Alapon

||মানুষের প্রতি দয়া||




১. আব্দুল আজীজ সাহেব রেগে মেগে অস্থির। রাগে কটমট করে তাকিয়ে আছে মালিহার দিকে। সকাল হয়েছে সেই কখন, অথচ এখন অবধি মেয়েটা তাঁকে চা-পৌঁছাতে পারলো না। বৃদ্ধ মানুষ। এই বয়সে তো চা-টাই একটু ভালো লাগে। অথচ আজ এখনো চা পান করতে পারেনি!


মালিহা চা নিয়ে এসেছে। চা মুখে দিতেই তিনি চা-সমেত কাপটাকে মারলেন একটা আছাড়! মালিহা ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

- অ্যাঁই মেয়ে, কী বানাইছিস এইটা, বলতো শুনি? বলছি না মিষ্টি বেশি দিতে? গাঢ়ো লিকারে তাড়াতাড়ি সকালে আর সন্ধ্যায় চা দিতে। কতোদিন বলছি যেনো দেরি না হয়,মিষ্টি কম না হয়, হুম!
- খালু আইজকা অনেক কাম আছিলো। তিহানকে তাত্তারি কইরা স্কুলে নিয়ে যাইবার কইছিলো খালাম্মা, ওর মায়ের অসুখ করছে। তিনি যাইবার পারছে না, তাই আমারেই নিবার কইছে, হের লাইগা দেরি অইছে! আর ঘরে তো চিনি নাই। কালকাই তো আমনেরে কইছি। কেউই আনে নাই। যেটুক আছিল, তা দিয়াই বানাইছি....

-কথাটা না শেষ করতেই আব্দুল আজীজ সাহেব দিলেন কড়া একটা ধমক! আর বললো দ্রুত করে চিনি আইনা তারপর চা করে দিতি। তা করলি না ক্যান? হুম! অপদার্থ মাইয়্যা কোথাকার! ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে দিলো মালিহা!


২. আজীজ সাহেবের বড়ো ছেলে প্রবাসী। প্রতি মাসে তিনি সংসারের খরচের জন্য তাঁর বাবার কাছে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা পাঠান। তাঁর বাবা আজীজ সাহেব এরপর বাকী বিষয়গুলো দেখাশোনা করেন। নিজের অবসরের আগেই ছেলেকে তার পথ ধরিয়ে দিয়েছেন। অবসরের পর তো আর আয়-রোজগারের ব্যবস্থা নেই। পুরুষের পকেটে টাকা না থাকলে তখন নিজেকে অথর্ব অথর্ব মনে হয়। মনটা খিটখিটে হয়ে থাকে। ছেলে বলে বিষয়টা বুঝেন। তাই টাকা-পয়সা তার বাবার কাছেই পাঠায়। তিনি বাসার সকলের জন্যই যারযার প্রয়োজন মতো নিজের বাবার নিকট মাস শেষে পাঠিয়ে দেন। আর তার বাবা এরপর সকলকে সকলের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেন। একটা বাস্তব কথা হচ্ছে পুরুষ মানুষ খরচের মাঝেই আনন্দ পায়। আজীজ সাহেব বৃদ্ধ মানুষ হলেও তাঁর মাঝ থেকে সেই আনন্দটা হারিয়ে যায় নি। আসোলে আজীজ সাহেব লোকটা একজন ভালো অভিভাবকও বটে।


বাসায় বাজার-সদাই করতে হবে। আঃ আজীজ সাহেব তাঁর নাতি মেহরানকে সঙ্গে নিয়েই বাজারে গেলো। নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদী ক্রয় করে রিক্সায় ওঠে নামলেন বাসার সামনে। অনেকগুলো মাল-সামান। চালের বস্তা। ডাল-সবজি-আঁটাসহ নানান কিসিমের জিনিসপত্র। মেহরান একটা ব্যাগ নিয়ে বাসায় ওঠে গেলো। আজীজ সাহেব চাল-সবজিসহ কিছু ব্যাগ বস্তা একসঙ্গেই রিক্সাওয়ালা লোকটার মাথায় তুলে দিলো। পেছন পেছন নিজেও সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠছে। মেহরান নামতে গিয়ে দেখে রিক্সাওয়ালা লোকটার মাথা আর হাত ভর্তি সদাই-পাতিতে। সেই অবস্থায় তাদের চারতলা ফ্ল্যাটে আসতেছে রিক্সাওয়ালা লোকটা। লোকটার কষ্টই হচ্ছে। মেহরানও বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছে।
তার হাত থেকে মেহরান দুটো ব্যাগ টেনে নিজের হাতে নিয়েছে।

আজীজ সাহেব তা দেখেই হালকা একটা ধমক দিয়ে বলে ওঠে -
অ্যাঁই, তোমাকে কে ধরতে বলছে এটা হুম? তাকে তো আর ফাও ফাও টাকা দেবো না!

