Alapon

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে জীবনসঙ্গীনি নির্বাচন করুন......

বেশ কিছুদিন ধরে আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আমার সৌভাগ্য, ছাত্রাবস্থাতেই আমি অর্ধ ডজন পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাবনা পেয়েছি। বারবারই ভাবছিলাম, মেয়ের কোনো একটা গুণকে একটু বেশি গুরুত্বের মধ্যে রাখবো। রাসূল (সা.) বিয়ের ক্ষেত্রে ৪ টি গুণ দেখতে বলেছেন। এর মধ্যে শুধু দ্বীনদারিতাকে প্রাধান্য দিয়েও যে কেউ বিজয়ী হয়ে যাবে; এমন আশ্বাসও দিয়েছেন। তাই মনে মনে ঠিক করে রাখলাম, আর যাই হোক, দ্বীনদারিতাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবো।


কারণ, দোয়া এবং সৎগুণাবলীর শক্তি আমি দেখেছি। যে তায়েফে রাসূল (সাঃ) এর সঙ্গে অসদাচারণ করা হয়েছিলো, সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি তাদের ধ্বংস না চেয়ে দোয়া করেছিলেন। তাঁর দোয়ার ফসল হিসেবে সেই মাটি থেকে জন্ম নিয়েছিলেন ইসলামের এক বীর সন্তান; মুহাম্মদ বিন কাসিম। এই মুহাম্মদ বিন কাসিম হলেন সেই সেনাপতি, যিনি মাত্র ১৭ বছর বয়সে সিন্ধু বিজয় করে ভারতের মাটিতে ইসলামের শেকড়কে প্রোথিত করেছিলেন।


একজন সৎ গুণসম্পন্না নারীর শক্তি আরও অনন্যসাধারণ। যুগের পর যুগ ধরে তাঁর গর্ভ দুনিয়া আলোকিত করতে থাকে। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সেই নারী, যাঁকে এক রাতে উমর (রা.) আবিষ্কার করেছিলেন এবং নিজের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মা দুধে পানি মেশাতে চেয়েছিলো আর তিনি মাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “খলিফা উমর (রা.) এই দৃশ্য না দেখলেও আল্লাহ তো দেখছেন।” তাঁর এরকম উক্তিতে উমর (রা.) বিস্মিত হয়ে যান এবং নিজের ছেলের সঙ্গে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন।


ঐ নারীর নাতনী উম্মে আসেম লায়লা বিনতে আসেমের সঙ্গে বিয়ে হয় আব্দুল আজিজের। তিনি বিয়ের আগে তাঁর সহকারীকে বলেছিলেন, “আমার বৈধ উপার্জন থেকে ৪০০ দিরহাম আলাদা করে রাখো। আমি অত্যন্ত সৎ পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করবো।” এই দম্পতিরই সন্তান ইসলামের ৫ম খলিফা হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রহ.)। একজন সৎ নারীর গর্ভের ফসল তো এমনই হবে!


উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) খেলাফতের মসনদে আরোহণ করে পুরো খেলাফতের চেহারাই পাল্টে দেন। পূর্ববর্তী উমাইয়া খলিফাগণ রাজতান্ত্রিক ও পরিবারতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পাশাপাশি মানুষের মধ্যে যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন ওমর এসে সেসব ধুলোয় মিশিয়ে দেন। ফিরিয়ে আনেন খেলাফতে রাশেদার সেই সোনালীকাল।


উমর ইবনে আবদুল আজিজ ৬১ হিজরিতে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করার পূর্বে তিনি মদিনার গভর্নর ছিলেন। মদিনার গভর্নর থাকাকালে তার উঠা-বসা চলা-ফেরা এবং বেশভূষায় ছিল একজন অভিজাত ও সৌখিন যুবকের ছাপ। মানুষ আতরের ঘ্রাণ শুঁকলেই বুঝতে পারত একটু আগে এ রাস্তা দিয়ে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ গিয়েছেন। তার পাগড়ি-টুপি, পোশাক, জুতা, আতর এবং অন্যান্য ব্যবহার্য সামগ্রীর মূল্য ছিল আকাশছোঁয়া।


কিন্তু সেই ওমর যখন খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন সাথে সাথেই তার চলাফেরা ও বেশভূষায় আমূল পরিবর্তন চলে এলো। পূর্বের জৌলুস ভরা জীবন পরিত্যাগ করে সরল ও সাধারণ জীবন গ্রহণ করলেন। নিজের সংস্কার সাধন করার পর তিনি রাষ্ট্রীয় সংস্কার কাজে হাত দিলেন। রাষ্ট্র তখন নানা উপায়ে জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় এবং তা আমির ওমরাদের পিছনে ব্যয় করার একটি সংস্থায় পরিণত হয়েছিল। তিনি সমস্ত অন্যায়মূলক কর ও ট্যাক্স বাতিল করে দিলেন। মহলে দাসী ও বাদীর সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনেন।


