Alapon

আমার যখন ফুরাবে দিন.........

অনেক বাঁধা-বিপত্তি, ঝড়-ঝঞ্চা উপেক্ষা করে যখন আমরা বাড়িটিতে পৌঁছলাম তখন নিশুতি রাত। আকাশে পূর্ণিমা নেই। চারদিকে গা ছমছমে অন্ধকার। বাংলাদেশের প্রান্তিক জনপদের একটি নিভৃত গ্রাম। আমি কিছু বিরল প্রাগৈতিহাসিক গ্রাম্য দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম। এর একটি হলো, গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ এসে পৌঁছায় নি। কেরোসিনের প্রদীপ নিয়ে লোকজন ছোটাছুটি করছে। সবার চোখে মুখে শোকের কালো ছায়া।

প্রচন্ড শোকের গায়েও এক ধরণের উৎসবের আবহ মেশানো থাকে। সবাই সেটা ধরতে পারে না। কেউ কেউ পারে। আমি ধরতে পারলাম বলে মনে হলো। বাড়ির উঠোনে মুরব্বীরা গোল হয়ে বসে আছেন। তাদের মুখ অসম্ভব গম্ভীর। জীবনের নশ্বরতার ভাবনাটি হয়তো আরেকবার হৃদয়ে প্রবলতম উচ্ছ্বাসে জাগরূক হয়ে উঠেছে। আমি উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখছি একজন মানুষকে বিদায়ের আয়োজন।

জীবন রহস্যময়। মানুষের সমগ্র জীবন কেটে যায় সেই রহস্যের সমাধানের সন্ধান করে করে। মৃত্যুই কি তবে সেই রহস্যের সমাধান? কিন্তু একজন মানুষ যখন সেই রহস্য ভেদ করে ফেলে, তখন তার আর তা জানিয়ে যাবার উপায় থাকে না। ফলে সেই অজানা রহস্যভেদ জীবনকে করে তোলে আরও বেশি রহস্যাবৃত। বাড়ির ভিতর থেকে মহিলাদের চাপা কান্নার আওয়াজ আসছে।

ব্যথা ও বেদনার ভারিত্ত যখন সহ্যসীমা অতিক্রম করতে চায়, তখন তা অশ্রুর ধারার রূপ পেয়ে চোখ বেয়ে নেমে এসে হৃদয়ের অব্যক্ত যন্ত্রণাকে খানিকটা প্রশমিত করে। মুক্তোর মতো চিক চিক করতে থাকা অশ্রুগুলোতে কত ব্যথা, কত হাহাকার, কত আর্তনাদ, কত স্মৃতি মিশে থাকে; কে কবে লক্ষ্য করেছে তা গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে! পাড়া-প্রতিবেশিরা কেবল সান্ত্বনার বাণী শোনাতে চায়। সে সান্ত্বনায় লাভ হয় না বরং অনুভূতির আটলান্টিক আরও খানিকটা উত্তাল হয়ে ওঠে।


আমি ভাবতে লাগলাম মানুষটির জন্মের মুহূর্তটি নিয়ে। তার স্বজনদের হাসি হাসি মুখের ছবি। আগমন বেলায় পৃথিবী মানুষের জন্য উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরী করে। বিদায় বেলাতেও করে। কিন্তু দুই আয়োজনে কী ভীষণ ব্যবধান! লাশকে গোসল করানো হচ্ছে। গোসলের চারদিকে পর্দা টানানো। উঠানের একপাশে মাদরাসার ছাত্ররা সুর করে কোরআন শরীফ পড়ছে। তাদের চেহারায় শোকের চিহ্নের বদলে নির্লিপ্ততা খেলা করছে। যেন মানুষের এই চিরায়ত বিদায়দৃশ্যের সঙ্গে তারা খুব ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত।


লাশ দাফন হবে সকালে। আজ রাতটিতে তার আত্মীয়-স্বজনের কারোর চোখেই ঘুম নামবে না। ঘুমজাগা অসংখ্য চোখ কান্না এবং দোয়া-দরুদ মিশিয়ে পার করবে রাতটি। কারো কারো মনে পড়বে অতীত স্মৃতি। আস্তরণ পড়ে যাওয়া অতি প্রাচীন স্মৃতিগুলোও বুকে ঢেউ তুলবে আজ। একদিন গভীর রাতে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরে মানুষটা বলেছিলো, “গরুর মাংস কিনে এনেছি। বেশি করে ঝাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করো তো, যেন ঝালে চোখে পানি এসে যায়।” বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠবে তখন।


উঠোনের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকগুলো জটলা। কোনো কোনো গ্রাম্য মহিলা আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে আছে। তারা অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকাচ্ছে এদিকে সেদিকে। স্বজনদের কান্না দেখছে। হয়তো বুঝতে চেষ্টা করছে, কার শোকের মাত্রা কতটা। কেউ কেউ হয়তো বলছে, “আহারে! কালকেই মানুষটাকে ভালো দেখলাম।”


এই শোকমিশ্রিত পরিবেশ থেকে আমি খানিকটা বাইরে বেরিয়ে এলাম। লাশের জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছে বাড়ির পিছনে। আলোর ব্যবস্থা করতে জ্বালানো হয়েছে বড় একটা হ্যাজাক লাইট। কবরে যিনি নেমেছেন তার নাম সম্ভবত শামছু মিয়া। এই অঞ্চলে কবর খোঁড়ার জন্য বিখ্যাত লোক। আমি কবরের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম এবং মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, কবর খনন নিছক একটি কর্ম নয় বরং শিল্পকর্ম। এ মানুষের চিরন্তন আবাস। স্থায়ী শয্যা। একদিন আমারও দিন ফুরাবে এবং এখানে এসে শয্যা পাতবো। সেই দিন পৃথিবী কি আমার জন্যও কাঁদবে একটুখানি?

পঠিত : ১০০৯ বার

মন্তব্য: ২

২০২০-১১-০৫ ০০:১১

User
রেদওয়ান রাওয়াহা

ভাই, এমন ধাঁচের লেখা, গানের ভাষায়, আমারও ভালো লাগে। খুব খুশি হলাম????????

submit

২০২০-১১-০৯ ২১:০৮

User
আহসান লাবিব :

অনেক ধন্যবাদ ভাই।

submit