-আরেহ থামো তো! কিচ্ছু হবে না, বলেই দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজিয়ে দিলো মেহরান।

-পাওনাকড়ি বুঝিয়ে বিদেয় দিলো রিক্সাওয়ালা লোকটাকে।


৩. মেহরান যেমন মেধাবী-বুদ্ধিমান, তেমনিভাবে প্রজ্ঞাবানও বটে! সকালে মালিহার বিষয়টি দেখেও সে তখন কিচ্ছু বলে নি। এখন রিক্সাওয়ালার এই বিষয় নিয়েও তার দাদাভাইকে সরাসরি কিছুই বলে নি সে। সে জানে, মানুষ যখন মন মেজাজ খারাপ থাকে, মুড ভালো না থাকে, কিংবা রাগের অবস্থায় থাকে; তখন সে ব্যক্তিকে কোনো ভালো কথা বলাও ঠিক না। একেবারেই অনুচিত। কারণ, তখন হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা-ই বেশি থাকে। সে জন্যে যখন পরিবেশ ঠান্ডা হবে, মানুষের মুড ভালো হবে, তখনই কারো যদি ভুল থাকে, সে ভুল শুধরে দেওয়ার দরকার পড়ে, কিংবা কাউকে কিছু বুঝানোর প্রয়োজন হয় - তখন সেই ফুরফুরে মেজাজে বা পরিবেশেই তা সংশোধন করা দরকার। সে সময়ই মানুষ দরদমাখা ভাষা পেলে সংশোধন হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।


মানুষকে সংশোধন, মানুষের কল্যাণকামী হয়ে কীভাবে ভুলগুলো শুধরে দেয়া যায় তা তানিমের সাথে থেকে খুব ভালোভাবেই আয়ত্তে এনেছে সে।

৪. মাগরিবের স্বলাত শেষ। আজীজ সাহেবের চা-পানের সময় হয়ে গেছে। এদিকে মেহরান কম্পিউটারটা অন করে ফেসবুক লগইন করেছে। উদ্দেশ্য তার দাদাভাইকে, এবং বাসার সবাইকে মানুষের সাথে, কাজের লোকের সাথে ক্যামন আচরণ করতে হয়- সে সম্পর্কে কুরআন হাদিসের দৃষ্টিভঙ্গী কী তা তুলে ধরা। গতো পরশুই তানিম মোটামুটি বড়োসড়ো একটা আর্টিকেল লিখেছে। ছেলেটা যেমন সুন্দর বলতে পারে তেমন সুন্দর লিখতেও পারে। মেহরান তার আইডি সার্চ করে লেখাটা এনে ফুল স্ক্রিন করে সামনে রেখেছে। হঠাৎ সে তার আম্মু,দাদা-দাদি, একমাত্র ছোটো বোন ও ছোটো চাচ্চুকে ডেকে এনে বললো,

-দেখো তো লেখাটা ভালো না? আমার কাছে ভালোই লেগেছে। মেহরানের কৌশলটা আসোলেই ভালো লাগে। সে কাউকে কখনোই বলে না এটা ভালো, বা এটা পড়ো। সে জাস্ট এতোটুকুনই বলে -লেখাটি বা বক্তৃতাটি কিংবা বিষয়টি আমার দারুণ লেগেছে, ভালো লেগেছে- এই ধরণের কোনো শব্দ বা কথা।

-ছোটো চাচ্চু সামনে এসে বললো কই দেখি!
-মেহরান লেখাটি থেকে আয়াত হাদিস সমূহ সকলের সমানে দেখিয়ে বললো এই তো,


''পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর। আর, নিকটাত্মীয়, এতীম, অভাবগ্রস্ত, নিকট-প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, পথ শিশু, এবং নিজের চাকর-চাকরানীর প্রতি অনুগ্রহ করবে”। [সুরা-নিসা – ৩৬]


আবু যার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহু ওয়া সাল্লাম) বলেন, “তারা তোমাদেরই ভাই যাদেরকে আল্লাহ তোমাদের অধীন করেছেন। তাই যার ভাইকে আল্লাহ তার অধীন করেছেন, সে যেন তাকে তা-ই খাওয়ায় যা সে নিজে খায়। তাকে যেন তা-ই পরায় যা সে নিজে পরে। তার উপর যেন অতিরিক্ত কাজের বোঝা না চাপায়। আর যদি অতিরিক্ত কাজ দিয়ে থাকে তাহলে যেন তাকে সাহায্য করে।” (বুখারি, ৬০৫০)


জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করবে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করবেন না।’’ [বুখারি৬০১৩, ৭৩৭৬, মুসলিম ২৩১৯, তিরমিযি ১৯২২]


