এলোপাতাড়ি রড দিয়ে আঘাত করতে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁকে ধারালো চাপাতি দিয়ে ডান হাতের গোড়ায় গুরুতর জখম করা হয়। আহত ও পাকড়াও অবস্থা থেকে ছুটে দৌড় দেন বিশ্বজিৎ। তাতেও রক্ষা পাননি তিনি। নিচে নামতেই আবার চারদিক থেকে রড-লাঠির বাড়ি পড়তে থাকে।  এ সময় পথচারীদের কেউ কেউ বিশ্বজিৎকে পাশের ন্যাশনাল হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করলে তাতেও বাধা দেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। এরপর প্রাণ বাঁচাতে আবার দৌড় দেন তিনি। দৌড়ে শাঁখারীবাজারের একটি গলিতে গিয়েই ঢলে পড়ে যান। সেখান থেকে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় এক রিকশাচালক রিকশায় করে বিশ্বজিৎকে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কিছুক্ষণ পর মারা যান বিশ্বজিৎ।হাসপাতালের চিকিৎসকেরা সময়মতো রক্তক্ষরণ কমিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেননি। পরে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ওই হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।


 


বিশ্বজিতের বড় ভাই উত্তম কুমার সে সময় বলেছিলেন, তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন ছাত্রদলের কর্মী ভেবে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁর ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তার এই অভিযোগের সত্যতা মিলল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক জনাব ওয়াহিদুজ্জামান এর কাছে । তার ভাষ্যমতে তিনি কারাগারে থাকা অবস্থায় বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের একজনের সাথে উনার কথা হয়েছিল। সেই ছাত্রলীগ নেতা বেশ দৃঢ়তার সাথে বলেছিল, ওদের মৃত্যুদণ্ড হবে না। ওদের সেভাবে আশ্বাস দিয়েই সারেন্ডার করানো হয়েছে এবং খরচাপাতি দেয়া হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের ১নং আসামী মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত রাজন তালুকদারকে হত্যার আদেশদাতাই ভারতে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছেন। সে আরও বলেছিল- " বিশ্বজিৎ ঘটনার শিকার। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আদেশ ছিল হরতাল পালনকারী কাউকে 'জন্মের শিক্ষা' দিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরী করতে হবে, যাতে কেউ আর হরতালের পক্ষে মিছিল-পিকেটিং করার সাহস না পায়। প্রটেকশনের দায়িত্ব থাকবে পুলিশের। সেই আদেশ অনুযায়ী তারা দায়িত্ব পালন করেছে, পুলিশ প্রটেকশন দিয়েছে। কিন্তু সব গোলমাল হয়ে গেছে ছেলেটা হিন্দু হওয়ায়। ছেলেটার আত্মবিশ্বাস সত্যি প্রমানিত হবে কিনা জানি না। তবে বিশ্বজিত হত্যার আদেশদাতা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর বিচারের আওতাতেই আসেনি "[৪][]। 


 


বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ডের পর জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ছবি ও ভিডিও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হলে সমালোচনায় মুখর হন বিরোধী দলের নেতারা।  এর প্রতিক্রিয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী। পরিবেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বরাবরের মত বলেন, “বিশ্বজিৎকে যারা হত্যা করেছে, তারা ছাত্রলীগের কর্মী নয়, তারা ছিল ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী।”


 


গত ০৬ আগস্ট বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামির মধ্যে রফিকুল ইসলাম শাকিল ও পলাতক রাজন তালুকদারের ফাঁসির রায় বহাল রেখেছে হাই কোর্ট। ত্যুদণ্ড পাওয়া বাকি ছয়জনের মধ্যে চারজনের সাজা কমিয়ে  যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং দুজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর হাই কোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেয়। 


সকলের দাবি, সমস্ত  “আটজন মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামির মধ্যে দুজন খালাস পেল! তা কী করে হয়,” প্রশ্ন রেখেছেন তার ভাই উত্তম কুমার দাস []। আর বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস এমন দরদ মাখা রায় দিবেন নাই বা কেন, যখন তিনি নিজেই আওয়ামীলীগের অনুকম্পা পাওয়া  বিচারপতি। 


 


বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস নিজেই রাজশাহীতে একটি খুনের মামলার প্রধান আসামী।  জানা যায়, ১৯৮৮ সালের ১৭ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল লতিফ হলের ছাত্রশিবির কর্মী আসলামকে তার কক্ষে হত্যা করা হয়েছিল। পরদিন রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানায় ৩০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় প্রধান আসামী ছিলেন তৎকালীন জাসদ ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমান বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস বাবু। মামলাটি নিম্ন আদালতে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় ২০১০ সালের ৮ এপ্রিল মহাজোট সরকার এই মামলা থেকে রুহুল কুদ্দুস বাবুসহ ৯ জনের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। এর তিনদিন পরে (১১ এপ্রিল ২০১০) রুহুল কুদ্দুস বাবুসহ ১৭ জনকে হাই কোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয় []। 


 


পুলিশও মরিয়া ছিল জড়িত ছাত্রলীগকে বাঁচাতে [] । আবার চিকিৎসায় জড়িত ডাক্তার,  সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে যেসব ডাক্তার জড়িত তাদের  ‘গাফিলতি’ও কম নয় । ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার তার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে লিখেছিল, একটিমাত্র আঘাতের ক্ষত থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণই বিশ্বজিৎ দাসের মৃত্যুর কারণ। 


 


পরিশেষে একটি কথাই বলতে চাই, মানুষের জন্যই রাজনীতি, রাজনীতির জন্য মানুষ নয় । তাই যে কোন রাজনৈতিক,কর্মসূচি,হরতাল,অবরোধের ক্ষেত্রে আহ্বানকারী পক্ষ ও বিরোধীপক্ষকে গণতন্ত্র রক্ষা ও আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখার জন্য গভীর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়া আশঙ্কা, জন সাধারণের শান্তিভঙ্গ বা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা, সম্পত্তির ক্ষতিসাধন না হয়।






রেফারেন্সঃ








 

আরোও দেখুনঃ






 


 


 



 


পঠিত : ১৪৩১ বার

মন্তব্য: ০