Alapon

যাঁর ছোঁয়াতে বদলে গেলো দিদ্বিদিগ......

জীবনের ভারসাম্য নিয়ে বহুবার ভেবেছি আমি। পৃথিবীর ইতিহাসের অনেক বড় বড় মানুষের জীবনেতিহাস ঘেটেছি। মজার ব্যাপার হলো, কারো কারো জীবনে অদ্ভূত সব পাগলামীও আবিষ্কার করেছি। তাঁদের সেসব পাগলামীকে নেহায়েৎ শিশুবৎ আচরণ বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না বোধকরি।। দুই একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।


কাজী নজরুল ইসলাম ২২ বছর বয়সে প্রথম বিয়ে করেছিলেন কুমিল্লার মুরাদনগরে।। ভালোবেসে কনের জন্য নিজেই একটি নাম ঠিক করে দিয়েছিলেন- নার্গিস। বিয়েটির ব্যাপারে কনের বাবা এবং বড়ভাইদের আপত্তি থাকা সত্বেও মামার প্রবল ইচ্ছেতে শেষ অব্দি পরিণয়ে গড়ায়। বেশ ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে হলো। অনেক বাদ্য-বাজনার ব্যবস্থা করে বর এবং কনের মন উৎফুল্ল করে রাখার ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু বরের মন বড় আজব চিজ! কোনো এক অজানা অভিমানে বিয়ের রাতেই নববধূকে রেখে পাড়ি দিলেন অজানার উদ্দেশ্য়ে।


আনিস সাবেতের বোনের বিয়ে হবে কুমিল্লায়। আহমদ ছফা, হুমায়ূন আহমেদসহ বেশ কয়েকজন মিলে গেলেন কুমিল্লায়। রাত ৮ টার মতো বাজে। সাহিত্য নিয়ে জম্পেস আড্ডা জমে গেছে। আড্ডার মধ্যেই আনিস সাবেত আহমদ ছফার একটি উপন্যাস নিয়ে সমালোচনা করলেন। সমালোচনা শুনে আহমদ ছফা রেগে গেলেন এবং যানবাহন না পাওয়া সত্বেও হেঁটেই কুমিল্লা থেকে ঢাকায় চলে এলেন।


এই হলো কবি, লেখক, সাহিত্যিকদের পাগলামী! তাঁরা পরিচালিত হন প্রচন্ড রকম ভাবাবেগ দ্বারা। অন্য দিকে একজন রাসূল কি এরকম অসংলগ্ন আচরণ করতে পারেন? না, পারেন না। এখানেই কবি এবং নবীর পার্থক্যটা। ইতিহাসের মঞ্চে এরকম অসংখ্য জগদ্বিখ্যাত মানুষের দেখা মিলবে, যাঁরা তাদের জীবনের একটি বিশেষ অংশে মনোযোগ দিতে গিয়ে এতো বেশি নিমগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে, জীবনের অন্যদিকে তাকানোর ফুরসতই তার হয়ে ওঠে নি।


রাসূল (সা.) সেখানে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। রাসূল (সা.) এর জীবনের কোনো একদিকে চরম বাড়াবাড়ি, অন্যদিকে চরম উদাসীনতার কোনো দৃষ্টান্ত কেউ দেখাতে পারবে না। অনুপম ভারসাম্যের এক অপূর্ব নজরানাই রাসূল (সা.) এর জীবন। সেখানে আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি রয়েছে বৈষয়িকতার সমন্বিত অবদান। দ্বীনের সাথে রয়েছে দুনিয়াও। প্রগাঢ় ধর্মীয় চেতনা ও আবেগের সাথেই রয়েছে সর্বাত্মক রাজনীতি। জাতির নেতেৃত্বের কর্কটকঠিন দায়িত্বের সাথেই রয়েছে রাতে চাঁদের আলোতে স্ত্রীর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগীতা। এমন ভারসাম্য আর কে দেখাতে পেরেছে কার জীবনে কবে!


এ কথা আজ আমাদের জেনে এবং বুঝে নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, রাসূল (সা.) এর জীবন কোনো পুষ্করিনীর স্থির পানির মতো নয় যে, তাঁর এক কিনারে দাঁড়িয়ে এক নজরেই তা অনুধাবন করা যাবে। বরং এটা একটা প্রবাহমান নদী, যাতে বেগবান স্রোত রয়েছে, গতি ও সংঘাত রয়েছে, তরঙ্গ ও ফেনা রয়েছে, ঝিনুক ও মুক্তা রয়েছে। এর পানির কল্যাণে মৃত ভূমি প্রাণ ফিরে পায়। এ নদীর রহস্য বুঝবার জন্য এর স্রোতের সাথে সাথে চলতে হয়।


কিন্তু বছরের পর বছর ধরে সহস্র, লক্ষ মানুষ রাসূল (সা.) সীরাত অধ্যয়ন করে আসছে অথচ তাদের মধ্যে প্রেরণা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হচ্ছে না। সংকল্পে নতুন জোঁয়ার আসছে না। আকাঙ্খার সেই স্ফূলিঙ্গ আমাদের হস্তগত হচ্ছে না, যার উত্তাপ একজন নিঃসঙ্গ, নিঃসম্বল ও আশ্রয়হীন মানুষকে শত শত বছরের পুঞ্জিভূত বাতিল ব্যবস্থার সাথে লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলো।


এ জন্য রাসূল (সা.) এর জীবনকে সত্যিকারার্থেই এর আসল রূপে দেখতে অভ্যস্ত না হয়ে উঠতে পারলে এ সমাজব্যবস্থা বদলানোর কোনো আবেগ মানুষ অনুভব করবে না। যেভাবে হযরত উমর (রা.) এর মতো একজন মদখোর যুবক আপাদমস্তক বদলে গিয়ে পরিণত হয়েছিলেন অর্ধ পৃথিবীর খলিফায়। আব্দুল্লাহ যুল বাজাদাইন বিলাসী জীবন ত্যাগ করে বেছে নিলেন দরবেশী জীবন। এই তো পরিবর্তন। এই তো বদলে দেয়ার কারিগরের অভূতপূর্ব নৈপূণ্য!

পঠিত : ৩৩৯ বার

মন্তব্য: ০