চার খলিফার আমলে খলিফার দরবারের যে সরল ও সাদাসিধে চেহারা ছিল উমাইয়া খলিফাগণ এসে তা পাল্টে দিয়েছিলেন। এর মূল কারিগর ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া। সিংহাসন, রাজকীয় বেশভূষা, প্রহরী, দরবারে গণমানুষের প্রবেশ সীমাবদ্ধ করে দেয়া -এসব তারই সংযোজন।


পরবর্তী খলিফাদের আমলে রাজদরবার পরিণত হয়েছিল কবি, বাগ্মী, বিতার্কিক ও চাটুকারদের এক আখড়ায়। ওই সময়ে রাজদরবারের ছত্রছায়ায় কবি ও গায়কদের দৌরাত্ম্য কতটা বেড়েছিল একটা ঘটনার মাধ্যমে তা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে -একবার ইরাকের প্রখ্যাত গায়ক হুমায়ূনকে মদিনায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। একটি ঘরে তার গানের জলসা বসেছিল। সেই ঘরে দর্শকদের এত ভিড় হয়েছিল যে ছাদেও দর্শক উঠেছিল তার গান শোনার জন্য। একপর্যায়ে তাদের চাপে সেই ঘরের ছাদ ধসে যায়, স্বয়ং গায়ক হুমায়ূনও নিহত হয়।


দায়িত্ব গ্রহণ করামাত্রই এসব দরবারি কবি ও চাটুকারদেরকে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহ. বিদায় করেন। সাধারণ মুসলমানদের মধ্য থেকে জাহিলি যুগের এই ধরনের প্রবণতা দূর করার জন্য তিনি ব্যাপক দাওয়াতি কর্মকাণ্ড হাতে নেন। আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. তার তারিখে দাওয়াত ওয়া আযিমাত কিতাবে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহ.-এর জীবনের একটি অনন্য দিকে তুলে ধরেছেন।


মুসলিম বাহিনীর উদ্দেশ্যে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহ. বলেছিলেন আমরা শত্রুদের বিরুদ্ধে যে জয় লাভ করি সেটা শুধুমাত্র এই কারণে যে তাদের পাপ ও গুনাহ আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। অন্যথায় শক্তি-সামর্থ্য, অস্ত্র ও সৈন্য সংখ্যা ইত্যাদির বিবেচনায় আমরা কোনভাবেই তাদের সাথে জয়লাভ করার মত নই। এখন আমরা নিজেরাই যদি গুনাহ করতে থাকি এবং আমাদের গুনাহের পরিমাণ যদি তাদের গুনাহের সমান হয়ে যায় তাহলে তো আমাদের বিজয় লাভ করার শেষ উপায়টুকুও শেষ হয়ে গেল।


বর্তমান সময়ে মুসলিম জাতি বিশ্বব্যাপী যে মার খাচ্ছে উপরোক্ত কথা চিন্তা করলে সেটার কারণ আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়। রাষ্ট্রের সংস্কার, মুসলমানদের মধ্যে সংস্কারকাজ, দেশজয় এবং বিশ্বের বিস্তৃত অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের বিশাল কর্মযজ্ঞ ওমর একসাথে হাতে তুলে নেন। তাঁর নিষ্ঠা এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে রঙ হারাতে বসা মুসলিম সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে খেলাফতে রাশেদার রূপ ফিরে পেতে থাকে। এমনকি ইতিহাসবিদগণ ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে পঞ্চম খলিফায়ে রাশেদা এবং তাঁর খেলাফতকালকে খেলাফতে রাশেদার অন্তর্ভুক্ত মনে করেন।


এ জন্য জীবনসঙ্গীনি নির্বাচন জীবনের খুব গুরুত্বপূর।ণ একটা সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তে আবেগ দাবার পরিচালিত হবার পরিবর্তে পরিচালিত হতে হবে বিবেক দ্বারা। জেনে-বুঝে-ভেবে-চিন্তে এগুতে হবে। কারণ তাঁর গর্ভ থেকেই আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জন্ম নিবে। কেমন মায়ের গর্ভ থেকে জন্মলাভ করবে; তা এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রহ.) এর মতো উত্তরপ্রজন্ম পেতে চাইলে মা নির্ধারণ করতে হবে তেমনই।

পঠিত : ৪৩৮ বার

মন্তব্য: ০