Alapon

রাসূল (সা.) এর অন্দরমহল.....

মানবেতিহাসের সবচেয়ে রোমান্টিক জীবনসঙ্গী ছিলেন রাসূল (সা.)। তাঁর জীবনের ভারসাম্যের সঙ্গে আর কারো তুলনা চলে না। যেমন যুদ্ধের ময়দানের একজন সফল সেনাপতি ছিলেন, তেমনি নিজ ঘরে ছিলেন একজন সফল স্বামী। যে মানুষ দিনের বেলা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে অনেক জটিলতম রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতেন, সেই তিনিই আবার রাত্রীবেলা স্ত্রীর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগীতায় অবতীর্ণ হয়ে একজন আদর্শ স্বামীর ভূমিকা পালন করতেন।


অনেকে মনে করেন, ইসলাম মানেই গাম্ভীর্যতা। স্ত্রীকে ভালোবাসা, তার সঙ্গে খুনসুটি, তার বন্ধু হয়ে যাওয়া; এসব ইসলামের দৃষ্টিতে পরিত্যাজ্য। অথচ রাসূল (সা.) স্বামী হিসেবে রোমান্টিসিজমের সর্বোচ্চ উৎকর্ষতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এমনকি হযরত উমর (রা.) তো বলেছিলেন, “প্রত্যেক স্বামীর উচিত তার স্ত্রীর সঙ্গে শিশুর মতো খেলা করা।”


তথাপিও রাসূল (সা.) এর জীবন যেহেতু একজন মানুষেরই জীবন ছিলো, তাই তাঁর সংসারেও স্বাভাবিক ভাবাবেগের জোঁয়ার-ভাটা থাকতো। সেখানে অশ্রুও ঝরতো এবং মুচকি হাসিও দীপ্তি ছড়াতো। এমনকি ঈর্ষাকাতরতাজনিত উত্তেজনারও সৃষ্টি হয়ে যেতো। সংসারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা যেমন বিরাজ করতো, তেমনি আনন্দের মুহূর্তও আসতো।


রাসূল (সা.) যখন বাড়িতে আসতেন, তখন ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসের মতো আসতেন। এক অপূর্ব প্রশান্তি এবং আনন্দের হিল্লোল বয়ে যেতো সমগ্র বাড়িটাতে। কথাবার্তা হতো। গল্প বলাবলি হতো। মজার মজার কৌতুক ও রসিকতাও চলতো। যাদের কাছে রাসূল (সা.) একজন নিছক অতিমানবীয় ব্যক্তিত্ব, স্বাভাবিক মানবোচিত আবেগ-অনুভূতির অনেক ঊর্ধ্বে, তারা এই তথ্যাবলী জেনে হতবাকই হবেন বৈ কি।


ঘরোয়া জীবনের এই স্বাভাবিক উত্থান-পতনকে অনেকে ইসলামী আদর্শের চেয়ে নিচু মনে করেন। তারা রাসূল (সা.) এর পারিবারিক জীবনের এমন একটি ছবি হৃদয়পটে লালন করে রাখেন, যেন সেখানে কতিপয় অতিমানবীয় সত্তা বাস করতো, যাদের কোনো ভাবাবেগ কিংবা কামনা বাসনা ছিলো না। অথচ সে পরিবারটিও মানুষেরই পরিবার ছিলো।


সেই পরিবারটিতেও অভাব-অনুযোগ ছিলো, মান-অভিমান ছিলো। একবার রাসূল (সা.) এর স্ত্রীগণ জীবনমান উন্নত করার জন্য আন্দোলনও করেছিলেন। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.)। তবে ঐ পরিবারটিতে আল্লাহর নাফরমানী কিংবা পাপের সামান্যতম অস্থিত্বও ছিলো না। রাতের বেলা রাসূল (সা.) যখন ঘুমাতে যেতেন, তখন পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সাধারণ কথা-বার্তা হতো। সংসার নিয়েও আলাপ করতেন।


আমরা যেমন এখন মেহমানদের নিজ বাড়িতে আমন্ত্রণ করি এবং লজ্জা না করে পেট পুরে খেতে বলি, রাসূল (সা.) ও এমনটি করতেন। বারবার তাঁকে বলতেন, “লজ্জা শরম বাদ দিয়ে তৃপ্তি করে খাও!” রাসূল (সা.) ছিলেন তীব্র রুচিবোধ সম্পন্ন মানুষ। এতো তীব্র রুচিবোধের পাশাপাশি বেশিরভাগ সময় তাঁকে ক্ষুধা ও দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত থাকতে হয়েছে। তাঁর পরিবারটিও এ ক্ষুধা-দারিদ্রতা থেকে মুক্ত ছিলো না।


রাসূল (সা.) রুক্ষ, আবেগশূণ্য হৃদয়ের মানুষ ছিলেন না। বরং ছিলেন তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ। আনন্দে আনন্দিত হতেন এবং দুঃখ বেদনায় ব্যথিত হতেন তিনিও। যাঁরা সারা দুনিয়ার দুঃখশোকে মুহ্যমান হন কিন্তু পরিবারের দুঃখশোকে পাষাণ ও নিরুদ্বেগ থাকেন, রাসূল (সা.) সেই তথাকথিত মহামানবদের কাতারে শামিল ছিলেন না। একদিকে তিনি যেমন ছিলেন অবিচলতার মূর্ত প্রতীক, অন্যদিকে বিরহ বেদনায় তাঁর চোখও অশ্রুসজল হতো।


আধুনিক সময়ের নেতাদের দেখি, অতিমাত্রায় গাম্ভীর্য এবং কঠোরতাকে ব্যক্তিত্বের মাপকাঠি মনে করেন। অথচ রাসূল এ রকম একপেশে চরিত্রের মানুষ ছিলেন না। তাঁর মুখে সদা মুচকি হাসি লেগে থাকতো। মুচকি হাসির সাহায্যে পৃথিবীর কর্কট কঠিন দায়িত্বটিকে সহনীয় করে নিতেন। সেই সঙ্গে সাথীদের হৃদয়ে স্থায়ী একটি আসন প্রতিষ্ঠা করে ফেলতেন। তাঁর কথাবার্তায় রসিকতা থাকতো তরকারীতে দেয়া লবণের মতো। তা সামান্য মুচকি হাসির সৃষ্টি করতো কিন্তু কেউ অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন না।


রাসূল (সা.) এর জীবনের এহেন উত্থান-পতন, ভাঙ্গা-গড়া থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ তাঁর পবিত্র জীবনকে ভক্তির আতিশায্যে এমন একটি ভাবমূর্তিতে পৌঁছে দিতে চান যে, তা কোনো রক্তমাংসের তৈরী মানুষের ভাবমূর্তি নয়, বরং এক অতি মানবিক জ্যোতির্ময় সত্তার ভাবমূর্তি। এ সত্তার দেহের কোনো ছায়া থাকে না।


তাঁর যাবতীয় কর্মকান্ড মোজেযা তথা অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত। তাঁর সব কাজ ফেরেশতারা সমাধা করে। তাঁর প্রতিটি জিনিসই রহস্যময়। অথচ তাঁর জীবন একজন মানুষেরই জীবন ছিলো। আর মানুষের জীবন ছিলো বলেই আমরা তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিতে উৎসাহী হই, সাহস পাই, একমাত্র অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করি অবলীলায়।

পঠিত : ৩৬৫ বার

মন্তব্য: ০