- লেখাটা পড়ে ছোটো চাচ্চু বলে ওঠে মা শা আল্লাহ!
- তা হলে এ থেকে আমাদের শিক্ষা কী?" প্রশ্নজুড়ে দিলো মেহরানের আম্মু!
-মেহরান বলে ওঠলো এ আর কঠিন কী আম্মু! স্পষ্টই তো সব! মা বাবার সঙ্গে সৎ ব্যবহার, আত্মীয়-পড়শী, চাকর-চাকরানী, কাজের লোক, অসহায় মানুষের সাথে অনুগ্রহ মূলক আচরণ করতে হবে। নিজের অধীন লোকদের ওপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে না দেয়া। নিজের কাজ তাদেরকে টাকা দিয়ে করানো হলেও সাধ্যানুযায়ী তাদেরকে সাহায্য করতে চেষ্টা করা। এবং মানুষের প্রতি দয়া-মায়া আর ভালোবাসা ও সহমর্মিতার হাত প্রসারিত করা। আমরা মানুষেরা যদি আল্লাহর দয়া-রহমত পেতে চাই, তা হলে সেই রহমত ও দয়া-মায়ার যে হাত, সেই হাতটা অন্য মানুষের প্রতিও প্রদর্শন করতে হবে!

- একজাক্টলি, সত্যি তাই। সুন্দর বলেছো মেহরান! '' বলে ওঠলো ছোটো চাচ্চু।

- জাযাকাল্লাহ চাচ্চু, তা হলে সকলকে যে কারণে ডেকেছি সে কাজ শেষ, তোমরা যারযার কাজে যেতো পারো, বললো মেহরান!

সকলেই যার যার রুমে চলে গেলো। এদিকে আজীজ সাহেব চায়ের জন্য ডাক দিলেন -মালিহা........

মেহরান লক্ষ্য করলো খুব সুন্দর একটা ডাক। সে ডাকের মাঝে মাধুর্যতা আছে । এই ডাকের মাঝে আগের সেই গর্জন নেই, তর্জন নেই। নেই কোনো উত্তাপ!

এদিকে মালিহাও গরম চায়ের কাঁপ নিয়ে হাজির।
ধোঁয়া ওঠা কাপে ঠোঁট ঠেকিয়ে চুমুক দিয়ে নিমেষেই তাজা হয়ে ওঠার তো কোনো জুড়ি নেই। এতোক্ষণ চুপচাপ নিস্তব্ধ মেহরানের দাদাভাইও চুমুকের সাথে সাথে নিমিষেই যেনো তাজা হয়ে ওঠেছেন।
শরীরের সঙ্গে ফুরফুরে মনটাও। মস্তিষ্ক সতেজ ও ধারালো করতেও নাকি এক কাপ চা-ই যথেষ্ট। হলোও তাই। মেহরানদের সেই পড়া আর আলোচনাটা এতোক্ষণ পরেই যেনো ওনার চিন্তার মধ্যে একটা নাড়া দিয়ে ওঠেছে। হালকা নয়। তীব্রভাবেই!

মেহরান কলম হাতে সাদা কাগজে খচখচ শব্দে কী যেনো লিখে যাচ্ছে। তার মুখের মাঝে মিষ্টি হাসির ঝলকানি। প্রায় সবসময়ই তার মুখে মিষ্টি করে মুচকি হাসির দ্যোতনা লেগেই থাকে। হাসির মাঝে এক অপূর্ব সুন্দর মিষ্টতা এবং প্রজ্ঞার প্রখরতা যেনো ঠিকরে পড়ে।

চা হাতে শ্যামবর্ণের মেহরানের মায়াবী মুখের মিষ্টি হাসির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আজীজ সাহেব। মনে মনে তার আজকের কৌশলী শিক্ষার তা'রিফ করছেন তিনি। যে শিক্ষাটার জন্য হয়তো তিনি এখন বাকী সামান্য যে জিন্দেগী আছে, তাতে মানুষের প্রতি দয়াদ্র আচরণ করে আল্লাহর দয়া ও রহমত কুড়িয়ে নিতে অনেক বেশি সহায়ক হবে। আর যে নাতি ইসলামের ও জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয়গুলোকে এতো সুন্দর, সুশৃঙ্খল,সুবিন্যস্ত করে শেখাতে পারে -এমন একটা নাতির জন্যে গর্বে তার বুকটা ফুলে উঠতেই পারে!

বংশে এমন একটা রত্ন দান করায় রব্বুল আলামিনের প্রতি কৃতজ্ঞতার অশ্রুতে ভরে ওঠে তাঁর আঁখিদ্বয়।


||মানুষের প্রতি দয়া||
~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৫২২ বার

মন্তব্য: ০